ড. আবদুল করিম মোঘল আমলে ঢাকার বাণিজ্য প্রসার লিখেছেন: “নদীপথে চারিদিকের সকল অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত একটি কেন্দ্র হিসাবে ঢাকার অবস্থান সমগ্র দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। এই শহরের প্রসার এবং এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি শহরে জনগণের চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন দ্রব্য সরবরাহ এবং বাণিজ্যিক এলাকা ও হাটবাজারের উন্নয়ন অপরিহার্য করে তোলে। যেকোন শহরের প্রসারের কারণে শহরে কারিগর, পণ্য প্রস্তুতকারক, শিল্পী ও বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর বসতি স্থাপন জরুরি হয়ে পড়ে যাতে তারা এখানে অবস্থা করে কাঁচামাল ক্রয় এবং তৈরি মালামাল বিক্রয় করতে পারে। ঢাকা মোগল প্রদেশ বাংলার রাজধানী এবং সামরিক ও বেসামরিক সদর দফতরে পরিণত হয়। বণিক ব্যবসায়ীগণ সরকার থেকে পরোয়ানা ও লাইসেন্স গ্রহণ করার জন্য এবং কর সুবিধা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক সুযোগ লাভ করার জন্য অথবা শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের শোষণ এবং অন্যান্য অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করার জন্য এখানে আগমন করত। কিন্তু বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকার বিকাশের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে মোগল সরকার কর্তৃক ঢাকায় শহিবন্দর প্রতিষ্ঠা। এই বন্দর থেকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করে এবং ব্যবসায়ীদের জন্য 'পরোয়ানা' (পাশ বা পারমিট) ইস্যু করে সকল ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা হত। এই বন্দরের মাধ্যমে সকল ব্যবসায়ী বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সমূহের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করত। (মোগল রাজধানী ঢাকা। পৃ. ৫৫)

সর্বভারতীয় বাণিজ্য ক্ষেত্রে ঢাকার এই ভূমিকা বদলে যায় ইংরেজ আমলে। কোম্পানি শাসনের প্রথম যুগে ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদ। তারপর কলকাতায়। কলকাতা পূর্ব এশিয়ায় ইংরেজ স্বার্থরক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। রাজধানী শহর কলকাতা ছিল অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। আর এই বাণিজ্য কেন্দ্রের অন্যতম সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তৎকালীন ঢাকা। সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে পড়ে কলকাতা ভিত্তিক। স্থল ও নদীপথে পণ্য সরবরাহের জন্য কলকাতার সঙ্গে কেবলমাত্র ঢাকা নয়, পূর্ববাংলার প্রায় সমস্ত ব্যবসা কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার ব্যবসাবাণিজ্য নদীভিত্তিক হওয়ায়, প্রায় সব কেন্দ্রগুলিই ছিল নদীতীরে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ছাড়া অন্যান্য ব্যবসা কেন্দ্রগুলির কোন সুবিন্যস্ত রূপ ছিল না। কোন ঐশ্বর্যের ছাপ ছিল না তার গায়ে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা হত সেখান থেকে।

বলা যেতে পারে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ কেবলমাত্র ব্যবসাবাণিজ্যই নয়, পূর্ব বাংলার সার্বিক জীবনধারার সনাতন স্বরূপকে আমূল বদলে দিয়ে যায়। ইংরেজ আমলের দ্বিতীয় নারী পরিণত হল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে। প্রশাসনিক গুরুত্ব বেড়ে গেলেও প্রথম পর্বে কলকাতার সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ হয়ে গেল। জলপথে স্টিমার ও মহাজনী নৌকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গেল একেবারে হারিয়ে। প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কারণে খুব দ্রুত আভ্যন্তরীণ সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। মেঘনা, ভৈরব নদীর ওপর ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত সেতুপথটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি ছিল দীর্ঘ পথ। যা সময়কে সংক্ষেপ করার অপেক্ষা দীর্ঘায়ত করত। সড়ক পথের ছবিটা দ্রুত বদলাতে থাকে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ মাত্র দু ঘণ্টায় পৌঁছান যায়, অথবা চট্টগ্রাম যে ঢাকার এত কাছাকাছি এসে যাবে তা কারো কল্পনায়ই ছিল না। নদীরেখার ওপর অজস্র সেতু নির্মিত হওয়ায়, সড়কপথে যোগাযোগকে সহজসাধ্য -র তোলা হয়েছে।

দেশভাগের পর ঢাকার সম্ভবপর শিল্পবিকাশ ত্বরান্বিত না হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, পাকিস্তান সরকারের নীতি। ইংরেজ আমলের মতই পাকিস্তানী শাসকরা পূর্ববাংলাকে তাদের শোষণ কেন্দ্র হিসাবেই দেখত। এর মধ্যে কিছু কিছু শিল্প বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। অবশ্য ব্যবসা ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে চট্টগ্রামের গুরুত্ব ঢাকা থেকে অনেক বেশি। ইদানিং গুরুত্ব বেড়েছে খুলনারও। ১৯৪৭ সালের আগে নারায়ণগঞ্জ ছিল ছোট পরিচ্ছন্ন শহর এবং পাটশিল্পের অন্যতম কেন্দ্র। দেশভাগের পর গড়ে ওঠে আদমজী জুট মিল, অন্যান্য জুট মিল। ঢাকেশ্বরী-চিত্তরঞ্জন- লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল—তিনটি বস্ত্রকল ছিল আগে থেকেই। বর্তমানে বাংলাদেশের হোসিয়ারি শিল্পকেন্দ্র হল নারায়ণগঞ্জ। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক বরাবর যেসব কলকারখানা গড়ে উঠেছে তার অন্যতম হল টেনারি শিল্প। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ লেদার টেকনোলজি এখানেই অবস্থিত। পটারি শিল্প, গ্লাস ফ্যাক্টরি এসব সাম্প্রতিককালের বিকাশ। তেজগাঁও পরিণত হয়েছে শিল্পনগরীতে।

“ঢাকা পশুর চামড়া ব্যবসারও একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বলে পরিচিত। একজন চামড়া ব্যবসায়ীর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে ৪২ লক্ষ রুপির চামড়া ঢাকা জেলা থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়। তারা প্রথমত এই চামড়া কলকাতায় পাঠায় এবং সেখান থেকে বিদেশে পাঠান হয়। গরুর চামড়া সাধারণত উপমহাদেশে, ষাঁড়ের চামড়া তুরস্কে, এবং ছাগলের চামড়া আমেরিকায় পাঠান হত। একটি টেনারি ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। স্বাধীনতা পর্যন্ত এই শিল্পে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। কলকাতা টেনারি কলেজের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজন ছাত্র টেনারি স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু কেউ সার্থকতা লাভ করতে পারেনি। দেশ বিভাগের পর টেনারি শিল্প যেন নতুন লক্ষ্য খুঁজে পেল এবং ঢাকা শহরের হাজারিবাগে কিছু সংখ্যক টেনারি গড়ে ওঠে। বর্তমানে ঢাকার ৮৭টি টেনারি আছে।” (ঢাকা জেলা গেজেটিয়ার ১৯৯৩। পৃ. ৪৪৭)

জেলা গেজেটিয়ারে সম্প্রতিকালে গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি শিল্প ও বাণিজ্য এলাকার উল্লেখ আছে। মতিঝিল দিলকুশ এলাকা থেকে রাজাবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ ও কমলাপুর পর্যন্ত বাণিজ্যিক এলাকা হিসাবে বিকাশ লাভ করেছে। এর মধ্যে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে উঠেছে আশরাফ কটন মিল, মুন্নু গ্রুপ অফ টেক্সটাইলস, মেঘনা কটন মিল, অলিম্পিক কটন মিল এবং আরো কিছু কটন মিল। নবগঠিত ডেমরা শিল্প এলাকা হল ধামগড় ও গোদনাইলের বিপরীত দিকে। কালীগঞ্জে এখনও যে উন্নতমানের শাড়ি তৈরি হয় তার আন্তর্জাতিক বাজার ব্যাপকরূপ পেয়েছে। কুটির শিল্প শিল্প হিসাবে ঢাকার তাঁত শিল্পের যে ঐতিহ্য, যন্ত্রশিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তার চালচিত্র আজও অম্লান। যদিও অতীতের মত ঔজ্জল্য ততটা প্রকট নয়। ইমামগঞ্জে প্লাস্টিক ও রবার দ্রব্যাদির কারখানার বিকাশও পরবর্তীকালের। টঙ্গিতে আছে সিগারেট কারখানা। এদের শাখা আছে তেজগাঁও-এ। বাংলাদেশের সবথেকে বড় জুতা কোম্পানি হল বাটা সু কোম্পানি। শহরে পরিবহন উপযোগী তেল সরবরাহ করে বার্মা অয়েল, ক্যালটেক্স ও ইন্দো-বার্মা পেট্রোলিয়াম ।

আধুনিক দৈনন্দিন প্রয়োজন উপযোগী দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পরিমাণেই স্বনির্ভর। ছোটখাট কয়েকটি উৎপাদনের অন্যতম হল : মোটর গাড়ি ও সাইকেলের টায়ার টিউব, সুতিবস্ত্র, কার্পেট, মশলাপাতি, জুতো, প্রসাধন সামগ্রী, হিমায়িত মাছ, টিনে সংরক্ষিত তরিতরকারি, গ্যাস, ম্যানথেল, ধাতব পাত্র, চায়ের পেয়ালা, কাঠের ও বেতের আসবাবপত্র, গরুর শিং, কাপড়, বিছানা, কীটনাশক ওষুধ, দেয়াশলাই, কাচের শিট, কাচের চুড়ি, খাদ্য থলি, ওষুধপত্র, প্লাস্টিকের বিবিধ দ্রব্য, গায়ে মাখার সাবান, সেফটিপিন, গুড়, পেয়ালা, চশমার ফ্রেম, ছাতা, মাদুর, শিতলপাটি, মোমবাতি এরকম আরো বহু দ্রব্যের উল্লেখ করা যেতে পারে, যা বাংলাদেশকে এখন আর আমদানি করতে হয় না।

আমরা মাত্র আড়াইশ বছর পিছিয়ে গেলে অন্য একটা ছবিকে উপলব্ধি করি। তখন কুটির শিল্প নির্ভর বাংলার অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল ঢাকা। নদীপথে সংযুক্ত ছিল বিভিন্ন জনবসতির সঙ্গে। সেখান থেকে দ্রব্যাদি এসে পৌঁছাত ঢাকায় আমদানি ও রপ্তানির লক্ষ্যে। প্রায় সব জেলা থেকে জিনিসপত্র আসত। চট্টগ্রাম, বাকরগঞ্জ, সিলেট ও ময়মনসিংহ থেকে আসত কাঠ ; বৃহৎ চাউল সরবরাহকারী ছিল বাকরগঞ্জ : ফরিদপুর, নোয়াখালি, বাকরগঞ্জ ও যশোহর থেকে আসত গুড়, ত্রিপুরা ও নোয়াখালির কার্পাস, রংপুর থেকে তামাক - এরকম অজস্র দ্রব্যাদি আসত ঢাকার বাজারে। ঢাকার বাজারে এসব ছাড়া যেসব জিনিস মিলত তার অন্যতম কয়েকটি হল নানাবিধ সুতিবস্ত্র, সোনা রূপার অলঙ্কার, কাঠের আসবাবপত্র, হাতির দাঁত, চটের থলি, পানসুপারি, চাউল, তুলা, সুতো, খেসারি, মুগ, মুসুর, কলাই, মটর, বুট, সরিষা, আদা, মরিচ, ঘি, লবণ,

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion