মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া
রাত বারোটা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু কুষ্টিয়া শহরের লোকের চোখে ঘুম নেই। সারা শহর জুড়ে চাঞ্চল্য আর উত্তেজনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। একটা ফোনও কাজ করছে না। আজকের দিনে এটা একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এর অর্থ কি হতে পারে, তাই নিয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে।
শুধু রাজনৈতিক কর্মীরাই নয়, শহরবাসী সবাই সচকিত।
এ ক’দিন ধরে নানাদিক থেকে নানারকম জনরব ভেসে আসছিল। সবকিছুর মধ্য দিয়ে এই কথাটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে-এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আসন্ন। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে মুক্তি-আন্দোলন শুরু হয়েছে, এখন তা অতি দ্রুত সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ নিতে চলেছে।
তবে কি এখন সেই সঙ্কট মুহূর্ত এসে গেছে? তবে কি ইতিমধ্যেই ঢাকা শহরে ওদের হামলা শুরু হয়ে গেছে? এ কি তারই ইঙ্গিত? রাজনৈতিক কর্মীরা পরস্পর আলাপ-আলোচনা করে অবশেষে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, এ ছাড়া এর আর কোনো অর্থ হতে পারে না। আর তাই যদি সত্য হয়, তবে এই আক্রমণ শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, দেখতে দেখতে সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়বে। কে জানে, হয়তো একটু বাদেই এই শান্তিপূর্ণ কুষ্টিয়া শহরের বুকে সেই ঝড় এসে ভেঙে পড়বে। কিন্তু কুষ্টিয়ার মানুষ কি সেজন্য তৈরী আছে? এই আক্রমণকে কি দিয়ে প্রতিরোধ করবে তারা? কোথায় সেই প্রস্তুতি? গোটা কয়েক বন্দুক আর রাইফেল এইটুকুই তো তাদের একমাত্র সম্বল।
কিন্তু কি আছে আর কি নেই, কি করা উচিত ছিল এবং কি করা হয় নি, এই নিয়ে ভাববার সময় নেই এখন। ওদের প্রতিরোধ করবার জন্য যা করবার এক্ষুনি করতে হবে, যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে নেমে পড়তে হবে। এখন প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান। রাজনৈতিক কর্মীরা আর ছাত্ররা দ্রুত বেরিয়ে পড়ল রাজপথে, মাইক দিয়ে আর চোঙ্গা দিয়ে শত্রুর আসন্ন আক্রমণ সম্পর্কে হুঁশিয়ারী দিয়ে সারা শহরময় প্রচার করে চলল। শহর থেকে শহরতলীতে, আর শহরতলী থেকে নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চলে তাদের এই আহ্বান ধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল, বর্বর শত্রুদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে হবে।
তাদের ডাকে ঘুমন্ত কুষ্টিয়া জেগে উঠল। ঘরের মানুষ দলে দলে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সারা শহরে বিপদ ঘণ্টা বেজে চলেছে। এক মুহূর্ত দেরী করবার সময় নেই। এক্ষুনি কাজে নেমে পড়তে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই পথে পথে শুরু হয়ে গেল ব্যারিকেড গড়ে তোলার কাজ। ওদের যান্ত্রিক বাহিনীকে অচল করে ফেলবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে বাধার পাহাড় তৈরী করে তোলা হতে লাগল। শুধু এই দিয়েই কি ওদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে? তা কি সম্ভব?
কিন্তু সে কথা বিচার করে দেখবার মতো সময় নেই এখন। লোকগুলি নেতাদের নির্দেশ-অনুসারে একদল পরিশ্রমী পিঁপড়ের মত নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে। ওরা শহরে ঢোকবার প্রধান রাস্তাটা জায়গায় জায়গায় কেটে ফেলল, দুটো একটা পুলও ভাঙল। এইভাবেই চলল তাদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি!
ওরা যা আশঙ্কা করেছিল সত্য সত্যই তাই ঘটল!
ঘণ্টা কয়েক বাদেই রাত্রির অন্ধকারে একদল পাক-সৈন্য মার্চ করে শহরের দিকে চলে এলো। তাদের মেসিনগান আর রাইফেলের তীব্র, তীক্ষè আর নিষ্ঠুর আওয়াজে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যেতে লাগল। বৃষ্টিধারার মত গুলিবর্ষণ, তার সামনে কে দাঁড়াবে! জনতা পিছিয়ে এলো। এমন মারাত্মক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করবে এমন কি হাতিয়ার তাদের আছে!
ওরা ভয় পেয়ে পেছনে হটে এলো। সারা শহরের মানুষ আতঙ্কিত হৃদয়ে প্রতি মুহূর্ত গুণে চলেছে। এবার কি হবে, সবার সামনে এই একই প্রশ্ন।
হামলাকারী পাক-সৈন্যরা বাধার পর বাধা সরাতে সরাতে শহরের কাছে এসে ঢুকে পড়ল। ব্যারিকেডের বাধাগুলি ঠেলে সরিয়ে আসতে ওদের অনেক সময় লেগে গেল বটে, কিন্তু এই বাধা ওদের অচল করে ফেলতে পারে নি।
সবাই মনে মনে যা ভয় করছিল তা কিন্তু হলো না। ওরা শান্তভাবেই শহরে এসে ঢুকল। শহরে ঢোকার পর ওদের প্রথম কাজ হলো সারা শহর এলাকায় কারফিউ আইন জারী করা, কেউ ঘর থেকে বাইরে বেরুতে পারবে না। প্রথম ধাক্কাটা কাটবার পর লোকের মনে সাহসটা একটু একটু করে ফিরে আসছিল।
কারফিউ আদেশ জারী করা-সত্ত্বেও বেশ কিছু লোক অবস্থাটা দেখবার আর বোঝবার জন্য পথে বেরিয়ে এসেছিল। ফলে ওদের গুলিতে কয়েকজন লোক মারা গেল। তাহলেও কৌতূহলী আর দুঃসাহসী লোকদের পথে চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। তারা ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে, যেন ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে অতি সন্তর্পণে যাওয়া-আসা করছিল। পথের মোড়ে মোড়ে উৎসুক জনতার ভিড় জমে উঠছিল।
পাক-সৈন্যরা জেলা স্কুল ভবনকে তাদের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করল। অধিকাংশ সৈন্য তাদের দুর্গ হিসেবে এইখানেই আশ্রয় নিল। এছাড়া কিছু কিছু সৈন্য বেতার ঘাঁটি, টেলিফোন অফিস আর থানা দখল করে বসল। ওরা পর পর ক’দিন ধরে কারফিউ আদেশ জারী করে চলেছিল। ২৯-এ মার্চ পর্যন্ত এইভাবেই কেটেছে। একটা জিনিস লক্ষ করবার মতো, এই অবস্থার মধ্যেও লোকের মনোবল একটু একটু করে বেড়ে চলেছিল। কারফিউ আইন ভঙ্গ করার জন্য প্রতিটি দিন কিছু কিছু লোক ওদের গুলিতে মারা গেছে। প্রতিরোধকারী জনতা প্রকাশ্যে চুপ করে থাকলেও সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় ছিল না। তারা ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ওদের বিরুদ্ধে চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পাক-সৈন্যদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করবার মতো অস্ত্র বা সংগঠন কোনো কিছুই তাদের ছিল না। তবে মনের দিক থেকে তারা তৈরী ছিল। এটা-যে শুধু কুষ্টিয়ার লোকদের পক্ষে সত্য তা নয়, সারা বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলের লোকদের পক্ষে মোটামুটি সত্য।
কুষ্টিয়ার নগর-জীবনের গতিধারা এ ক’দিন ধরে একটানা ভাবে বয়ে চলেছিল। ৩০-এ মার্চ তারিখে এই জীবন-প্রবাহ একটা প্রবল মন নিয়ে গর্জে উঠল, কুষ্টিয়া শহর দেখতে দেখতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল। একদিকে ইয়াহিয়ার হামলাকারী সৈন্যদল, অপরদিকে স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনী। রাত্রি সাড়ে চারটার সময় ই. পি. আর. বাহিনীর একদল জোয়ান রাত্রির অন্ধকারে শত্রুপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে শহরে এসে ঢুকে পড়ল। তারা তাদের সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে চলে এসেছে। পথশ্রমে তারা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। কিন্তু তাহলেও বিশ্রাম নেবার বা খাওয়া-দাওয়া করবার মতো সময় ছিল না। সেই অবস্থাতেই ৩০-এ মার্চের সকাল বেলা দু’পক্ষে যুদ্ধ বেধে গেল।
এই মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা হাসপাতাল নতুন অফিস, সার্কিট হাউসে পজিশন নিয়ে বসেছিল। লড়াই করবার পক্ষে এদের অবস্থানটা ছিল অধিকতর অনুকূল। এরা কিছুটা উপর থেকে পাক-সৈন্যদের উপর ঘা মারবার সুযোগ পেয়েছিল।
ই.পি.আর. বাহিনী শহরে এসে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীদের সাথে তাদের যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল। কুষ্টিয়ার প্রবীণ কর্মীদের সাথে তাদের যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল। কুষ্টিয়ার প্রবীণ শ্রমিক-নেতা শেখ রওশান আলীর মুখে সেই কাহিনী শুনছিলাম। তিনি আর তাঁর সহকর্মীদের সকলেরই একই অবস্থা। যুদ্ধ কাকে বলে সে সম্পর্কে তাঁদের কারুর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ প্রতিরোধের এই বিরাট দায়িত্ব তাঁদের উপর এসে পড়েছে। ২৫-এ মার্চ থেকে ২৯-এ মার্চ পর্যন্ত এই ক’টা দিন এক প্রবল পরাক্রমশালী শত্রু তাঁদের বুকের উপর চেপে বসে আছে। তাদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে, কিন্তু কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, তাই ভেবে তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের না আছে অস্ত্র, না আছে শিক্ষা, আছে শুধু জলন্ত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জনতা, নিরস্ত্র জনশক্তি। কিন্তু শুধু তাই
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment