অনেকদিন আগের কথা। ময়মনসিংহের জমিদার বাড়ির পেছনে এক অচিন বৃক্ষে আচমকা চোখ আটকে যায়। বৃক্ষের প্রতি আমার ছোট্ট থেকেই ভীষণ আগ্রহ। বাবার সরকারি চাকরীসূত্রে আমরা যখন কুষ্টিয়া ছিলাম, তখন (স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত) আমার সংগ্রহে প্রায় দেড়শ’ প্রজাতির সৌখিন গাছ ছিল। কুষ্টিয়া থেকে গ্রামের বাড়ি জামালপুর স্থানান্তরিত হতে তখন অনেক গাছ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিসর্জন দিতে হয়েছে।

এরপর আনন্দমোহন কলেজে অনার্স পড়তে যাওয়া। সেখানেও উদ্ভিদ থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। যদিও ইচ্ছে ছিল পদার্থবিদ্যায় পড়বো, কিন্তু মামার অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে হলো বিপত্তি। অগত্যা মুখস্থবিদ্যার সঙ্গে ৬ বছর কাটাতে হলো। মুখস্থকরণে আমার ছিল বড্ডবেশি দুর্বলতা। পরিণামে ফলাফল তথৈবচ। যাহোক শুরু করি। আজকের লেখাটি উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র হিসেবে নয়, বরং একজন বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে লেখা।

অচিন বৃক্ষটি ছিল বৃহদাকৃতির, লম্বায় প্রায় ত্রিশ মিটার। ডালপালা ছড়িয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। একটি নয়, দুটি বৃক্ষ। আমি খুঁজতে লাগলাম এই বৃক্ষের নাম-ধাম, বংশ-পরিচয়। উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র হিসেবে শুধু বৃক্ষের নাম জানলে চলে না, সাথে বৈজ্ঞানিক নামও জানতে হয়। বেশ ক'দিন পর আমার বন্ধু ও সহপাঠী রিমনের কাছে জানতে পারলাম বৃক্ষটির নাম। সাথে এও জানতে পারলাম বৃক্ষটির তিন নম্বর ফুটবলাকৃতির গোল গোল সরেশ ফল হাতির খুব প্রিয় খাবার। তাতে আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। কিন্তু এর বেশি তথ্য আর কোথাও থেকে সংগ্রহ করতে পারিনি। আগে গাছদু’টি রাজবাড়ির উঁচু দেয়ালঘেরা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি পেছনের দেয়াল ভেঙে পড়ায় গাছদু’টির অরক্ষিত অবস্থার সুযোগে আমিও কাছ থেকে দেখলাম ও ফুল পাতা ফল পর্যবেক্ষণ করলাম। ঢাকায় ফিরে এসে ইন্টারনেট ও বই ঘেঁটে নানা তথ্য জোগাড় করে তা আপনাদের উপস্থাপন করছি—

বাংলাদেশে নাগলিঙ্গম দুর্লভ প্রজাতির। এটি দ্রুতবর্ধনশীল পত্রঝরা বৃক্ষ। এর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়। এটি ত্রিনিদাদ ও ক্রান্তীয় আমেরিকার প্রজাতি। ভারত অঞ্চলে বৃক্ষটি প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার বছর ধরে পরিচিত। ভারতে শিব মন্দিরে এ গাছের প্রচুর্যের জন্য একে শিবকমল, শিবলিঙ্গম নামেও ডাকা হয়। এ ফুলের পাপড়ি নাগের শিরোবস্ত্রের মত যা শিবলিঙ্গমকে রক্ষা করে বলে এ ফুলকে নাগলিঙ্গম নামে ডাকা হয়। পৃথিবীর উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রায় সর্বত্রই এই বৃক্ষ দেখা মেলে। এর ফলগুলো দেখতে ও আকৃতিতে কামানের গোলার মত হওয়ায় ইংরেজিতে এর নাম Cannonball Tree. এর বৈজ্ঞানিক নামCouroupitia quianensisযা Magnoliophyta বিভাগভুক্ত Magnoliopsida শ্রেণিভুক্ত Ericales বর্গভুক্ত Lecythidaceae পরিবারভুক্ত। ১৭৫৫ সালে ফ্রান্সের উদ্ভিদবিজ্ঞানী J F Aublet গাছটির প্রাজাতির নামকরণ করেন। এর ভিন্ন দু’টি প্রজাতি হলো—নাগেশ্বর ও নাগকেশর।

নাগলিঙ্গমের কাণ্ডজ্ঞান বেশ ভালো, অর্থাৎ কাণ্ডের বেড় বেশ মোটা। কাণ্ডের ব্যাস ৬-৭ মিটার পর্যন্ত হয়। কাণ্ডের নিচ থেকেই (হাতের নাগালের মধ্যেই) ফুল ও ফল ধরে। কাণ্ডের বাকল ধূসর বাদামী বর্ণের আর অমসৃণ-বন্ধুর প্রকৃতির। গাছের কাণ্ড পুরু হলেও ভেতরটা তেমন সার হয় না, তাই কাঠ হিসেবে ব্যবহারের বিশেষ প্রচলন নেই। ফলস্রুতিতে গাছটির বাণিজ্যিক মূল্য নাই বললেই চলে। গাছটির পাতা বর্শার ফলার মতো। পাতায় পাতায় সুদীর্ঘ বৃক্ষটি ছেয়ে থাকে। হঠাৎ পাতা ঝরে গিয়ে পুরো গাছ পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। আবার অল্পদিনের মধ্যেই সবুজ পাতায় ভরে ওঠে। এর পাতাগুলি গাঢ় সবুজ বর্ণের, গুচ্ছ প্রকৃতির, লম্বায় এক বিঘত পর্যন্ত লম্বা হয়।

নাগলিঙ্গমের উজ্জ্বল গাঢ় গোলাপি বর্ণের ৭-৮ সেমি চওড়া বৃহদাকার ফুল মিষ্টি সুগন্ধিযুক্ত। তবে বর্ণ লাল বা কমলাও হতে পারে। হলদে সবুজ কলি থেকে ফোটা অপূর্ব সুন্দর এই ফুলে চোখ আটকাবেই। দৃষ্টিনন্দন ফুলটির নান্দনিকতা নিসর্গীদের মুগ্ধ করে সহজেই। যদিও এ ফুলে মধু হয় না, তথাপিও এর মাতাল করা ঘ্রাণ মোহিত করে সকলকে। ফুলের গড়ন সাপের ফনার মতো এবং ফুলের ভেতরের দিকে গাঢ় গোলাপি ও বাইরে হালকা হলুদ বর্ণের। ফুলের পরাগচক্র বিশেষ বাঁকানো, পুরু ও সাদাটে। ফুলে ৬টি পাপড়ি সুবিন্যস্ত থাকে। গাছের কাণ্ড বা ডালের সাথে ঝুলে থাকা লম্বা ডাঁটায় বিক্ষিপ্তভাবে অনেকগুলো ফুল একত্রে ফোটে। ফুল সপ্তাহব্যাপী ফুটে থাকে। ফুল নষ্ট না হয়েই গাছ থেকে ঝরে পড়ে। চারা রোপনের প্রায় এক দশক পর গাছে ফুল ধরে। সাধারণত সারাবছরই ফুল ফোটে, তবে ফুল ফোটার মৌসুম গ্রীষ্মকাল ও বর্ষাকাল। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শিব পূজোয় এই ফুলের ব্যবহার দেখা যায়। বৌদ্ধমন্দিরেও এই ফুলের বিশেষ ব্যবহার লক্ষণীয়।

নাগলিঙ্গমের ধূসর বাদামী বর্ণের বড় বড় গোল ফল হয়, যা হাতির খুবই প্রিয় খাবার। এজন্য এর নাম ‘হাতির জোলাপ গাছ’ বলেও ডাকতে শোনা যায়। ফল প্রায় চার কেজি পর্যন্ত হয়। এই ফলের বীজের ভেতরে একপ্রকার তেল থাকে বলে ফলটা দ্রুত নষ্ট না হয়ে দীর্ঘদিন গাছে ঝুলে থাকে। এজন্য গাছে প্রায়ই কিছু ফল ঝুলতে দেখা যায়। যথেষ্ঠ শক্ত খোলস সম্বলিত দ্বিস্তরী আবরণ দিয়ে ঢাকা ফলটির শাঁস বেশ ঝাঁঝালো ও দুর্গন্ধী। শাসালো ফলে অনেক বীজ থাকে। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে চারা হয়। যেসকল ন্যাড়া একবারের বেশি বেল তলায় যান না, তাদের নাগলিঙ্গম তলায় দ্বিতীয়বার যাওয়ার আগে বিশেষভাবে ভাববার অনুরোধ রইলো।

নাগলিঙ্গম ঔষধিগুণসম্পন্ন বৃক্ষ। এর ফুল পাতা ও বাকলের নির্যাস এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাঙ্গাল, এন্টিসেপটিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাকলের নির্যাস ওষুধ পেটের পীড়া উপশম করে। ত্বকের নানা সমস্যায়, পিঠের ব্যথা, লেসম্যানিয়াসিস ও ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে নাগলিঙ্গমের পাতার রস ব্যবহার হয়।

বাংলাদেশে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি নাগলিঙ্গম গাছ আছে। তন্মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি-একটি ভূতত্ত্ব বিভাগের পাশে অপরটি কার্জন হল প্রাঙ্গণে রয়েছে। রূপসী বাংলা হোটেলের পাশে, ফুলার রোডের মাথায় যেখানে ফোয়ারা আছে সেখানে ছিল একটি প্রাচীন নাগলিঙ্গম গাছ। ফোয়ারা তৈরি করতে গিয়ে গাছটি কেটে ফেলা হয়। দেশের সব প্রবীণ ও নবীন নাগলিঙ্গম বৃক্ষের সুরক্ষা অতীব জরুরি।


বিজ্ঞানপাঠ, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৬

(দ্বিতীয় বর্ষ : প্রথম সংখ্যা)

আলোকচিত্র: লেখক

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion