‘দারোগা বাবু,—দারোগা বাবু!’—

ডাকাডাকিতে দারোগাবাবু উঠল বিলম্বিত প্রাতঃশয্যা থেকে। তখন প্রায় বেলা আটটা। গোঁফ বাগাতে বাগাতে বাইরে এল। বনওয়ারীবাবুর গোমস্তা তখন হাঁপাচ্ছে।

‘কি হলো আবার?’

গোমস্তা শুধু, বললে, ‘বড়বাব, খুন’—

‘খুন! বনওয়ারী বাবু!' দারোগা ভুরু কুঁচকে বললে, ‘কাল অতো রাত পর্যন্ত গল্প-গুজোব ক'রে এলাম – আর’...

গোমস্তা দম নিয়ে বললে, ‘আজ্ঞে বেঙা মাঝি। শালা আজ সকালে কয়েকজনাকে নিয়ে বনে কাঠ কাটতে যাচ্ছিল জবরদস্তি। তা আপনার বুদ্ধিমতো শালাকে ভজিয়ে টজিয়ে ডেকে এনেছিলাম, না-না ক'রে বৈঠকখানায় শালা ঢুকেও ছিল। তারপর বড়বাবর সঙ্গে দুটো একটা কথা হতে না হতেই ধাঁই ক'রে কোপ মারলে কাঠ-কাটা টাঙি দিয়ে। বাস্‌।’

'ঘরে ঢুকেছিল যখুনি তখুনি সব ধরে ফেললে না কেন?’

‘আমরা সব তৈরি ছিলাম আপনার কথা মতো। তা বড়বাবু বোকার মতো’—

‘হুঁঃ’ দারোগা বললে, ‘বুনো জন্তুর সঙ্গে গেছেন বাক্যব্যয় করতে।’

‘ওই দুটো একটা কথা—বাস্।'

‘জন্তুর সঙ্গে কথাটা আবার কি!’ দারোগা হুঁ করে উঠলো বিরক্ত হয়ে। কথা দুটো চারটেই বটে ৷

বনওয়ারীলাল বাঘকে খাঁচায় পেয়ে যেন খোঁচা মেরে বলেছিল, 'বড় দেঁতেল হইচিস—হাঁরে!’—

বেঙা বলেছিল, 'হাঁ তো বাবু—বনের জন্তু মোরা, দেঁতেল বরা। বন কেড়ে লিলে মোদের—কাঠ কাটতে দিলেনি, গোরু মহিষের ঘাস কেড়ে লিলে মোদের—কলের কাগজ বানালে, ঘর-জমিন লিলে, জেতের মেয়েমানষ লিলে'—

‘বটে রে শুয়োরের বাচ্চা! এই বজরঙ্গলাল’—

তারপর দড়াম ক'রে বৈঠকের ভারী দুটো পাল্লা বন্ধও হয়েছিল। কিন্তু বনওয়ারীলালের বুক ফাটা আর্তনাদে সব কেমন ভেস্তে গেল। মড়াৎ ক'রে দরোজার হুড়কো ভেঙে ছুটে বেরিয়ে গেল বেঙা মাঝি ৷

‘ধর-ধর-ধর।’

পাইক বরকন্দাজ ছুটেছে বেঙার পেছনে পেছনে। শিকার পালিয়েছে খাঁচা ভেঙে ৷ গোমস্তা ছুটে এসেছে থানায় ৷

‘এই মিনিট দুয়ের মধ্যে বড়বাবু মরে গেলেন।’

দারোগা বললে, ‘বুনো জন্তুর কাণ্ড! সাবধানে কাজ করতে হয়। ওগুলো কি মানুষ! অপরাধপ্রবণ জাত। ওদের সামলে ওঠা দায়। চল দেখি।'—

‘বড়বাবুর দিকে তাকানো যায় না চোখ মেলে। শালা এমনি কেটেছে দু-খণ্ড ক'রে।—দেখে মাথা ঘুরে যায়!’

‘মানষের জীবনের জন্যে ওদের কি কিছু মায়া আছে! বললাম যে, ওগুলো বুনো জন্তু। ওদের বস্তিসুদ্ধ, মাগীমদ্দ ধরে এনে ওই অবস্থা দেখাও—ওরা না পাবে ভয়, না হবে ওদের মায়া। ইংরেজরা কি আর সাধে ওই সব এক-একটা বুনো জাতকে অপরাধপ্রবণ বলে দাগিয়ে রেখে কড়া শাসন করত!’—

‘তা হলে চলুন আপনি।’

‘যাব বৈকি।’ দারোগা গোঁফ পাকাতে পাকাতে হাঁকলে, ‘এই মহাদেও পরসাদ, সরযু সিং।’—

থানায় ফৌজী সেপাই তৈরি হতে লাগল।

এদিকে পাইক-পেয়াদার একটা দল ধাওয়া করেছে বেঙা মাঝির পেছনে। বেঙা ছুটেছে বুনো পথ ধরে। বাল্যের বহু পরিচিত অরণ্যভূমি—আনাচ-কানাচ, আর সুগঠিত পায়ে হরিণের দ্রুততা। ধাওয়া করা দলটা ক্রমেই পেছিয়ে পড়ছে—দূরে সরে যাচ্ছে তাদের হাঁকডাক হৈহাল্লা। বেঙা ছটেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। দিনের আলোয় উদ্ভাসিত বাইরের খোলা প্রান্তর—যার একপ্রান্তে মিনমিন করছে তাদের ছায়াঘন দরিদ্র কুঁড়েগুলো। কিন্তু সেদিকে মায়া হয়তো আছে, আশ্রয় আর নেই। ক্রমশ গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকছে বেঙা—কিন্তু দিনের আলোয় অন্ধকার কোণ কই, আশ্রয় কই! শালের দীর্ঘদেহ ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে, মহুয়ার গাছগুলোও যেন পাল্লা দিয়ে মাথা তুলছে উপরে। মাঝে মাঝে দু-একটা কাঁচা বাঁশের ঝোপ—তার মধ্যে লুকোবার জায়গা নেই। ক্রমাগত, ঘণ্টাখানেক ধরে সে ছুটলো। ধাওয়া করা দলটার হৈহাল্লা আর শোনা যায় না। বেঙা বসে পড়লো একটা শাল গাছের তলায়। টাঙিটা তখনো শক্ত মুঠোয় ধরা—ওর সেই বিস্ফোরিত মহূর্তের ক্রোধ হাতের মুঠোটায় যেন জমাট বেধে গেছে ৷ তাজা রক্তের চিহ্ন শুকিয়ে গেছে টাঙির মাথায়। গাছতলায় বসে কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে শুনল বেঙা—বাতাসে, কলকণ্ঠ শোনা যায় কিনা! শোনা যায় না। ওর পঁচিশ বছরের বলিষ্ঠ নিঃশ্বাসে ভারী বুকটা কাঁপছে হাপরের মতো—ওর নিকষ কালো দেহটা ঘাম ঝরে হয়ে উঠেছে কালো পাঁকের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion