সেদিন বেশ কয়েক মাস পর আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা। শরীর খারাপ, ঠাণ্ডাজনিত সর্দিকাশি। জানতে চাইলাম, কিরে সর্দি-কাশি ছাড়ে না কেন তোকে? শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল একই অবস্থা ছিল তোর। ডাক্তার দেখাসনি? ও বললো, রাখ তোর ডাক্তার। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না।

বিষয়টা সত্যি ভাববার! কোনো ওষুধ বা এন্টিবায়োটিক কেন কাজ করছে না? তাহলে কি সামনে এমন দিন আসছে যে আমাদের সামান্য সর্দি-কাশি হবে, হাত- পা কাটবে, জ্বর উঠবে তারপর টুপ করে মারা যাবো? কোনো এন্টিবায়োটিকই আর কাজ করবে না? এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। ফ্লেমিং বলেছিলেন, “এই এন্টিবায়োটিকের কারণে আজ কোটি কোটি মানুষ বেঁচে যাবে। অনেক বছর পর এগুলো আর কাজ করবে না। তুচ্ছ কারণে কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে আবার।”

সমস্যাটা আসলে কোথায়? ডাক্তার স্বল্পতা, ফার্মেসি হতে ওষুধের সহজলভ্যতা নাকি আমাদের মানসিকতা? 'হেলথ ওয়াচ'-এর জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে একজন ডাক্তার প্রত্যেক রোগীর পেছনে গড়ে সময় দেন মাত্র ৫৪ সেকেন্ড! এতটুকু সময়ের মধ্যে কি আসলেই সঠিকভাবে রোগ নিরূপণ সম্ভব? আবার আমাদের দোষও কম নয়। যখন রোগে ভুগি তখন সাময়িক উপশমের জন্য দেদারসে ওষুধ খেয়ে নেই। বেশিরভাগ সময়ই এন্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করি না। আবার কয়েকমাস পর একই উপসর্গ দেখা দিলে সহজে কিন্তু ডাক্তারের কাছেও যাই না; ফার্মেসি থেকে আগের ওষুধটা আনিয়ে নিজে নিজে খেয়ে ফেলি। উন্নত দেশগুলোতে কিন্তু ওভার দা কাউন্টার ড্রাগ ছাড়া আর কোন ওষুধ প্রেসক্রিপশনের বাহিরে কেনা যায় না।

ডা. জন রবিন্স এ অবস্থার জন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে রোগীদের ভ্রান্ত ধারণাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, এরা মনে করে যে, সুস্বাস্থ্য বা নিরাময় ডাক্তার, ড্রাগস্টোর বা হাসপাতালে রয়েছে। ডাক্তার তাদেরকে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা ইনজেকশন দিয়ে ভালো করে দেবেন। এ আশায় রোগীরা ডাক্তারের পর ডাক্তার আর ওষুধের পর ওষুধ বদলায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থা দিনের পর দিন একই থাকে। আসলে রোগ ও অসুস্থতা থেকে মুক্তির জন্য প্রথম প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবন চেতনার পরিবর্তন। আপনাকে জানতে হবে যে, নিরাময়ের ক্ষমতা আপনার নিজের ভেতরেই আছে, ডাক্তার কেবল সহায়ক শক্তি মাত্র। যতক্ষণ নিজে বিশ্বাস করতে না পারছেন যে আপনিও সুস্থ হতে পারেন ততক্ষণ কোনো চিকিৎসাই আপনাকে সুস্থ করতে পারবে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, শতকরা ৭৫ ভাগ রোগের কারণই হচ্ছে মনোদৈহিক। অর্থাৎ কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার মানসিক প্রতিক্রিয়াই ৭৫ ভাগ রোগ সৃষ্টির কারণ। শতকরা ১৫ ভাগ রোগের কারণ হচ্ছে ইনফেকশন, ভাইরাস আক্রমণ, ভুল খাদ্য গ্রহণ ও ব্যায়াম না করা। শতকরা ১০ ভাগ রোগের কারণ হচ্ছে দৈহিক আঘাত, ওষুধ ও অপারেশনের প্রতিক্রিয়া। তাই শতকরা ৭৫ ভাগ রোগই শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সুস্থ জীবনদৃষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে নিরাময় হতে পারে।

এখন জানি এন্টিবায়োটিক কী? গ্রিক শব্দ 'এন্টি' ও 'বায়োস' থেকে 'এন্টিবায়োটিক' শব্দটি এসেছে। 'এন্টি' অর্থ বিপরীত ও 'বায়োস' অর্থ জীবন। অর্থাৎ এটি জীবিত মাইক্রোঅর্গানিজমের বিরুদ্ধে কাজ করে। এন্টিবায়োটিক হচ্ছে সেই সব ঔষধ যা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা পরজীবী ধ্বংস করে অথবা এদের বিষক্রিয়াকে নষ্ট করে। ব্যাকটেরিয়াজনিত বিভিন্ন রোগে এন্টিবায়োটিক একটি বহুল ব্যবহৃত সফল ওষুধ।

এই এন্টিবায়োটিক খাওয়ার কিছু নিয়ম আছে। নির্দিষ্ট ডোজে, নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত এন্টিবায়োটিক খেতে হয়। না খেলে যা হতে পারে তাকে 'এন্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স' বলা হয়। ধরা যাক, আমার শরীরে এক লক্ষ রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া আছে। এগুলোকে মারার জন্য আমার ১০টা এম্পিসিলিন খাওয়া দরকার। এম্পিসিলিন এক প্রকার এন্টিবায়োটিক। আমি খেলাম ৭টা। ব্যাকটেরিয়া মরলো ৭০ হাজার এবং আমি সুস্থ হয়ে গেলাম। ৩০ হাজার ব্যাকটেরিয়া কিন্তু রয়েই গেলো। এগুলো শরীরে ঘাপটি মেরে বসে জটিল এক কাও করলো নিজেরা নিজেরা। তারা ভাবলো, যেহেতু এম্পিসিলিন দিয়ে আমাদের ৭০ হাজার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে অতএব আমাদেরকে এম্পিসিলিন প্রুফ জ্যাকেট পরতে হবে এবার। প্ল্যান করে থেমে থাকে না এরা, বরং সত্যি সত্যি জ্যাকেট তৈরি করে ফেলে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো। এরা বাচ্চাকাচ্চাও পয়দা করে একই সময়ে। বাচ্চাদেরকেও সেই জ্যাকেট পরিয়ে দেয়। এর ফলে যেটা হয়, পরেরবার এম্পিসিলিন নামক এন্টিবায়োটিকটা আর কাজ করে না। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, জ্যাকেট পরা ব্যাকটেরিয়াগুলো কেবল ঐ ব্যাক্তির শরীরেই বসে থাকে না। তিনি হাঁচি দেন, কাশি দেন, ব্যাকটেরিয়াগুলো ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। এক সময় পুরো এলাকাতেই আর ঐ এন্টিবায়োটিক কাজ করে না। যারা খুব নিয়ম করে ওষুধ খান তারাও বিপদে পড়ে যান সবার সাথে। আমরা খুব ভয়ংকর একটা সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি দ্রুত। ব্যাকটেরিয়া আর তাদের বিভিন্ন 'জ্যাকেট'-এর তুলনায় এন্টিবায়োটিকের সংখ্যা খুব বেশি না। অনেক এন্টিবায়োটিক এখন আর কাজ করে না, বাকিগুলোর ক্ষমতাও কমে আসছে। আমাদের বড় বড় হাসপাতাল থাকবে, সেখানে এফসিপিএস, এমডি, পিএইচডি করা ডাক্তাররা থাকবেন কিন্তু কারোরই কিছু করার থাকবে না। সামান্য সর্দিতেই রোগী মরে সাফ হয়ে যাবে!

উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা আলাদা। তারা নিয়ম মেনে ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধ খায়। বিপদে আছি আমরা। 'মেডিসিনের বাইবেল' নামে পরিচিত ডেভিডসনে'র বইয়েও আমাদের এই উপমহাদেশের কথা আলাদা করে উল্লেখ আছে। অনেক ট্রিটমেন্টে বলা হয়েছে, “দিস অরগানিজম ইজ রেজিসটেন্ট এগেইনেস্ট দিজ ড্রাগস ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট...।”

সর্দি-কাশি এবং অধিকাংশ ডায়েরিয়ার চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় না, এর জন্য তরল পানীয় ও বিশ্রামই যথেষ্ট। কথায় আছে, “Time Is The Best Medicine.”

সুতরাং, আমাদের করণীয় WHO-এর পরামর্শ অনুযায়ী ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত ডোজ ও সময় অনুসারে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা। একান্তই ওষুধ খেতে হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়ার অভ্যাস করি, সচেতন হই এবং শরীরকে সুস্থ রাখি।

বিজ্ঞান পাঠ, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৫

(প্রথম বর্ষ :: প্রথম সংখ্যা)

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion