দিশি ও দেয়া দুইবোন। দুজনই পিঠাপিঠি একজন ক্লাস ফাইভে, আরেকজন ক্লাস ফোরে। সারাদিন লেগে থাকে একজন আরেজনের পেছনে। দিশি একটু শান্ত স্বভাবের, বড়রা সাধারণত যেমন হয়; আর দেয়া একটু চঞ্চল, ছোটরা যেমন হয় আরকি। বাসায় বাবা-মা আর তারা দু'বোন ছাড়াও আরো একজন থাকেন। তিনি হলেন তাদের নানী সম্পর্কের। দীর্ঘদিন ধরেই বাসায় আছেন। বাসার কাজকর্ম করেন, তবুও তিনি এ পরিবারেরই একজন। তার কোন নাম নেই। অবাক হলে! হুম অবাক হওয়ার মতোই কথা। নাম একটা ছিল বৈকি, কিন্তু কালক্রমে তা হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে। খুব ছোটবেলাতেই তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের আগে বাপ-মা-অন্যরা 'কেনী' বলে ডাকতো; আর বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়ি 'বৌমা' আর তার স্বামী 'বৌ' বলে ডাকতো। ছেলে হওয়ার পর ছেলের নাম অনুসারে সবাই তাকে 'ভেলুর মাও' বলে ডাকে। 'ভেলুর মাও' থেকে 'ভেলুমাও' এভাবেই তার নাম হারিয়ে যায় কালগহ্বরে; অবশ্য তার নাম আদৌ ছিল কিনা সেও এক রহস্য। এছাড়াও বাসায় আরেকজন আছে। সে হলো বাবু ভাইয়া, ছোট ফুফুর ছেলে; ঢাকাতে কোন এক কলেজে পড়ে। সে থাকে ঢাকায়, মাঝে মাঝে আসে বাসায়। তাদের বাসায় থেকেই পড়াশোনা করেছে। কী সব বিজ্ঞান সংগঠন-টংগঠন করে নাকি।

ভেলুমাও নানু তাদের বন্ধু। সকালে স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুম পর্যন্ত নানুই তাদের সার্বক্ষণিক সাথী। দেয়া-দেশি তাদের সেই নানুর সাথেই ঘুমায়। ঘুমের আগে প্রতিদিন তারা গল্প শুনে। ভেলুমাও যেন রীতিমত গল্পের ঝুড়ি, ঝুড়ি বললে ভুল হবে, গল্পের খনি। তার প্রতিটি কথায় প্রাসঙ্গিক গল্প বলবে। গল্পে খুব পারঙ্গম। দেয়া-দিশি খুব মনোযোগ দিয়ে গল্প শোনে। মাঝে মাঝে দেয়া প্রশ্ন করে, নানু সেসবের তোয়াক্কা করে না। আপন মনে গল্প বলতেই থাকে। তার সম্পর্কে দেয়া-দিশি 'হিরক রাজার দেশে'-এর মতো করে ছড়া তৈরি করেছে—"ভরপেট নাও খাই, তবুও গল্প বলা চাই"।

এখন বৈশাখ মাস, ঝড়-বাদলার সময়। আজকেও ঝড় হচ্ছে। সারা শহরে বিদ্যুৎ নেই। তাই খেয়ে-দেয়ে তারা দ্রুত শুয়ে পড়েছে। তাদের বাসা পাঁচ তলায়। পাঁচ তলা থেকে সমস্ত শহর ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। কোথাও কেউ নেই, কোন আলো নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ভেলুমাও তাদের নিয়ে দ্রুত শুয়ে পড়ে। শুয়ে দিশি জিজ্ঞাসা করে নালী, তুমি ভূত দেখেছো কখনো? ভেলুমাওয়ের তড়িৎ জবাব—হ, দেখছি মানে, একবার তো আমারে মাইরাই হালছিল। কোন রহমে বাইসা আইছি।

ভেলুমাও বলতে থাকে—একবার তোমাগো নানা গেছিলো গঞ্জে। বিহান বেলায় গেছিল, রাইত অইয়া গেছে, তাও আহেনা। আমগো বারির হগগলেই খাইয়্যা বাতি নিবায়া হুইত্যা পরছে। আম্মা কইলো—অচি এহনো আহে নাই, তুমি গনিগো বাইত থেইক্যা দেইখ্যা আহ, গনি আইছে নাহি। খুঁজটা লইয়া আহ, ঝড়-তুফানের রাইত। আমি কুপি একটা লইয়া বাঁশঝাড়ের মইধ্যে দিয়া পাগারপারে শেওড়া গাছের তল দিয়া গেলাম গনি ভাইজান গো বাইত। ভাবী কইল ভাইজানও নাহি এহনও আহে নাই। খুব চিন্তা অইতাছে। আমি পান একটা মুখে দিয়া ফিরা আইলাম।

চারপাশে ঘুট ঘুইট্যা আন্ধার বাঁশঝাড় পার হইতেই তুফান ছুটল। তুফানে কুপি গেল নিইভ্যা। চারপাশে বিরাট আন্ধার। ডরে আমার হাত-পাও এক্কেরে কাঠ হইয়া গেল। পাগারপারের শ্যাওড়া গাছের তলে আইতেই ঘুটঘুইট্যা অন্ধকারের মধ্যে দেহি পাগারের মইধ্যে থিকা ফুস কইরা আগুনের লাহান বিজলি জইল্যা উঠলো। এইডা দেইখ্যাই আল্লা-খোদাগো কইয়া মারলাম এক দৌর। এক দৌরে বাইতে। হাপাইতে হাপাইতে বাড়িতে আইয়া দরজার মধ্যে পইরা গেলামগা। আম্মা-আব্বা উইঠ্যা দৌরাইয়া আইলো। আমি শুধু কইলাম আমারে খাইয়াল্লো! তারপর আর হুশ নাই। জ্ঞান আইলে দেহি আমারে পানি খাওয়াইতাছে। কচু পাতায় কইরা দাউ পুরা পানি খাইয়া আস্তে আস্তে এক মাসে বালা অইছি। জ্বর বালা অইছে এক হপ্তায়। তারপর কবিরাজের কথায় হগগলে মিইল্ল্যা শ্যাওড়া গাছটা কাইট্যা ফালাইছে।

এই হইলো ভূতের কাহিনী। বুঝছো?

তারা যেন এক নিঃশ্বাসে গল্পটা শুনলো। শুনলো বললে কম বলা হয়, যেন গোগ্রাসে গিললো। গল্প শুনে তারা নড়েচড়ে গুলো। আলোহীন কালো রাতের নীরবতা ভেঙ্গে দিশিই প্রথম জিজ্ঞাসা করলো—ভূত দেখো নাই, নাকি শুধু আগুনই দেখছো? সাথে সাথেই দেয়াও চটপট জিজ্ঞাসা করলো—সত্যিই আগুন দেখছিলা তো, নাকি ভুল দেখছো?

ভেলুমাও জানে এখন অনেকক্ষণ প্রশ্নোত্তর পর্ব চলবে ঘুমের আগ পর্যন্ত। সেও খুব আগ্রহের সাথেই জবাব দিতে থাকে—হু, দেখছি মানে ইয়া বড় এক আগুন। ফুঁস কইরা জইল্যা উঠলো। আরেকটুর লেইগ্যা বাইচ্যা গেছি।

দেয়া পাল্টা প্রশ্ন করলো—বাবু ভাইয়া যে বললো ভূত-টুত বলে কিছু নেই। তুমি ভুল দেখছো।

ভেলুমাও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়—ভুল দেহুম ক্যা। ঐডা অইল শ্যাওড়া গাছের ভূত। আমি একলা না, বেবাকেই দেখছে।

দিশি আবার প্রশ্ন করে—ভূত দিনের বেলায় দেখা যায় না কেন? ওরা কি প্যাঁচা, বাদুড়ের মতো নিশাচর নাকি? আচ্ছা নানী মানুষ ভূত কেন সবসময় একা একা দেখে? সাবাই মিলে কেন ভূত দেখা যায় না? দেয়া মজা করে জবাব দিল—ভূতরা হলো ভীতু তাই কেউ একা থাকলে আসে। এবার দিশিকে উদ্দেশ্য করে বলে—তুই ভূত বিশ্বাস করিস? আমি কিন্তু করি না। কাল বাবু ভাইয়া আসবে। কালকেই জিজ্ঞাসা করবো ভূত বলে কিছু আছে কি-না, দেয়া বললো। দিশি খুব উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করে, বাবু ভাইয়া আসবে কাল? কে বললো? রাতে মাকে ফোন করেছিল, মার কাছে শুনলাম, দেয়া বললো।

ইয়া, কি মজা! বাবু ভাইয়া আসতেছে। কালকে আরো বিজ্ঞান প্রজেক্ট শিখবো, বেশ জোরে শোরেই বললো দিশি। এবার ভেলুমাও একটা হাই তুলে ওদের ঘুমানোর তাড়া দেয়।

দিশি আবার জিজ্ঞাসা করে—কচুপাতায় দাউ পোড়া পানি কেন খাওয়ালো?

ভেলুমাও ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জবাব দেয়—কেউ ডরাইলে তারে দাউ পুইড়া পানিতে ডুবাইয়া কচু পাতায় কইরা ততা পানি খাওয়াইলে ডর কমে। ডরাইলে তুমরাও দাউ পুড়া ততা পানি খাবা। বুঝছো? কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে সে দিশি-দেয়াকে নাম ধরে ডাকে। কিন্তু তারা কোন উত্তর দেয় না। উত্তর না পেয়ে তার উৎসাহ দমে যায়, সে কাঁথায় মাথা মুড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে বাসায় বাবু ভাইয়াকে দেখতে পায় ঘুমুচ্ছে। বাবু ভাইয়াদের কলেজে কি এক গণ্ডগোল হয়েছে, সেজন্য কলেজ বন্ধ; তাই চলে এসেছে। দেয়া-দিশি বিকালে খেলাধুলা শেষ করে এসে দেখে বাবু ভাইয়া বারান্দায় বসে বই পড়ছে। তারা দু'জনই কাছে গিয়ে বসে। তিন জনই নিশ্চুপ। বাবু ভাইয়া বই থেকে চোখ সরিয়ে তাদের দিকে তাকাতেই তারা সচকিত হয়ে তাদের স্বভাবসুলভ জিজ্ঞাসার তৃষ্ণা প্রকাশ করে। ভাইয়া ট্রাফিক সিগন্যালে থামার জন্য লাল আলো ব্যবহার করা হয় কেন, প্রশ্ন করে দিশি। সাথে সাথেই দেয়া জিজ্ঞাসা করে রংধনু কেন হয়? এবার বাবু ভাইয়ার পালা। সে চোখ থেকে চশমাটা খুলে বারান্দার ফুলের গাছে ঝুলিয়ে রেখে জ্ঞানীর মতো এক ভাব নিয়ে বলে—লাল বাত্তি! দেয়া-দিশি এবার ঝুঁকে বসে আরো মনোযোগী হয়। আলো তরঙ্গ আকারে চলাচল করে। সাদা আলো হলো অনেকগুলো আলোর সমষ্টি। এই যেমন—বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল। লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচে' বেশি। আর তাই অন্য আলো অপেক্ষা তা অধিক দূরত্ব থেকেও দেখা যায়। এজন্য একে বিপজ্জনক সাইন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কারণ বিপদচিহ্ন দূর থেকে দেখলে আগেভাগেই সতর্ক হওয়া যায়। এজন্য থামার জন্য বা বিপদচিহ্ন হিসেবে লাল আলো ব্যবহার করা হয়। আর রঙধনু তো আরো মজার। বৃষ্টির পর আবার সূর্যের আলোর বিপরীত আকাশে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের ফলে সূর্যের সাদা আলো বিভাজিত হয়ে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion