পিতৃপ্রতিম কৃষণ চন্দর
আর কে মুনির:কৃষণ চন্দর প্রকৃত অর্থেই এক মহান অন্তঃকরণের মানুষ। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিনি যতখানি পারা যায় মানুষের কল্যাণের কথাই ভাবতেন। নিজের সাধ্যানুসারে অন্যকে সাহায্য করা পছন্দ করতেন। অন্যের ক্ষতি হয় এই রকম কোন কাজ চিন্তাও করতেন না। তাঁর কাছে অনেক জীবন ধারার মানুষজন আসতেন, আসতেন যেমন সাধারণ মানুষ তেমনি অসাধারণরাও। প্রত্যেকের জন্য তাঁরা ছিলো অকৃত্রিম ব্যবহার। নবীন লেখকেরা আসতেন তাঁদের মতামত জানাতে এবং তাঁদের সৃজন কৃষণজীকে দেখাতে। তিনি কারো জন্য চিঠি লিখে নিতেন, কারো জন্য অনুমোদন পত্র। ফিল্ম রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর জন্য তিনি প্রভৃত কাজ করেছেন। এই জগতের লেখক কলাকুশলীদের সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছিল। সামাজিক কাজ করার দিকে কৃষণজীর আগ্রহ ছিলো খুব বেশী। এ কথা অনেকেই জানেন দেশে খরা বন্যা ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে তিনি সকলের আগে এগিয়ে এসেছেন এবং সাংগঠনিকভাবে, অর্থনীতিকভাবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
যদিও তিনি সাধারণ জীবন যাপনের অনুরাগী ছিলেন, তবু তিনি খুব একটা বাসে চড়তে চাইতেন না; বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ট্যাক্সিতে যেতেন এবং ট্রেন ব্যবহার করতেন। আর ছিলো তাঁর ভোজন রসিকতা। আমার মায়ের কাছে এই সব গল্প শুনেছি। তিনি পাঞ্জাবী হওয়ার কারণে তাঁর খাওয়া দাওয়ায় অনুরাগ ছিলো। মাঝে মধ্যে রাত্রে মদ্য পান করতেন কিন্তু তা ছিলো খুব পরিমিত।
লেখক হিসাবে আমি মনে করি তিনি ছিলেন খুবই অন্তঃমুখীন। তিনি নিজের লেখা গল্প উপন্যাস ইত্যাদি নিয়ে কারো সাথে কোন আলোচনা করতেন না। খুব কাছের মানুষ জনের কাছ থেকে এসব আমি শুনেছি। অন্যান্যরা যেমন নিজেদের লেখাপত্র নিয়ে আলোচনা করতেন, কৃষণজী কিন্তু তা করতেন না।
জলার্ক:কৃষণ চন্দর-এর ব্যক্তিত্বের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী বলে মনে করেন?
মুনির:কলকাতায় আমি অনেক বার গেছি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করেছি। অত বিখ্যাত বড় মাপের মানুষ হলেও, তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ। নিজেই এগিয়ে এসে সম্ভাষণ করেছেন। শেষবার যখন গেছি তিনি ছিলেন খুবই অসুস্থ। সবে হাসপাতালে থেকে ফিরেছেন। তবুও প্রায় আধঘণ্টা কথা বলেছি। তিনি ওয়ার্ল্ড সিনেমা নিয়ে আমাকে বলেছিলেন। স্বভাবসিদ্ধভাবে তিনি একটু গম্ভীর প্রকৃতির কিন্তু তা সত্ত্বেও আলোচনা মেলামেশার ক্ষেত্রে খুবই স্বজন। আমার সাক্ষাৎকারের তিন মাস পরে তিনি মারা যান। কৃষ্ণাজীও ছিলেন তেমনি সাধারণ ও স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত একজন বড় মাপের লেখক নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে গেছেন এটা বড় কথা। তাঁকে কোন দিন কারো বিরুদ্ধে কটু কথা বলতে শুনিনি—এই মহৎ অন্তঃকরণের জন্য তাঁর মেধার থেকে কম মেধার মানুষকে যেমন অবজ্ঞা অথবা অবহেলা করতেন না তেমনি নবীন লেখকেরা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে এলে তাঁদের খুবই উৎসাহিত করতেন।
জলার্ক:কৃষণজীর সঙ্গে মেলামেশার জন্য কারা আসতেন?
মুনির:এক কথায় বলতে গেলে ভারতের প্রায় বড় মাপের সব মানুষরাই আসতেন। কবি শিল্পী সাহিত্যিক। আসতেন সায়ির লুধিয়ানভি, মজরুহ সুলতান পুরী, ফৈজ আহমদ ফৈজ, সর্দার আলি জাফরি, কমলেশ, মোহন রাকেশ, ধরমবীর ভারতী আরও নামী লেখকেরা। এরা এলে থাকতেন, খাওয়া দাওয়া করতেন। বাইরের দেশ যেমন রাশিয়া, চেকেশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড অন্যদেশ থেকে প্রতিনিধিরা তাঁর কাছে আসতেন। তিনিও বাইরের অনেক দেশে গেছেন। বিশ্বের বহু ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে; বিশেষ করে রাশিয়ান ব্লকে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো বেশী। সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, ভারতের পদ্মভূষণ ছাড়াও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু দেখেছি এই সব খেতাব তাঁকে খুব একটা বিচলিত করতো না। খুশি হতেন। তিনি নিজের জগতে অনন্য থাকতেন। তাঁর মুখ থেকে একটি বাজে বাক্য কখনো শুনিনি। জীবনযাপনে ছিলেন সাদামাটা। তিনি মাটিতে একটা হালকা তোষক পেতে শুতেন। এই অভ্যাসটি আমারও। আমিও তাই করি। মনে হয় মাটিতে শোয়ার অভ্যাস হলো ধরিত্রীর বুকের কাছে থাকার ইচ্ছা। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য তিনি পছন্দ করতেন কিন্তু আড়ম্বর পছন্দ করতেন না।
জলার্ক:আপনি কী তাঁর লেখা উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপ দেখেছেন, 'সরায় কে বাহর' ইত্যাদি।
মুনির:আমি তা দেখিনি। কিন্তু তার লেখা অনেক পড়েছি। টাকার প্রয়োজনে তিনি কমার্শিয়াল ফিল্মের স্ক্রিপ্টও লিখেছিলেন। মমতা (উত্তরফাল্গুনীর হিন্দী রূপান্তর) সরাফ, হামরাহি। কিন্তু তিনি কমার্শিয়াল ফিল্ম পছন্দ করতেন না। আমাকে বলেছিলেন। আমার প্রতি তাঁর মনোযোগ ছিলো সব সময়। ফিল্ম-এর কাজ করার আমার প্রবল ইচ্ছাও ছিলো। এটা যখন জানলেন তিনি আমাকে পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে গিয়ে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। বলতে গেলে কৃষণজীর আনুকূল্যেই এখানে পড়া। এখানে আমি ফিল্ম ডাইরেকশন কোর্স পড়তে যাই। সেখানে বড় বড় সব শিল্পী সাহিত্যিক চিত্রনির্মাতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিলো। আমাকে পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিতেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় ঋত্বিক ঘটক, রাজকাপুর, হাষিকেশ মুখার্জী, মৃনাল সেন, গুলজার। কৃষণজী আমার এই আর্টিষ্টিক ঝোঁক দেখে উৎসাহিত হলেন। আর্ট ফিল্মের প্রতি আমার প্রবল উৎসাহ দেখে আমাকে বলেছিলেন, বিল (আমার বাড়ি ডাক নাম) তোমার হার্টের দুটো কম্পার্টমেন্ট, একটা হলো কমার্শিয়াল ফিল্ম যা তোমাকে অর্থ দেবে, অন্যটা আর্ট ফিল্মের যেটা তোমার মনের জগৎ, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। একথা বলে খুব হাসতেন।
জলার্ক:আপনার পড়াশুনার ব্যাপারে যত্ন নিতেন?
মুনির:বেশীর ভাগ যত্ন নিতেন আমার মা। কৃষণজীর এই সব ভাবার সময় কোথায়। কিন্তু পড়াশোনায় আমার বেশ অমনযোগ চলছিলো। বি.এ. পরীক্ষায় আমার ফল খুব খারাপ হয়, কৃষণ ভেঙে পড়লেন। আমাকে বললেন সব কিছু করো ঠিক আছে, কিন্তু পড়াশুনা করো। আমি কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলাম। এই সব নানা কারণে পড়ার গণ্ডগোল হয়। পরে অবশ্য আমি অনার্স সহ বিএ পাশ করি। তিনি খুব খুশী হন।
জলার্ক:একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবো যদি কিছু মনে না করেন; কৃষণজী আপনার মাকে বিয়ে করায় আপনার কৈশোর হারিয়ে যায় কি?
মুনির:আমি তা মনে করি না। আমিও মায়ের সঙ্গে কৃষণজীর বাড়ী চলে আসি এবং তিনি আমাকে পিতার স্নেহ দিয়েছেন। আমি কিন্তু কৃষণজীর সন্তান নই। আমার নিজের বাবা খুরশিদ আলি মুনির। তাঁর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। দিল্লীতে গেলে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম। তিনি সরকারী চাকরি করতেন। তিনি নিজে একজন শিল্পী ছিলেন। সেই অর্থে আমি তাঁকে হারাই নি। কিন্তু তিনি খুবই কম বয়সে মারা যান। আমি তখন যুবক, ২৬/২৭ বছর বয়স। সবে বিয়ে করেছি।
জলার্ক:আপনার বাবার সঙ্গে কৃষণজীর যোগাযোগ ছিল? বাবা মারা যাবার সময় তাঁর কী ভূমিকা ছিলো?
মুনির:বাবার মৃত্যুর পর কৃষণজীও শেষ যাত্রায় ছিলেন। আমার সঙ্গে তিনিও প্রচুর কেঁদেছেন। জড়িয়ে ধরেছিলেন। কৃষণজীর সঙ্গে তাঁর খুব স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক ছিলো। আমার ছোট বেলায় দুষ্টুমির জন্য মা মারলেও কৃষণজী কোনদিন তা করেননি। বড় হলে তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়েছিলো। আমাকে হাত খরচের জন্য টাকা দিতেন। তাঁকে ফিল্মের ব্যাপারে সাহায্য করতাম। তাঁর স্ক্রিপ্ট কপি করে দিতাম, সংলাপও লিখতাম, ছন্দ লেখাতেও মাঝেমধ্যে সাহায্য করতাম। তখন বম্বেতে থাকতাম। এই সব কাজের জন্য ২০/২৫ টাকা পেতাম। আসলে তিনি সরাসরি না দিয়ে এই সব কাজের জন্য পারিশ্রমিক হিসাবে দিতেন। এক ছাত্রের পক্ষে ২৫ টাকা তখন দারুণ ব্যাপার। তার স্ক্রিপ্ট করা ছক 'মনচলি', 'দুচোর', 'হামরাহি' দেখেছি।
জলার্ক:কৃষণ চন্দরের উপন্যাস, ছোট গল্পের বই নিয়ে কিছু ভাবছেন?
মুনির:অনেক কাজ করার আছে। তাঁর ৩০টি গল্প আমি নির্বাচন করেছি।
জলার্ক:রাজনীতির সঙ্গে কৃষণচন্দর-এর যোগাযোগ কতটা ছিলো?
মুনির:দেখুন, রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিলো; কিন্তু একেবারে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment