আচার্য জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে আমার পিতার যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন আমি নিতান্ত শিশু। পরিচয় ক্রমশ যখন বন্ধুত্বে পরিণত হল তখনও আমি বালক। জগদীশচন্দ্র সম্বন্ধে আমার স্মৃতি তাই বাল্যস্মৃতির সঙ্গেই বেশি জড়িত।

জগদীশচন্দ্র ১৯০০ সালে লণ্ডন-প্রবাসকালে আমার পিতাকে লিখেছিলেন, ‘তিন বৎসর পূর্বে আমি তোমার নিকট একপ্রকার অপরিচিত ছিলাম…’

জগদীশচন্দ্র ইউরোপ-ভ্রমণের পর কলকাতায় ফিরে আসেন ১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে। তাঁর জীবনীকার প্যাট্রিক গেডিস্ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, পৌঁছ-সংবাদ পেয়ে আমার পিতা তাঁকে অভিনন্দন জানাবার জন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখেন তিনি বাড়িতে নেই। তখন তাঁর টেবিলে একটি ম্যাগনোলিয়া ফুল রেখে আসেন। দ্বিতীয়বার যখন দেখা করতে যান দুই বন্ধুর কিরকম মিলন ঘটেছিল তার বর্ণনা গেডিসের লেখায় পাওয়া যায় না, আমার স্মৃতিপটে তার আবছায়া ছবি এখনও জেগে আছে। বিলাত থেকে ফিরে কিছুদিনের জন্যে ধর্মতলার এক বাড়িতে জগদীশচন্দ্র ছিলেন। সে বাড়ি সম্ভবত আনন্দমোহন বসুর ছিল। আমি তখন ন-বছরের শিশু, তবু কেন জানি না, পিতা আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই বন্ধুতে কী কথাবার্তা হয়েছিল তা বুঝতে পারা বা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি, এইটুকুই কেবল মনে পড়ে। জগদীশচন্দ্র উচ্ছ্বসিত ভাবে ইউরোপ-ভ্রমণের কাহিনী অনর্গল বলে যাচ্ছেন আর আমার পিতা সাগ্রহে তা শুনছেন এবং মাঝে মাঝে দুজনে মিলে খুব হেসে উঠছেন। গল্প বোধ হয় আরও অনেকক্ষণ চলত, আমার দিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়াতে আমার পরিশ্রান্ত মুখের ভাব দেখেই হয়তো পিতা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বন্ধুর কাছ থেকে সেদিনের মত বিদায় নিলেন।

এই সময়ে পিতার উপর জমিদারি দেখার ভার ছিল। তাঁকে প্রায়ই শিলাইদহে যেতে হত। শীতের সময় তিনি পদ্মানদীর বালির চরের ধারে বোট বেঁধে বাস করতেন। তখন তিনি প্রথমে সাধনার পরে ভারতীর সম্পাদনা করছেন। প্রতি মাসেই গল্প বা প্রবন্ধ লিখতে হচ্ছে। পদ্মার দিগন্তব্যাপী বালির চরে খুব নিভৃত কোনো স্থানে বোট বাঁধা থাকত। লোকজন সেখানে যেতে পারত না। গল্পের পর গল্প লিখে গেছেন এই পরিবেশে। ছোটোগল্প লেখাতে উৎসাহ দিতেন। জগদীশচন্দ্র। প্রতি সপ্তাহের শেষে শনিবারে তিনি আসতেন। তাঁর জন্য আর-একটা বজরা সর্বদাই প্রস্তুত থাকত। দু রাত শিলাইদহে কাটিয়ে সোমবার কলেজের কাজে তিনি আবার কলকাতায় ফিরে যেতেন। আমার পিতার কাছে পৌঁছে প্রথমেই তাঁর দাবি জানাতেন— গল্প চাই। প্রতি সপ্তাহেই একটি করে নতুন গল্প তাঁকে পড়ে শোনানো যেন বাঁধাদস্তুর হয়ে গিয়েছিল। লেখা শেষ হলেই প্রথমে পড়ে শোনাতে হবে জগদীশচন্দ্রকে, তারপর ছাপতে যাবে। বন্ধুত্বের এই দাবি বন্ধুর পক্ষে অগ্রাহ্য করবার উপায় ছিল না।

আমার পিতা যখন শিলাইদহে বোটে থাকতে যেতেন আমাকে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আমার পিতা যেমন উদ্‌গ্রীব হয়ে জগদীশচন্দ্রের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন, আমারও তেমনি ঔৎসুক্য কম ছিল না। আমার সঙ্গে তিনি গল্প করতেন, নানারকম খেলা শেখাতেন, ছোট বলে আমাকে উপেক্ষা করতেন না। আমি তাঁর স্নেহপাত্র হতে পেরেছি তাতে আমার খুব অহংকার বোধ হত। আমি মনে মনে কল্পনা করতুম বড় হলে জগদীশচন্দ্রের মত বিজ্ঞানী হব।

বর্ষার পর নদীর জল নেমে গেলে বালির চরের উপর কচ্ছপ ওঠে ডিম পাড়তে। জগদীশচন্দ্র কচ্ছপের ডিম খেতে ভালোবাসতেন। আমাকে শিখিয়ে দিলেন কী করে ডিম খুঁজে বের করা যায়। শুকনো বালির উপর কচ্ছপের পায়ের দাগ বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, সেই সারবাঁধা পদচিহ্ন এঁকেবেঁকে বহুদূর পর্যন্ত চলে। গ্রীষ্মের রৌদ্রতাপ না পেলে ডিম ফোটে না; তাই কচ্ছপ নদী ছাড়িয়ে যতটা সম্ভব উঁচু ডাঙায় গিয়ে ডিম পেড়ে আসে। বালি সরিয়ে গর্তের মধ্যে ডিম পেড়ে আবার বালিগুলি সমান করে চাপা দিয়ে যায় যাতে শেয়ালে সন্ধান না পায়। এত চেষ্টা সত্ত্বেও ধূর্ত শেয়ালকে সম্পূর্ণ ফাঁকি দিতে পারে না। আমাকে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion