আসানা আম্মা কোলা-বাদামের অকিঞ্চিৎকর স্তূপের দিকে তাকিয়ে থুথু ফেললো, আর টুকরিটা তুলে নিলো। তারপর টুকরিটা নামিয়ে একটা বাদাম তুলে নিয়ে সেটায় একটা কামড় দিয়ে সেটা ছুঁড়ে স্তূপের মধ্যে ফেলে আবার থুথু ফেলে উঠে দাঁড়ালো। তীব্র ক্ষণস্থায়ী একটা ব্যথা তার বাঁ কানের নিচে কোথায় যেন চাগিয়ে উঠলো। চোখদুটো তার ঝাপসা হয়ে এলো।

“জ্বালানি কাঠগুলো একবার দেখতে হবে”, সে ভাবছিল চোখ ঝাপসা হয়ে আসাটা যে বাতাসের ঠাণ্ডা আমেজের জন্য এই কথা চিন্তা করতে করতে। বাদামের ঝোপগুলোর ওপর হেঁট হলো সে।

“এই ঘেসো জমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই ধুলোর ওপর কার কুদৃষ্টি পড়বে জানি না, আমি বরং তাড়াতাড়ি ওগুলো তুলে ফেলি।”

ক্রাল-এ (Kraal) ফিরে যাবার সময় তার চোখ পড়লো বিশেষ করে এবড়ো খেবড়ো গোলাকার জায়গাগুলোর ওপর, আগেকার দিনে ছিল খনির মুখগুলো। আগেকার দিনে, এই সময় জায়গাগুলো প্রায় ফেটে পড়ার মতো হতো আর বিদায়ী মরসুমের অবশিষ্ট অংশগুলো খুঁড়ে ফেলতে ফেলতে ঐ খনি-মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা প্রায় যৌন আনন্দের শিহরণ অনুভব করা যেতো, ঠিক যেমন কল্পনা করা যায় নয় মাসের গর্ভবতী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একজন পুরুষের অনুভূতি হতে পারে, সেই রকম।

গর্ভধারণ আর জন্ম আর মৃত্যু আর যন্ত্রণা; আর আবার মৃত্যু যখন আর কোনো জন্ম নেই আর তাই, কোনো মৃত্যুও নেই।

একটা নতুন মৃতদেহ দেখাও, বোন, যাতে করে আমি আমার পুরোনো কান্না কাঁদতে পারি।

তার পেটের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো, নড়ে উঠলো কি যেন জঠরের মধ্যে, দরজাটা ভর করে তাকে দাঁড়াতে হলো। বিশ বছরে একমাত্র গর্ভধারণ হলো ফুসেনিই। বিশ বছর, আর প্রথম সন্তান জন্মালো আর তাও এক পুত্র সন্তান! আগেকার দিনে বড় বড় হরিণ মারা হতো আর গর্ভবতী মেয়েকে ছোট হরিণ দিলে ভর্ৎসনা শুনতে হতো। কিন্তু এখন সরকারী অভয়ারণ্যের ঘৃণ্য চোরা শিকারীর দল তাদের ছোট ছোট নিকৃষ্ট হরিণগুলো চুপিসাড়ে পাচার করে নিয়ে যায়, এমনই নিকৃষ্ট মাদী হরিণ সব! হ্যাঁ তারা এমনকি ছোট ছোট হরিণগুলো পর্যন্ত লুকিয়ে নিয়ে যায় দক্ষিণের ঐসব লোভী লোকগুলোর বাড়িতে বাড়িতে।

আগেকার দিনে, সময় কি ভাবে কেটে যায়, কত তাড়াতাড়ি বয়স বেড়ে যায়। কিন্তু নাতি নাতনী হতে আরম্ভ করলে তখন কি মানুষ আশা করে যে তার বয়স কমে যাবে? একটা নাতি দেওয়ার জন্য আল্লাকে ধন্যবাদ।

যখন সে ঘরে ফিরে এলো তখনও আগুন বেশ ভালোভাবেই জ্বলছিল। আসানা আম্মা বাদামগুলো নামিয়ে রাখলো। গলা বাড়িয়ে কোনার দিকে দেখলো সে। জ্বালানি চ্যালা কাঠগুলোয় তাদের অন্তত পরের সপ্তাহটা চলে যাবে। বাকি সন্ধ্যাটা বসে সে আগামীকাল সকালের হাটের প্রস্তুতি করলো।

সন্ধ্যার প্রার্থনা সমাপ্ত হলো। টাকাটা থলের ভিতর। মাঠঘাট নিস্তব্ধ। হাওয়া ঘুমোচ্ছিল আর ফুসেনিও। আম্মা সদর দরজার কাছে বেরিয়ে এলো, প্রথমত সব কিছু ঠিক আছে কি না দেখতে তারপর দরজাটা বন্ধ করতে। কাউকে দেখে নয় বরং হালকা পা যা আরও হালকাভাবে চলার চেষ্টা করছে তারই খসখস শব্দ তার মনোযোগ আকৃষ্ট করলো।

“আমার স্বামী যদি আসতো”

কিন্তু অবশ্যই স্বামী তার আসেনি!

“কে ওখানে?”

“আমি আম্মা।”

“কে ইসা, আমার বাছা?”

“হ্যাঁ, আম্মা।”

“ওরা ঘুমোচ্ছে।”

“আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। আর সেই জন্য আমি এখন এসেছি।”

কথাবার্তার মাঝখানে দীর্ঘ একটা বিরতি পড়লো, দুজনেই ইতঃস্তত করছিল জামাই হাওয়া আর বাচ্চাকে দেখতে যাবে কি না! এই দোটানা সম্বন্ধে কিছুই বলা হলো না তাছাড়া সব কিছু তো আর বলা যায় না।

আসানা আম্মা দেখতে পেলো না বটে তবে বুঝতে পারলো যে ইসারই জয় হলো। সদর দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে আসানা আম্মা বাইরে বেরিয়ে এসে পিছনের আগলটা টেনে দিলো। ক্রালের দেওয়ালে লাগানো দুটো খাম্বার মাঝখানের জায়গাটাতে গিয়ে তারা ঢুকলো। এই রকমটিই হওয়া উচিত ছিল, ইসার মেরুদণ্ডের জন্যই প্রয়োজন ছিল ওখানকার সান্ত্বনাদায়ক শীতলতা।

“আম্মা, ফুসেনি ভালো আছে তো?”

“হ্যাঁ”

“আম্মা, হাওয়া ভালো আছে তো?”

“হ্যাঁ”

“আম্মা, আমাকে সত্যি করে বলো, ফুসেনি কি খুব ভালো আছে?”

“ওরে, বাছা। এত চিন্তা কিসের? ফুসেনি সদ্যোজাত শিশুমাত্র, দশদিন হয়নি তার জন্ম হয়েছে। কি করে তোমায় বলি যে খুব ভালো আছে? একজন প্রাপ্তবয়সের লোক যখন অন্য গ্রামে বাস করতে যায় ...”

“আম্মা?”

“আবার কি হলো?”

“না, না কিছু নয়।”

“বাছা, আজ সন্ধ্যায় তোমাকে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না…হ্যাঁ, যদি তুমি, একজন প্রাপ্তবয়সের লোক, অন্য এক গ্রামে বসবাস করতে যাও, গোড়ার ক’টা দিন বাদেই কি তুমি বলবে যে তুমি সম্পূর্ণ ভালো আছো?”

“না।”

“তোমাকে কি তাদের খাবারে অভ্যস্ত হতে হবে না? তোমাকে কি প্রথমে তোমার নিজের আর তোমার ভেড়ার পালের জন্য জল কোথায় পাবে তা খুঁজে বার করতে হবে না?”

“হ্যাঁ, আম্মা।”

“তাহলে এটা কি করে হয় যে তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করছো ফুসেনি খুব ভালো আছে কি না? নাড়ি খুবই তাড়াতাড়ি শুকিয়ে আসছে... আর আসবে নাই বা কেন? যত নাড়ি কেটেছি তার মধ্যে একটাও বিষিয়ে যায়নি। এখন কি নিজের নাতির নাড়ি কেটে বসে বসে দেখবো সেটা বিষিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু ওর পুরুষাঙ্গ সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে পারছি না। মাল্লাম তো সেটা বেশ পরিষ্কারভাবে আর ঠিক মতোই করেছে, সেটার তো ঠিকই থাকার কথা। তোমাদের বংশে পুরুষাঙ্গ পচনের বদনাম আছে কি?”

“না, আম্মা।”

“তাহলে মনটাকে ঠাণ্ডা করো। ফুসেনি ভালো আছে তবে আমরা এখনও বলতে পারছি না কতটা ভালো আছে।”

“তোমার কথা শুনলাম, আম্মা। আম্মা?”

“হ্যাঁ বাছা।”

“আম্মা, আমি দক্ষিণে যাচ্ছি।”

“কোথায় বললে?”

“দক্ষিণে ৷”

“কতদূরে?”

“সমুদ্রের ধার পর্যন্ত। আম্মা, আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝতে পারবে।”

“এখনও পর্যন্ত আমি কি কিছু বলেছি?”

“না, তা বলোনি।”

“তাহলে, ও কথা বলা তোমার ঠিক হয়নি। সেখানে তুমি কি করতে যাচ্ছ?”

“যে কোনো একটা কাজের খোঁজে।”

“কি কাজ?”

“জানি না।”

“হ্যাঁ, তুমি তা জানো, সেখানে তুমি ঘাস কাটতে যাচ্ছো।”

“হয়তো তাই।”

“কিন্তু বাছা, শুধু ঘাস কাটতে তুমি অতদূরে যাবে কেন? এখানে চারপাশে কি যথেষ্ট ঘাস নেই? এই ক্রালের চারধারে তোমার বাবার আর গ্রামের অন্যান্যদের? সে সব কাটো না কেন?”

“আম্মা, তুমি জানো সেটা ঠিক জিনিস নয়। সেটা যদি আমি এখানে করি লোকে আমাকে পাগল বলবে। কিন্তু ওখানে শুনেছি তারা যে সেটা শুধু পছন্দ করে তাই নয় সরকারও সে কাজ করার জন্য তোমাকে পয়সা দেয়।”

“তাহলেও আমাদের পুরুষ মানুষরা ঘাস কাটতে ওখানে যায়না। এ কাজ হলো আরও উত্তরাঞ্চলে যারা থাকে তাদের জন্য। তারা, যারা থাকে জঙ্গলে, তারাই যায় ঘাস কাটতে। আমাদের পুরুষ মানুষদের জন্য ও কাজ নয়।”

“দোহাই, আম্মা, সময় চলে যাচ্ছে, হাওয়া এখন নতুন মা হয়েছে আর ফুসেনি আমার প্রথম সন্তান।”

“আর তা সত্ত্বেও দক্ষিণে গিয়ে ঘাস কাটার জন্য তুমি তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছো?”

“কিন্তু আম্মা, আমার এখানে থেকে তাদের উপোস করতে দেখে কি লাভ হবে? তুমি নিজেই জানো সমস্ত কোলা বাদাম নষ্ট হয়ে গেছে, আর যদি তা নাও হতো, ব্যবসাপত্রের যা অবস্থা, সেগুলো থেকে কত পয়সাই বা আমি করতে পারতাম? আর সেই জন্যই আমি চলে যাচ্ছি। ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে; আর কবে যে সব ঠিক হবে সেটা যেহেতু আমরা জানিনা সেহেতু আমার মনে হয় আমার পক্ষে চলে যাওয়াই মঙ্গল।”

“হাওয়া কি জানে?”

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion