মঙ্গলা পোর্টের বাহাদুর শ্রমিক ভাইয়েরা
খুলনা জেলার মঙ্গলা পোর্ট। চালনার মতই এই বন্দরেও দেশ-বিদেশের জাহাজ যাতায়াত করে। রফতানির মাল জাহাজে ওঠে, আর আমদানির মাল জাহাজ থেকে নামে। কিন্তু অন্যান্য বন্দরের মতো এখানে জাহাজ ভিড়াবার জন্য ডকইয়ার্ডের ব্যবস্থা নেই। জাহাজগুলিকে মুড়িংবয়ার সঙ্গে বেঁধে দিয়ে মালপত্রের ওঠানামা চলে।
মঙ্গলা পোর্ট খুলনা শহর থেকে বহু দূরে। জলপথ ছাড়া সেখানকার সঙ্গে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে মঙ্গলা পোর্ট যেন সব কিছু থেকে এক প্রান্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। সারা প্রদেশ জুড়ে স্বাধীন বাংলার আন্দোলন চলছে। কিন্তু এখানে তেমন কোনো আন্দোলন নেই। তাহলেও এই বাংলাদেশের যেখানেই যত দূরেই থাকুক না কেনো এই আন্দোলন প্রতিটি বাঙালির মনে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। মঙ্গলার অধিবাসীরাও এই বিষয়ে একেবারে উদাসীন হয়ে থাকতে পারে না। আমি এখানে বিশেষ করে নীচের তলার সাধারণ মানুষদের কথাই বলছি। মঙ্গলা বন্দরের শ্রমিক ভাইয়েরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে পারে না, এই নিয়ে তারা পরস্পরের মধ্যে নানারকম জল্পনা কল্পনা করে, কিন্তু এ সম্পর্কে তাদের কি করণীয় থাকতে পারে তা তারা ভেবে পায় না।
ক’দিন হয় একটা ফ্ল্যাট এখানে এসে পারে ভিড়েছে। সবাই লক্ষ করেছে, এই ফ্ল্যাটটার মধ্যে দশ-বারো জন পাঞ্জাবী সৈন্য আছে। এক এক করে ক’টা দিন কেটে গেল, কিন্তু ফ্ল্যাট যেমন ছিল তেমনি আছে।
এমন তো কখনও হয় না। এই সৈন্যগুলি এখানে বসে বসে করছে কি! ওদের নিশ্চয়ই কোনো খারাপ মতলব আছে।
কী-যে হয়েছে মানুষের পাঞ্জাবী সৈন্যদের দেখলেই মনটা বিগড়ে যায়, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে থাকে। ওরা খুলনা, ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। অসহায় লোকগুলির উপর কতরকম অত্যাচার করে চলেছে, তা বলে শেষ করা যায় না। ওরা এবার শহর থেকে বেরিয়ে আসছে গ্রামের দিকে। পথের দুধারের গ্রামগুলিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সাফ করে দিয়ে যাচ্ছে।
ওরা নাকি বাঙালি জাতটাকে নিশ্চিহ্ন না করে ছাড়বে না। তারপর পশ্চিমা লোকগুলি এসে এখানকার সমস্ত জায়গা-জমি ঘরবাড়ি দখল করে বসবে। ওরা সাপের মতই আমাদের চিরশত্রু।
বন্দরের শ্রমিকরা জ্বালা-ভরা দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকায়। ওই বিষাক্ত সাপগুলির মাথা কি থেঁতলে দেওয়া যায় না? কিন্তু ওদের সঙ্গে আছে রাইফেল, মেশিনগান, খালি হাতে কেমন করে ওদের সাথে লড়াই করা যাবে? শ্রমিকদের হাতগুলি নিস্পিস্ করতে থাকে, তারা ভেতরে ভেতরে গর্জায় আর অস্থির হয়ে ঠোঁট কামড়ায়।
কিন্তু এই দুশমনরা এখানে বসে বসে করছে কি?
ওদের প্রাণে কি ভয় নেই? অবশ্য ওরা মাত্র এই ক’জন মিলে এখানে কোনরকম হাম্লা করতে সাহস করবে না। ওরা কি ওদের বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে? কেউ তো কোনো কথা জানে না, হয়তো হঠাৎ একদিন দেখা যাবে বাইরে থেকে আর কিছু সৈন্য এসে ওদের শক্তি বৃদ্ধি করে এই মঙ্গলা বন্দরকে অধিকার করে বসবে। তারপর? তারপর এখানকার লোকদের নির্মমভাবে হত্যা করে চলবে, অত্যাচারের বন্যায় সারা অঞ্চল ভাসিয়ে দেবে। তার আগেই কি ওদের খতম করে দেওয়া যায় না? দেওয়াই তো উচিত। কিন্তু কেমন করে? তাদের হাতে তো কোনো অস্ত্র নেই, অস্ত্র চালনার শিক্ষাও নেই। তাই বলে তারা কি শুধু চুপ করে বসে বসে সব কিছু দেখবে? দেশের এই মহা সঙ্কটের সময় তাদের কি করবার মতো কিছুই নেই?
শ্রমিক ভাইয়েরা অতি সতর্কভাবে ওদের হাল-চাল আর গতিবিধি লক্ষ করছিল। তারা দেখেছে, ফ্ল্যাটের সেই সমস্ত সৈন্যরা বড় হুঁশিয়ার, ওরা পালা করে সারারাত জেগে পাহারা দেয়। ওটা কি শুধু আত্মরক্ষার জন্যই, না এর পেছনে আরও কিছু আছে? শুল্ক অফিসে অনুসন্ধান নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাওয়া গেল, এই ফ্ল্যাটে নাকি অনেক গোলা-গুলি মজুদ করা আছে। এই সৈন্যরা তারই জিম্বাদার।
খবরটা পেয়ে শ্রমিকরা অধীর হয়ে উঠল। এমন চমৎকার মওকা খুব কমই পাওয়া যাবে। এই সময় আক্রমণ করতে পারলে অতি সহজেই ওদের সব ক’টাকেই খতম করে দেওয়া যাবে আর তারই সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে গোলা-গুলি উদ্ধার করা যাবে। এইভাবে এক বাণে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কেমন করে এই কাজ হাসিল করা যাবে?
অনেক চিন্তা ভাবনার পর অবশেষে একটা পথ পাওয়া গেল।
এখানে বসে কোনো কিছু করা যাবে না, মুক্তিবাহিনীকে খবর দিতে হবে। তারা অবশ্যই এর উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবেই। কিন্তু কোথায় আছে মুক্তিবাহিনী, তারা কেমন করে তাদের সন্ধান পাবে? একজন বলল, সে শুনেছে, বাগেরহাট শহর এখনও নাকি মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে। খবরটা সত্য কিনা, জোর করে বলা যায় না। তাহলেও একবার সেখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখা দরকার। তার এই প্রস্তাবটা সবাই একবাক্যে সমর্থন করলো।
বাগেরহাট শহর এখান থেকে বত্রিশ মাইল দূরে। বর্তমানে নৌকা ছাড়া সেখানে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি যেতে হয় এখুনি যেতে হবে, একটুও দেরী করলে চলবে না। অবস্থা অত্যন্ত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, পরে এমন সুযোগ নাও মিলতে পারে। যেমন প্রস্তাব তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন শ্রমিক নৌকা পথে বাগেরহাট রওয়ানা হয়ে গেল।
খবরটা মিথ্যে নয়। মুক্তিবাহিনী এখনও বাগেরহাট শহর অধিকার করে বসে আছে। বরিশালের প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল এই মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এবং তিনিই ছিলেন তাদের পরিচালক। মঙ্গলা শ্রমিক ভাইয়েরা বাগেরহাট শহরে পৌঁছে তাঁর সাথে দেখা করল।
তারা যে-উদ্দেশ্যে সেখানে এসেছিল তা সিদ্ধ হলো, মেজর জলিল তাদের প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন।
তার দুদিন বাদে মঙ্গলার ঘুমন্ত অধিবাসীরা গভীর রাত্রিতে চমকে উঠে শয্যা ছেড়ে উঠে বসল। মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খান্ খান্ করে দিয়ে চলেছে। ভয়ে কেঁপে উঠল তাদের মন। তবে কি বর্বর পাক-সৈন্যরা বাংলার উপর হামলা করেছে? উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় সবাই ঘর ছেড়ে ছুটে এল বাইরে। পরে খবর শুনে আশ্বস্ত হলো, না পাক-সৈন্যরা নয়, তাদের অতি প্রিয় মুক্তিবাহিনী। সেই ফ্ল্যাটের সৈন্যদের উপর আক্রমণ করেছে।
সব কটা সৈন্যকে ওরা নিঃশেষ করে দিয়েছে। আরও জানা গেল, ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে অনেক অস্ত্র ও গোলা-গুলি উদ্ধার করা গেছে। মুক্তিবাহিনীর কাছে এর চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর কি হতে পারে! তারা আনন্দ উল্লাসে মেতে গিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম মঙ্গলা বন্দরের শ্রমিক ভাইদের এই উদ্যোগী ভূমিকা কোনো ইতিহাসে স্থান পাবে কিনা জানি না, কিন্তু আমি তাকে কিছুতেই ছোট করে দেখতে পারছি না।
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment