পুরনো রাজবাড়িতে
শান্তনুদের বাড়ি থেকে বেরুতেই গরম বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল রাহুলের চোখেমুখে। রোদে ঝাঁ-ঝাঁ করছে চারদিক।
ক'বছর ধরে কলকাতার আবহাওয়া ভীষণ বদলে যাচ্ছে। গরম পড়তে না পড়তেই এখন লু বইতে থাকে। দিনের তাপ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত চড়ে যায়। খবরের কাগজে এ নিয়ে আজকাল প্রায়ই লেখালেখি হচ্ছে। ঝোপঝাড় গাছপালা কেটে, পুকুর আর জলা জায়গা বুজিয়ে যেভাবে বিরাট বিরাট উঁচু বাড়ি উঠছে, তার ফলেই নাকি গরমটা হঠাৎ এত বেড়ে গেছে। আর কিছুদিন এভাবে চললে, মরুভূমির ক্লাইমেটের সঙ্গে কলকাতার আবহাওয়ার তফাত থাকবে না ।
সাউথ ক্যালকাটার এই পাড়ার নাম কেয়াতলা। এমনিতে জায়গাটা ভারি শান্ত আর নিরিবিলি। কিন্তু এখন, মে মাসের এই ভরদুপুরে রাস্তায় কোনও লোকজন নেই, চারপাশ একেবারে ফাঁকা। আগুনের মতো গনগনে রোদে কে আর বাইরে থাকবে।
রাহুল তের পেরিয়ে সবে চোদ্দয় পা দিয়েছে। একটা বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে, থাকে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে বিপিন পাল রোডে। ওর বাবা একজন পুলিশ অফিসার, মা একটা হায়ার সেকেণ্ডারি গার্লস স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেডমিট্রেস। মা-বাবার সে একমাত্র ছেলে, তার কোনও ভাইবোন নেই ।
শান্তনু রাহুলের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, তারা এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে ৷ এই দুপুরবেলা ক'টা ক্যাসেট নেবার জন্য রাহুল কেয়াতলায় এসেছিল।
শান্তনুর বাবা একটা নাম-করা ইংলিশ ডেইলির স্পোর্টস এডিটর। সারা দেশের মানুষ যারা খেলাধূলো ভালবাসে তারা সবাই পরমেশ সান্যালকে চেনে। স্পোর্টস নিয়ে কাগজে তো নিয়মিত লেখেনই, ফুটবল বা ক্রিকেটের বড় বড় টুর্ণামেন্টের সময় রানিং কমেন্টারি বা ধারাবিবরণী দিয়ে থাকেন। বলেন চমৎকার, সেজন্য তাঁর ফ্যানও প্রচুর।
পরমেশ মেসোর বিরাট একটা লাইব্রেরি আছে।
স্পোর্টসের অসংখ্য বই, ম্যাগাজিন আর ক্যাসেটে সেটা ঠাসা। ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথালেটিকসের যত বড় বড় ইভেন্ট সারা পৃথিবী জুড়ে হয়েছে তার সমস্ত ক্যাসেট এখানে পাওয়া যাবে। আর আছে অগুনতি ফোটোর অ্যালবাম । কে নেই সেখানে? ক্রিকেটে হামও লারউড থেকে বথাম, ওরেল উইকস সোবার্স থেকে ব্রায়ান লারা, ব্রাডম্যান থেকে বুন, হ্যাডলি, মার্চেন্ট মানকড় থেকে রুদ গুলিট, মার্কো ভ্যান বাস্তেন পর্যন্ত সকলের ছবি যত্ন করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া আছে বুবকা, ক্রিস লুইস, ক্রিস্টিন অটো থেকে ম্যাজিক জনসন, জ্যাকি জয়নার পর্যন্ত সবাই।
রাহুল ফুটবল আর ক্রিকেটের পোকা। কে ক'টা সেঞ্চুরি করেছে, কে ওয়ার্ল্ড কাপে ক'টা গোল করেছে, কে দশ সেকেণ্ডের নিচে একশো মিটার দৌড়ে রেকর্ড করেছে, সব তার মুখস্থ। তাদের স্কুলের ফুটবল আর ক্রিকেট টিমে প্রথম এগারজনের মধ্যে তার জায়গাটা একেবারে পাকা। অবশ্য শান্তনুও থাকে ফার্স্ট ইলেভেনে।
পরমেশ খুবই পছন্দ করেন রাহুলকে। তিনি ঢালাও পারমিশান দিয়ে রেখেছেন, যখন ইচ্ছা যে-কোন ক্যাসেট বা বই সে নিয়ে যেতে পারে।
সাতদিন হল গরমের ছুটি পড়েছে। আর ছুটিটা পড়তে না পড়তেই শান্তনুরা দিল্লি চলে গেছে। সেখানে ওর ছোটকাকার কাছে থাকেন ওর ঠাকুমা। তিনি
হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবরটা আসতেই সবাইকে ছুটতে হয়েছে। কবে ওরা ফিরবে ঠিক নেই। কেয়াতলার বাড়িতে পড়ে আছে কাজের লোকেরা আর শান্তনুর বিধবা পিসি মণিমালা।
গরমের ছুটিটা কীভাবে কাটাবে, দুই বন্ধু আগে থেকে তার নানারকম প্ল্যান করে রেখেছিল, কিন্তু শান্তনুর ঠাকুমার অসুখ হওয়ায় সব গোলমাল হয়ে
গেল।
সময়, বিশেষ করে দুপুরটা এখন আর কাটতে চায় না রাহুলের। তাই সে ঠিক করেছিল, শেষ চারটে ওয়ার্ল্ড কাপের সেরা খেলাগুলো ক্যাসেট দেখে দেখে কাটিয়ে দেবে। সেজন্যই আজ তার কেয়াতলায় আসা ।
একটা পলিথিনের প্যাকেট পাঁচখানা ক্যাসেট পুরে নিয়ে সে যখন বেরুচ্ছে, মণিমালা পিসি বললেন, 'এই রোদের মধ্যে যেতে হবে না, এখানেই ভি সি আর চালিয়ে দেখে নে। বিকেলে বাড়ি যাস। '
রাহুল শোনেনি। বলেছে, 'এইটুকু তো রাস্তা। দশমিনিটের মধ্যে চলে যাব।' আসলে মাকে না জানিয়ে সে চলে এসেছিল। বেশি দেরি করলে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে। মা টের পাবার আগেই সে ফিরে যেতে চায়।
কেয়াতলার এই রাস্তাটা বাঁ দিকে একটা বাঁক ঘুরে সার্দান অ্যাভেনিউতে পড়েছে। সেখান থেকে কোনাকুনি রাস্তা পেরিয়ে ওধারে গেলে রামকৃষ্ণ মিশন অফ কালচারের বিশাল বাড়ি। ওখান থেকে দেশপ্রিয় পার্কে যাবার প্রচুর বাস পাওয়া যায়। রাহুল বড় বড় পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে চলল।
ঝাঁ-ঝাঁ রোদে রাস্তার পিচ গলে গেছে। আশেপাশে লোকজন তো নেই-ই, কাক বা কুকুর-টুকুরও চোখে পড়ছে না। যেদিকে যতদূর চোখ যায়, গাছপালা, বাড়িঘর, সব যেন ঝলসে যাচ্ছে।
বাঁকের মুখটায় আসতেই চোখে পড়ল ডান দিকের ফুটপাথ ঘেঁষে একটা সবুজ অ্যাম্বেসেডার দাঁড়িয়ে আছে। ছুরির ফলার মতো ঝকঝকে রোদে ভাল করে তাকানো যাচ্ছে না, তবু তার মনে হল, গাড়িটার ফ্রন্ট সিটে ড্রাইভার স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়ে বসে আছে।
অ্যাম্বেসেডর থেকে রাহুল যখন ফুট পাঁচেক দূরে, হঠাৎ রাস্তা ফুঁড়ে প্রায় ছ'ফিট হাইটের দুটো লোক দু'পাশ থেকে তার পথ আটকে দাঁড়াল। দু'জনেরই দারুণ মাসকুলার চেহারা। পরনে ট্রাউজার্স আর বুশশার্ট, পায়ে মোটা সোলের জুতো। একজনের মুখ পরিস্কার কামানো, আরেক জনের সরু শৌখিন গোঁফ
রয়েছে। কারো বয়সই সাতাশ-আটাশের বেশি নয়, দেখে মনে হয় ভাল ফ্যামিলির ছেলে।
মাথাটা দ্রুত একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে ঘুরিয়ে দু'জনকে দেখে নিল রাহুল। ওদের মতলব যে ভাল নয় সেটা মুহূর্তে টের পেয়ে গেছে সে। এই নির্জন দুপুরে এমন কেউ নেই যে তাকে ডাকতে পারে। অনেকটা দূরে সার্দান অ্যাভেনিউতে অবশ্য হুস হুস করে বাস বা প্রাইভেট কার ছুটে যাচ্ছে, লোকজনও কিছু দেখা যাচ্ছে কিন্তু এখান থেকে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেও ওরা শুনতে পাবে না। কাজেই মাথাটা এখন ঠাণ্ডা রাখতে হবে, এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র সার্দান অ্যাভেনিউর দিকে ছুট লাগাবে। সে তাদের স্কুলের একজন দুর্দান্ত স্প্রিন্টার, একশো মিটাব দৌড়ে আর দুশো মিটার হার্ডল রেসে ইন্টার- স্কুল চ্যাম্পিয়ান। সে একবার ছুট লাগালে এই লোক দুটো তাকে কোনভাবেই ধরতে পারবে না।
সরু গোঁফওলা লোকটা বোধহয় থট-রিডার, মুখ দেখে মনের কথা টের পায়। সে হেসে হেসে বলে, 'তুমি যে চ্যাম্পিয়ান স্প্রিন্টার তা আমরা জানি। দৌড়বার চেষ্টা করো না।”
দেখা যাচ্ছে তার সম্বন্ধে এরা অনেক খবর রাখে। রাহুল জিজ্ঞেস করে, কী চান আপনারা?
এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিল না। গোঁফ নেই লোকটা বলল, 'আমাদের তুমি বন্ধু মনে করতে পার। আমরা যা বলব সেইমতো যদি চল, কোনও ভয় নেই।' বলতে বলতে একটা ছোট রিভলবারের নল রাহুলের ডান কানের ওপর ঠেকায়। সঙ্গে সঙ্গে ওধার থেকে গোঁফওলা আরেকটা রিভলবার বার করে তার বাঁ কানের ওপর ছুইয়ে রাখে।
রাহুল বুঝতে পারছিল ওগুলো সত্যিকারের পিস্তল, খেলনা-টেলনা নয়। এমন ভয়ানক অবস্থাতেও সে কিন্তু ঘাবড়ে গেল না। বেশ মজা করেই বলে, ‘এটা কি বন্ধুর মতো কাজ হচ্ছে?'
গোঁফ-নেই বলে, “উপায় নেই। তোমাকে তো আমরা চিনি, যে কোন সময় ঝামেলায় ফেলে দিতে পার। তাই ও দুটো বার করতে হয়েছে।
গোঁফওলা বলে, “রিভলবার দুটোয় সাইলেন্সার লাগানো আছে। গুলি চালালে একটুও শব্দ হবে না। আশা করি, এ সব জানার পর তুমি গোলমাল- টোলমাল করবে না। শুধু শুধু রিস্ক নিয়ে কী লাভ? উই এক্সপেক্ট ইউ উড কো-অপারেট উইদ আস।'
লোক দুটো বেশ শিক্ষিত। যেভাবে ইংরেজি শব্দগুলো গোঁফওলা উচ্চারণ করল তাতে মনে হয় ইংলিশ মিডিয়ামে সে পড়াশোনা করেছে। রাহুল বলে, ‘অলরাইট, কো-অপারেট করব কিন্তু একটা কণ্ডিশান
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment