যে ধর্ম স্বয়ং ভগবানের উপদিষ্ট; যাহা পরম যোগীগণের শত সহস্র বর্ষব্যাপী কঠোর তপস্যার ফল; যাহার জন্য সাম্রাজ্যাধিপতিগণও অনায়াসে বিষয় ভোগ তুচ্ছ করিয়া গভীর অরণ্যে প্রবেশপূর্বক গলিত পত্রাদি ভক্ষণ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করা শ্রেয়োবোধ করিতেন; যে সারবান্ ধর্মকে বিনাশ জন্য কত শত দৈত্য রাক্ষস সমুদ্যত হইয়াও কিছু করিতে পারে নাই; যাহা অনন্তকাল হইলে অনন্ত লোকের সদগতির একমাত্র নিদান স্বরূপে বিরাজমান, সর্বজ্ঞ মহর্ষিদিগের ভষ্যিবাদিতা সাফল্য করিবার জন্যই যেন এই কলিকালে সেই ধর্মে লোক সমূহ আস্থাহীন হইয়া নানা অসৎপথে বিচরণ করিতেছে। মহাকাল পুরুষ মহাপ্রলয়ের হেতুভূত পাপরাশি সঞ্চিত করিবার জন্য জীবসমূহকে নিয়তই পাপের দিকে নানা প্রলোভন দ্বারা টানিতেছে, তাহারই কৌশলে সামান্য বুদ্ধি আধুনিক মানবের আপাত মনোমুগ্ধকর মত সমূহদ্বারা ভ্রান্ত মান সমূহ পারলৌকিক বহু কষ্টের নিদান অসৎপথের পন্থী হইতেছে, জন্ম জন্মান্তরীণ অশেষ কল্যাণের হেতুভূত হিন্দুর অবিনশ্বর ধর্ম দুর্ভাগ্য মানবদিগকে অল্পে অল্পে পরিত্যাগ করিতেছে; ধর্ম সম্বন্ধে শোচনীয় দশা উপস্থিত। এই কঠিন সময়ে ধর্মরক্ষার উপায় না করিলে কেবল যে ভবিষ্যৎ বংশের অপকার হইবে, তাহা নহে; যদি ইহজন্মের পুণ্যবলে পুনরায় মানব জন্ম লাভের আশা কাহারও থাকে, তবে সঙ্গে সঙ্গে পরজন্মে তাঁহারও বাধ্য হইয়াই অসধর্ম গ্রহণ দ্বারা অসংগতি লাভ করিতে হইবে। অতএব যাহাতে এ ধর্ম রক্ষা পায়, তাহার উপায় করা বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্য।

বলা বাহুল্য যে, সুদপদেষ্টবর্গের শাস্ত্রার্থ প্রচার ও ধর্মবিষয়ক আলোচনা ধর্মজ্ঞান লাভের পক্ষে একান্ত আবশ্যক। সুদপদেষ্টার পরিমাণ অতি অল্প, প্রত্যেক গৃহে গিয়া ধর্মোপদেশ প্রদান তাঁহাদের পক্ষে সহজ নহে, অতএব সর্বসাধারণের জন্য এক একটি নির্দিষ্ট স্থান হওয়া আবশ্যক। কিন্তু নিতান্ত পরিতাপের বিষয় পূর্ববঙ্গের রাজধানী এই ঢাকানগরীতে এমন একটি স্থান নাই, যাহা ঐ উদ্দেশ্য সাধন পক্ষে সাধারণের সুবিধাজনক। কোন সাধু মহাপুরুষ আগমন করিলে, তাঁহারও আতিথ্য সৎকারের একটি সর্বজনপরিচিত স্থান হয় না। বারোয়ারীর দেবাৰ্চনা মহোৎসবাদি করিতে হইলে স্থানাভাবেই তাহা ঘটেন। অবশ্য ঢাকাতে এমন শত শত মহৎ ব্যক্তি আছেন, যাঁহারা ঐ সমস্ত কার্য নির্বাহোপযুক্ত স্থান দিতে পারেন ও দিয়া থাকেন; কিন্তু সেরূপ ব্যক্তিগত অনুগ্রহের প্রার্থনায় সাধারণ ভদ্রলোকদিগের কাজ করিতে প্রবৃত্ত হয় না। আর একটি গুরুতর অসুবিধা। মোকদ্দমাদি নানা কারণে অনেককে ঢাকায় আসিতে হয়, কিন্তু অনেককেই স্থানাভাবে নিতান্ত কষ্ট পাইতে হয়। অতিথি অভ্যাগতের (সেবা) হিন্দুর অন্যতম কর্তব্য। সাধ্যানুসারে তাহা না করিলে পাপ আছে। কিন্তু ঢাকাবাসী এই পাপে চিরকাক্ষিত। পূর্ববঙ্গের শীর্ষস্থান ঢাকার এ কলঙ্কে পূর্ববঙ্গবাসী মাত্রেই সম্পর্কিত এবং সময় সময় অসুবিধাগ্রস্ত। এই সকল কলঙ্ক, অসুবিধা ও ধর্ম কার্যের অন্তরায় সমূহ নিরাকরণ জন্য ঢাকায় একটি ধর্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করা স্থির হইয়াছে। এই মহৎকার্যে ঢাকার অধিকাংশ গণ্যমান্য লোক সমুৎসাহী হইয়াছেন। সত্বরেই অনুষ্ঠান পত্রপ্রচার হইবে। তাহাতেই পাঠক দেখিবেন যাঁহারা একার্যে ব্রতী, তাঁহাদের পদ মর্যাদা এই কার্য সম্পাদনের বিশেষ অনুকূল। এই কার্যে প্রায় পঁচিশ সহস্র টাকার প্রয়োজন। শুনিতে যদিও অধিক বোধহয়, তথাপি ইহা হিন্দুসমাজের পক্ষে অতি সামান্য। পূর্ববঙ্গেই এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁহাদের একজন ইচ্ছা করিলে এ অশেষ পুণ্যের নিদান অসাধারণ প্রতিষ্ঠার কার্যে সমস্ত ব্যয় প্রদান করিতে সমর্থ। কিন্তু যে পর্যন্ত তেমন কোন মহাত্মা আমাদিগের আশা ফলবতী না করিতেছেন, ততকাল হিন্দুমাত্রকেই আমরা অনুরোধ করিতেছি, যাহাতে এই কার্য সুসম্পন্ন হয়, তৎপক্ষে সকলেই মনে প্রাণে যত্নবান হউক।

ঢাকা প্রকাশ, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯১

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion