যুদ্ধ-সাহিত্যের রূপান্তর
গত মহাযুদ্ধের (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের) ঠিক পরবর্তী সাহিত্যের একটা বড় অংশই ছিল যুদ্ধ-সম্পর্কিত। বিষাদ, ক্ষোভ, জ্বালা ও বিদ্রোহ একটা প্রশ্নকে ঘিরে ফুলে ফুলে উঠছিল। গত মহাযুদ্ধের শ্মশানে বসে সাহিত্যিক প্রশ্ন করেছিলেন: মানুষের জীবন নিয়ে একি পরিহাস? একি রোগজীর্ণ সভ্যতা? মানুষের বিরুদ্ধে নিয়োজিত মানুষ। যে মানুষ প্রতিমুহূর্তে বিকশিত হচ্ছে, যার শত সহস্র অনুভূতি দারিদ্র্য ও অজ্ঞতার অন্ধকার হাতড়ে জ্যোতির্ময় ভবিষ্যতের আশায় বলছে, মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, একটামাত্র ইস্পাতের টুকরোর আঘাতে সে যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, আর উঠবে না, আর চোখ চাইবে না। না জানি কোথায় বসন্তকাল এসেছে, তার আয়োজনে আয়োজন ভরে গিয়েছে ধরাতল! মহাসমরের অব্যবহিত পরবর্তী সাহিত্যে এই জীবন তৃষ্ণার তাগিদের সামনে কোন দূরপ্রসারী চিন্তা দাঁড়াতে পারেনি। জীবনতৃষ্ণার সুরকারেরা জীবনের মর্যাদা দাবি করেছিলেন মাত্র। তখন প্রত্যেকটি গৃহকোণে যুদ্ধের ঘোলাটে ও পঙ্কিল বন্যাপ্রবাহ প্রবেশ করে তলা খেয়ে ফেলেছে। মানুষের মৃদু ও স্থূল সব কিছু অনুভূতি দলিত ও নিষ্পিষ্ট। পূর্বকালের মত একটা রক্তপাত, ধ্বংসস্তূপ উৎখাত, দুর্ভিক্ষ ও মৃতদেহপূর্ণ গভীর পথরেখা মাত্র না হয়ে, মহাযুদ্ধ সারা পৃথিবী ভরে মরণ ও ক্ষুধার জাল বিছিয়ে দিয়েছিল। সাহিত্যিক সহ্য করতে পারেননি। মানুষ কি বাঁচতেই চায় না? লক্ষ লক্ষ যুবাপুরুষের কাছে জীবনতৃষ্ণা মেটাবার আবেদন রইল এই সাহিত্যে, এই ধরনে।
কিন্তু আবার যুদ্ধ এগিয়ে আসতে লাগল। ওয়েল্স যে ইঙ্গিত করেছেন, উচ্ছৃঙ্খল যৌবনকে এর জন্য দায়ী করে, তা ঠিক নয়। ফ্যাসিস্টরা পৃথিবীকে নতুন করে ভাগ বাঁটোয়ারা করবার জন্য নিয়ে এল যুদ্ধকে। চাপা দেওয়া জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়ে ফ্যাসিস্টরা এগিয়ে চলল সোভিয়েত পুরীর দিকে। অস্ত্র কারখানার মালিকদের উদর-দেশ প্রসারিত হল তাদের চোখে দেখা গেল লালসার অবারিত শিখা। জীবন ভূষিত লেখকেরা হলেন নির্বাসিত, কারাগারে নিক্ষিপ্ত। ফ্যাসিস্টরা খোলা পেল পথ। যুদ্ধ খোলা পেল পথ।
যুদ্ধকে কি তাহলে আটকানো যাবে না? ফ্যাসিস্টরা যে বলছে, ‘চিরন্তন যুদ্ধেই পৃথিবী উর্বর থাকবে’, এই যুক্তির কাছে মাথা পেতে দিতে হবে? না, তা হতে পারে না। লেখকেরাই কাঁধে তুলে নিলেন রাইফেল। নিছক জীবন-তৃষ্ণার কাল নয় আর। এই হোক শেষ যুদ্ধ। ফ্যাসিস্টদের ধ্বংস করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের বেদী ধূলিকণায় মিশে যাবে। ...পৃথিবীতে ফ্যাসিস্টরা জয়ী হলে, প্রতি ধূলিকণা হবে অশ্রুসিক্ত, রক্তরঞ্জিত, ক্রীতদাসের স্বেদে জড়িত। জীবন হয়ে পড়বে চিরন্তন প্রহসন।
জীবনের মর্যাদারক্ষার জন্য এই বলিষ্ঠ ও কার্যকরী প্রয়াসের মধ্য থেকেই এল যুদ্ধ সাহিত্যের রূপান্তর। স্পেন ও চীনের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এই সাহিত্যধারা প্রবলবেগে উৎসারিত হল। যুদ্ধকে চিরকালের জন্য নির্বাসিত করার উদ্দেশ্যে, যুদ্ধের ভিত্তিকে ধ্বংস করার আবাহন ঘোষিত হল। অবশ্য এই আবাহনের সূত্রপাত হয়েছিল বহু পূর্বেই সোভিয়েত সাহিত্যে এবং সোভিয়েতের বাইরে দুই একটি গ্রন্থে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ছায়ায় এই ধারা ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে।
অবশ্য সাহিত্যে সাময়িকভাবে পরাজিত হল। পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিস্টবিরোধী সংগ্রাম তখনই গড়ে উঠল না। পুরাতন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রে নবীন সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্টরা বাধাহীনভাবে অগ্রসর হয়ে গেল। তোষণনীতির পরিণতি হল মিউনিক চুক্তিতে। তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিস্টদের ফ্যাসিস্টবিরোধী ও শান্তিকামী জনব্যূহে আনল ভাঙন। সাহিত্য স্তব্ধ।
তারপর এল যুদ্ধ। কিন্তু এল সেই যুদ্ধ, যাতে কোন পক্ষকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করার কোন যুক্তি রূপান্তরিত সাহিত্য খুঁজে পেল না। মার্কিন লেখক থিওডোর ড্রাইভার এই যুদ্ধকে মর্যাদা দিতে অস্বীকার করলেন। এই মহাসমর এল সাম্রাজ্যবাদীরূপে। দেখা গেল, এই যুদ্ধের সাফল্য যারই হোক, এর লাভ লোকসানের হিসাব নিকাশে আরও বহু যুদ্ধের বীজ থাকবে! রূপান্তরিত সাহিত্যে মহত্তর যুদ্ধের যে ছবি ছিল, তার সঙ্গে এর কোন মিল পাওয়া গেল না। অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী নাৎসী-ফ্যাসিস্ট হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাসিস্ট-বিরোধী যুদ্ধ-সাহিত্য ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে কোনরূপ একাত্মতা অনুভব করল না। তার দৃষ্টি গেল ভিন্ন দিকে। যে যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী বিরোধ, শোষণ ও ক্ষুধাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই শুরু হল, তার কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করাই হল সাহিত্যের কর্তব্য।
কিন্তু মোড় ঘুরে গেল ১৯৪১ সালের জুন মাসে। ফ্যাসিস্টরা সোভিয়েত রুশকে আক্রমণ করে বসল। সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধ প্রকৃত ফ্যাসিস্টবিরোধী যুদ্ধে পরিণত হলো। সোভিয়েত রাশিয়া পৃথিবীর জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণ করল সেই যুদ্ধে, যে যুদ্ধে ফ্যাসিস্টরা ধ্বংস হবার সঙ্গে সঙ্গে চিরদিনের জন্য নিভিয়ে দেওয়া হবে জীবন-দাহী অগ্নিশিখাগুলিকে।...
১৯৪২ সালের বসন্তদিনে সাহিত্য আবার ডাক দিচ্ছে। সোভিয়েত লেখক এলেক্সি টলষ্টয় ও শলোকভ লালফৌজের মাঝখানে মিশে গিয়েছেন। প্রাণসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ রূপকারেরা আজ সোভিয়েত, চীন ও জগতের প্রতি প্রান্ত থেকে জীবনের বলিষ্ঠ আহ্বান বাণী শোনাচ্ছেন। ফ্যাসিস্টদের ধ্বংস করো। এই মুহূর্তে তোমার, আমার, সকলের এ ছাড়া আর অন্য কোন কাজ নেই। ফ্যাসিস্ট জঙ্গীবাদীদের ধ্বংস করো। উঠে দাঁড়াও, আগে চলো।
‘প্রতিরোধ’ পত্রিকার ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত।
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment