‘ভীষণ দাঙ্গা’— বিগত রবিবার রাত্রি অনুমান ৯ ঘটিকার সময় স্থানীয় নবাবপুর পুলের উত্তর পারবর্তী মসজিদের নিকটে হিন্দু ও মুসলমানদিগের মধ্যে ভীষণ দাঙ্গা হইয়া গিয়াছে। সহোদরসম উভয় জাতির মধ্যে কেন পুনরায় এই বৈরিভাব সঞ্চারিত হইয়াছে, তাহার প্রকৃত কারণ আজিও আমরা জানিতে পারি নাই। বঙ্গ বিভাগের আন্দোলনকালে ঢাকার যে হিন্দু মুসলমানকে এক মাতৃগর্ভজাত সন্তানের ন্যায় গলাগলি ধরিয়া কাঁদিতে দেখিয়াছি, আজ সহসা কেন তাহাদের মধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হইল, ইহা বস্তুতই বিশেষ ভাবনার বিষয়। যাহা হউক, ঘটনার বিবরণ যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে নিম্নে তাহা সংক্ষেপে বিবৃত হইল। রবিবার সন্ধ্যার পরে শ্রীশ্রী রক্ষাকালীর ভাসান উপলক্ষে শাঁখারি বাজার হইতে সংকীর্তনাদিসহ দেবীমূর্তি বাহির করা হইয়াছিল সংকীর্তনদল নবাবপুর পুলের নিকটে উপস্থিত হইলে, মসজিদস্থিত মুসলমানগণ নাকি তাহাদিগকে প্রথম গান বাদ্যাদি বন্ধ করিয়া মসজিদের নিকটবর্তী স্থান অতিক্রম করিয়া যাইতে অনুরোধ করে। সংকীর্তনের গোলযোগে মুসলমানদিগের নিষেধ শুনিতে না পাইয়াই হউক, বা স্বেচ্ছা প্রণোদিত হইয়াই হউক, সংকীর্তনদল গান বাদ্যাদি বন্ধ না করিয়া ক্রমে নবাবপুরের দিকে চলিয়া যায়। এইরূপে কয়েকদল সংকীর্তন চলিয়া গেছে, সর্বশেষে দেবীমূর্তিবাহী সম্প্রদায় বাদ্যোদ্যমসহ মসজিদ সমীপে উপস্থিত হইল। দৈব দোষে এখানে গোলযোগের সূত্রপাত। মুসলমানদিগের উক্তিতে প্রকাশ তাহাবা নাকি ইহাদিগকেও বাদ্যোদমাদি গোলযোগ করিতে নিষেধ করিয়াছিল। হিন্দুগণ ঐ কথায় উপেক্ষা প্রদর্শনপূর্বক গোলযোগ করিয়া মুসলমানদিগের সমাজে বাঁধা দেওয়াতে এই দাঙ্গা সংঘটিত হইয়াছে। এদিকে হিন্দুগণ বলিতেছে, “মুসলমানেরা তাহাদিগকে ঐরূপ কোন নিষেধাদি করে নাই। দেবীমূর্তির সঙ্গে মশাল হস্তে কয়েক জন বৃদ্ধ ও কতকগুলি বালক ব্যতীত আর কেহই ছিল না। সুতরাং মুসলমানদিগের নিষেধ অমান্য করিয়া ইহারা গোলযোগ করিবে তাহার সম্ভাবনা কোথায়? দেবী মূর্তিবাহী সম্প্রদায় মসজিদ সমীপে উপস্থিত হইলেই মুসলমানগণ বংশ দণ্ডাদিসহ তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়াছে। কোন পক্ষের উক্তি সত্য, বিধাতাই বলিতে পারেন। ফলে হিন্দুপক্ষের ৭/৮ টি লোক গুরুতররূপে আহত হইয়াছে। যাহা হউক শুনিতেছি, গোলযোগের মূল কারণ সন্ধান করিবার জন্য স্থানীয় পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেব তদন্তভার গ্রহণ করিয়াছেন। ভরসা করি অনুসন্ধানে প্রকৃত তত্ত্ব উদ্ঘটিত হইবে। লোকমুখে প্রকাশ, এই দাঙ্গার গোলযোগ দেবীমূর্তির শরীরস্থিত স্বর্ণ নির্মিত দুইগাছি অনন্ত ও একছড়া দড়িয়া হার নাকি পাওয়া যাইতেছে না। অনুসন্ধান ফলে, সময়ে সকল সন্ধানই জানা যাইবে। উপসংহারে আমাদের বক্তব্য এই যে, এই গোলযোগের ফলে যাহাতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পুনরায় বিদ্বেষবহ্নি প্রজ্জ্বলিত হইয়া না ওঠে, তজ্জন্য সমাজহিতৈষী ব্যক্তি মাত্রেরই চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য। এই গোলযোগ আপোষে

মিটিয়া যাইতে পারে কিনা, তজ্জন্য একবার সাধ্যানুরূপ যত্ন করিবার জন্য আমরা হিন্দু ও মুসলমান সমাজের অগ্রণীদিগকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতেছি।

ঢাকা প্রকাশ, ২০ নভেম্বর ১৯০৪

এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটির আপোষে মীমাংসা হতে সময় লাগেনি। তখনকার সমাজে আজকের মত এমন বিষদৃশ মলিন মানসিকতার উন্মেষ ঘটেনি। ভ্রাতৃত্ব বোধ মমত্ব, প্রীতি বোধ, সহমর্মিতা বোধ ছিল প্রবল। যা ক্ষণিকের উন্মাদনাকে দ্রুত প্রশমনে ছিল সক্ষম।

"নবাবপুর পুলের পর পারবর্তী মসজিদের সম্মুখে গত পূর্ব রবিবার হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যে সংঘর্ষ হইয়াছিল, যথাসময়ে তাহা পাঠকবর্গের গোচরীভূত হইয়াছে। উভয় পক্ষের অবিবেচনার ফলে যে শোচনীয় ব্যাপার সংঘটিত হইয়াছে কল্পনা কালিমা দ্বারা তাহার বিষময় চিত্র অঙ্কিত না করিয়া সহজে যাহাতে তাহা বিস্মৃতি সলিলে বিসর্জন দেওয়া যাইতে পারে, তজ্জন্য যথোচিত যত্নকরা সমাজহিতৈষী মাত্রেরই একমাত্র কর্তব্য মনে করিয়া আমরা বিগত সপ্তাহে তৎপ্রতি সমাজপতিগণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণে যত্নবান হইয়াছিলাম। ঢাকাতে যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে স্মরণাতীত কাল হইতে সৌহার্দ্য সংস্থাপিত হইয়াছে, ক্ষণিকের অবিমৃষ্যকারিতা দেখিয়া সে প্রীতিবন্ধন বিচ্ছিন্ন করিতে অগ্রসর হইবে, ঢাকাতে এমন কুলকুঠার কেহ আছে কি না, জানি না। হইতে পারে, উভয় পক্ষেরই দোষ ছিল, অথবা এক পক্ষে দোষের মাত্রা অধিক, কিন্তু ক্ষণিক উত্তেজনার বিষময় ফল লইয়া ভ্রাতায় ভ্রাতায় চির শত্রুতার সৃষ্টি করা কখনই বুদ্ধিমানের কর্তব্য নহে। ঢাকার মঙ্গলকামিগণ শুনিয়া অবশ্য সুখি হইবেন, আমাদের সহৃদয় ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ র‍্যাঙ্কি মহোদয়ের প্রযত্নে এই অশুভ ব্যাপার সহজেই মিটিয়া গিয়াছে। সুযোগ্য ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয় বিগত গুরুবার, উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গকে গোলযোগ মীমাংসার নিমিত্ত স্বগৃহে আহ্বান করিয়াছিলেন। তাঁহারই প্ররোচনায় মাননায় খাঁন বাহাদুর শ্রীযুক্ত মৌলবী মহম্মদ ইয়ুসুফ মহোদয় মুসলমানদিগের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করাতে, এবং ভবিষ্যতে যেন এরূপ গোলযোগ না ঘটিতে পারে তাহার সমুচিত প্রতিবিধনে অবলম্বিত হইবে এরূপ আশ্বাস প্রদান করায়, উভয় জাতির মধ্যে পূর্ব সৌহার্দ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সর্বসম্মতিক্রমে ইহাও স্থিরীকৃত হইয়াছে যে, অতঃপর কোন মিছিল প্রভৃতি, উপাসনার সময়, কোনও ভজনালয়ের উভয়দিকে ৫০ হাতের মধ্যে কোন প্রকার গোলমালের কার্য করিতে পারিবে না। উপসংহারে ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয় বলিয়াছেন যে, তিনি প্রত্যেক মহল্লার পঞ্চায়েত দিগকে ডাকাইয়া ভবিষ্যতের সম্বন্ধে বিশেষ রূপে সতর্ক করিয়া দিবেন। মহানুভব ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ র‍্যাঙ্কিন মহোদয় এই শুভঙ্কর কার্যে, হস্তক্ষেপ করিয়া তিনি যে ঢাকাবাসীর অকৃত্রিম শ্রদ্ধ এবং আন্তরিক অনুরাগ লাভের সর্বাংশে উপযুক্ত তাহারই পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। ভগবৎ কৃপায় এই পরিহিতব্রত পুরুষপ্রবর দীর্ঘকাল ঢাকা অবস্থান করিয়া ঢাকাবাসীর কল্যাণ সাধনে নিরত থাকুন, ইহাই প্রার্থনীয়।

ঢাকা প্রকাশ, ২৭ নভেম্বর ১৯০৪

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion