১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে কুমিল্লার এমএলএ এডভোকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পরিষদের ভাষা করার দাবি করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান জানান যে, পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলমানের ভাষা হচ্ছে উর্দু। তাই উর্দুই হবে রাষ্ট্র ভাষা। তাঁকে সমর্থন করেন পূর্ব পাকিস্তানে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন। লিয়াকত ও নাজিম উদ্দিনের গণপরিষদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করে। নাদেরা বেগম সে-সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যায়নরত। বড় দুইভাই কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী সে-সময় প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয়। পারিবারিক সূত্রেই ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ছাত্রদের মিছিল বের হলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে হামলা করে তা ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং অনেক ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে। নাদেরা বেগম মেডিকেল কলেজের ভেতরে ঢুকে পড়েন। পুলিশ তাঁর শাড়ির আঁচল ধরে থাকলেও নাদেরা বেগমকে ধরতে পারেনি। তাঁর নামে ওয়ারেন্ট বের হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান তারাবাগে বেগম সুফিয়া কামালের বাসায়। সেখানে তাঁর নাম দেয়া হয় 'জাহানারা বেগম জানু'। বাসায় অপরিচিত কেউ এলে সুফিয়া কামাল তাঁকে বোনের মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন এবং বাসার সবাইকে তিনি সে-ভাবেই বলে রাখেন। সুফিয়া কামালের বাসায় আত্মগোপনরত অবস্থায় মাসখানেক থাকার পর খবর পান সেখানে থাকা নিরাপদ নয়। যে-কোনো সময় পুলিশ হামলা চালাতে পারে বাড়িতে। সেখান থেকে তিনি চলে যান মদন মোহন বসাক লেনের ৪৯ নং বাড়িতে। সেই বাড়িতে পুলিশ হানা দেয় এবং তাঁকে গ্রেফতার করে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে দুই বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পরে রংপুর জেলখানায় রাখা হয়।

নাদেরা বেগম ১৯২৯ সালের ২ আগস্ট বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আব্দুল হালিম চৌধুরী ডেপুটি মেজিস্ট্রেট ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায়বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন। বাবা অত্যন্ত কড়া মেজাজের ছিলেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। তিনি স্ত্রীকে বাড়িতে পড়াতেন। টেনিস খেলা শেখাতেন। মা আফিয়া বেগম অত্যন্ত আটপৌরে ছিলেন। বাবার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল পরিবারে। চৌদ্দ ভাই-বোনের মধ্যে নাদেরা তৃতীয়। বাল্যকাল থেকেই বড় দুইভাই-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রগতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। তাঁদের পৈত্রিক নিবাস নোয়াখালী জেলার গোইরবাগ গ্রাম।

তিনি বাড়িতে বাবার কাছে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি নেন। প্রাইভেটে বরিশাল সদর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। মেধা তালিকায় তাঁর স্থান ছিল ষোলতম এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম। এরপর ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে। সেখান থেকে ১৯৪৬ সালে আই. এ পাস করেন মেধা তালিকায় একুশতম এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে। কলকাতায় পড়ার সময় তাঁর প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাদর্শের অনেক সহযোদ্ধার সাথে পরিচয় ঘটে। আই.এ পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাস করেন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন ঢাকায়। এখানে এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম. এ প্রথম পর্বে ভর্তি হন। সে-সময় বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে মায়ের প্রশ্রয়ে এবং ভাইদের সমর্থনে তদানীন্তন সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান শাসনামলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রীদের পক্ষে নেতৃত্বের দায়ে তাঁর নামে ওয়ারেন্ট বের হয় এবং তাঁকে গ্রেফতারের পর কারাবন্দি করা হয়। খালুর মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পারিবারিক তথ্যাদি, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী পেতেন। কারাগারে তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন প্রগতিশীল রাজনীতির আদর্শে অনুপ্রাণিত নিবেদিতা নাগ, রানু চট্টোপাধ্যায়, নিরুপমা গুপ্ত, কণা, ইরা, উষা ও কল্যাণীসহ আরো অনেকে। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তখন রাজবন্দিদের মর্যাদা এবং অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত কতোগুলো দাবির ভিত্তিতে চতুর্থবারের মতো অনশন শুরু হয়। রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদার দাবিতে একবছরে আরো তিনবার বন্দিরা অনশন করে কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী এই ন্যূনতম অধিকারটুকু মেনে নেয়নি। এই অনশনের ফলে সকল রাজনৈতিক বন্দির দাবি অংশত পূরণ করা হয়। কিন্তু বন্দিদের মধ্যে দু'টি গ্রেড সৃষ্টি করে বিভেদের বীজ পুঁতে রাখতে চায় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। রাজবন্দিদের দাবি ছিল ইউনিফর্ম স্ট্যাটাস। জেলের ভেতর এসব আন্দোলনে নাদেরা চৌধুরীর অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত জোরালো। সেজন্য তাকে কারাগারের ভেতরেও কঠোর নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হতে হয়। কারাগারে লাঠির আঘাতে রাধারানীর হাত ভেঙে যায়। সঙ্গীনের খোঁচায় নিবেদিতা নাগ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নাদেরাসহ তাঁর অন্যান্য সঙ্গীরা নানাভাবে নির্যাতিত হন। নেজাল ফিডিংয়ের পর তাঁদের সবাইকে খুব সরু দড়ি দিয়ে জানালার শিকের সঙ্গে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সেই অবস্থাতেই বমি করে ভাসিয়ে দেয় এক একজন। এভাবেই অত্যাচার চলে তাঁদের ওপর।

১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে ঊনষাট দিনের মাথায় তাঁরা অনশন ভাঙেন। অনশন ভাঙার পর অসুখ বিসুখের পালা শুরু হয়। এরই মধ্যে শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে বিচারের নামে প্রহসন।

জেলখানার ফটকের বারান্দায় কোর্ট বসিয়ে বিচার শুরু হয়। তাঁকে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখা হয়। হাকিম, উকিল, পেশকার, জেল কর্তৃপক্ষ, সাক্ষী সবাই সমবেত হয় বারান্দায়। তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়। সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আনা হয় এক স্কুল পরিচারিকাকে। সরকারি উকিল তার কাজ শুরু করেন। সঙ্গী রানু চট্টোপাধ্যায় সেই পরিচারিকাকে তাঁর পক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। 'আপনার অল্প আয়ে এতো বড় সংসার কীভাবে চলে? মাইনে বাড়লে আপনার কষ্ট কমে যেতো, আপনারই ভাল হতো। আর নাদিরা দিদিমনি তো সেই কথাই বলেছে আপনাকে।' জবাবে সেই স্কুল পরিচারিকা নাদেরা বেগমের গুণগান শুরু করেন। তিনি সাক্ষীর কথাগুলি হাকিমকে লিখে নেয়ার জন্য বলেন। অনড় হাকিম তাঁর রায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কন্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাদেরা বেগমকে তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কৌশলে তাঁকে স্থানান্তরিত করে সিকিউরিটি ওয়ার্ডে বন্দি করে রাখা হয়।

ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় রংপুর জেলে। রাজনৈতিক বন্দিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি হিসেবে রাখা হয় সেখানে। কেননা সেটি ছিল জঘন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

১৯৫০ সালে তিনি রংপুর জেল থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর ইনকাম ট্যাক্স অফিসার আব্দুল আজিজ ও ফাহিমা বেগমের বড়ছেলে খালাতো ভাই গোলাম কিবরিয়ার সাথে ১৯৫২ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁরা পূর্ব থেকেই পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। স্বামী গোলাম কিবরিয়া কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্নাতক পাস করেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সিএসপি অফিসার পদে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন এবং ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। স্বামীর কর্মসূত্রে তিনি বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেছেন। গোলাম কিবরিয়া বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

বিয়ের পর ময়মনসিংহে শ্বশুরের দেয়া বিবাহ উত্তর সংবর্ধনায় যোগ দিতে গেলে স্টেশনে নেমে দেখতে পান সারা রেল স্টেশন পুলিশে ঘেরা। কেননা সে-সময় তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল প্রায় রোমাঞ্চ উপন্যাসের মতো কৌতূহলোদ্দীপক। নাদেরা বেগমের উপস্থিতি মানেই সরকার বিরোধী আন্দোলন, এই ভেবেই পুলিশ রেল স্টেশন ঘেরাও করে।

কারাবন্দী, বিয়ে এসবের ফলে তাঁর লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটলেও তিনি ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ প্রথম পর্ব পাস করেন এবং ১৯৫৩ সালে এম.এ শেষপর্ব। এম. এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ১৯৫৫ সাল থেকে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। কৃতি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি রেডিওতে ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন।

তিনি দুই পুত্র ও

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion