চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধ
মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চর এসে সংবাদ দিল, সামরিক ভ্যান-বোঝাই একদল পাক-সৈন্য ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জের দিকে আসছে। ওদের যখন চন্দ্রগঞ্জের দিকে রোখ পড়েছে, তখন ওরা সেখানে লুটপাট না করে ছাড়বে না। খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লুৎফর রহমান, যিনি এই অঞ্চলে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলেণ। সৈন্যদের সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাট জনের মতো হবে। এদের প্রতিরোধ করতে হলে দলে কিছুটা ভারী হয়ে নেওয়া দরকার। খোঁজ-খবর করে অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ছয় জন মুক্তিযোদ্ধাকে জড় করা গেল।
সাতজন মানুষ, সাতটি রাইফেল। এই সামান্য শক্তি নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে যাওয়াটা ঠিক হবে কি? মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। কথাটা মিথ্যা নয়, এটা একটা দুঃসাহসের কাজই হবে। অথচ হাতে সময় নেই, মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে-সময়ের প্রয়োজন, তার মধ্যে এই লুণ্ঠনকারী দস্যুরা এদের কাজ হাসিল করে সরে পড়বে। চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে যাবে, আর তারা বসে বসে তাই দেখবে! না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান, যেভাবেই হোক এদের প্রতিরোধ করতেই হবে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ওরা অক্ষত ভাবে হাসতে হাসতে চলে যাবে, এ কিছুতেই হতে পারে না। ওরা আমাদের অনেক রক্ত নিয়েছে, তার বিনিময়ে ওদেরও কিছুটা রক্ত দিতে হবে।
রাস্তার ধারে একটা বড় রকমের ইটের পাঁজা। কে যেন কবে একটা দালান তোলবার জন্য এখানে এই ইটগুলি এনে জড় করে রেখেছিল। অনেকদিন হয়ে গেল, সেই দালান এখনো তোলা হয় নি, ইটগুলি যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে। চন্দ্রগঞ্জে ঢুকতে হলে সৈন্যবাহী গাড়িগুলিকে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। সুবেদার লুৎফর রহমান আর ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা সেই ইটের পাঁজার পেছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন। এখান থেকেই তাঁরা সেই হামলাকারী দস্যুদের প্রতিরোধ করবেন, এটা খুবই দুঃসাহসের কাজ। তাঁরা জানতেন, তাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চলেছেন। কিন্তু এমন এক-একটা সময় আসে যখন জেনেশুনে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। অবস্থা বিশেষে বামন হয়েও তাঁদের দানবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। মুক্তিবাহিনীর নায়ক সুবেদার লুৎফর রহমান বললেন, এখনকার অবস্থা হচ্ছে তেমনি এক অবস্থা।
কিন্তু বেশী কথা বলার সময় ছিল না। দূর থেকে অস্ফুট সামরিক ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। ঐ যে, ঐ যে আসছে ওরা! তাঁরা সাত জন সাতটি রাইফেল নিয়ে তৈরী হয়ে দাঁড়ালেন। সেই অস্ফুট আওয়াজ ক্রমেই স্ফুট থেকে স্ফুটতর হয়ে উঠতে লাগল। তারপর একটু বাদেই দেখা গেল সামরিক ভ্যান পথের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। উত্তেজিত প্রতীক্ষায় তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যেন ইস্পাতের মতো দৃঢ় আর কঠিন হয়ে এলো।
সামরিক ভ্যান দ্রুত আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেল। না থেমে উপায় ছিল না, কাদের অদৃশ্য হস্তের গুলিতে গাড়ির টায়ারের চাকা ফুটো হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কতগুলি রাইফেলের আওয়াজ। বিস্ময়ে, আতঙ্কে সৈন্যরা ঝুপ্ঝাপ্ করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। কিন্তু সেই অদৃশ্য হস্তের গুলিবর্ষণের যেন শেষ নেই। সৈন্যদের মধ্যে যারা সামনের দিকে ছিল, তাদের মধ্যে অনেকে হতাহত হয়ে ভূমিশয্যা নিল। একটু বাদেই রাইফেলের আওয়াজ থেমে গিয়ে পল্লী-প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর শান্তি ফিরে এলো।
সৈন্যরা সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তন্ন তন্ন করে চারদিকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। অদৃশ্য শত্রুরা কি তবে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে? না, ওদের বিশ্বাস নেই, একটু বাদেই হয়তো ওরা আরেক দিক থেকে আক্রমণ করে বসবে। রাস্তার দু’পাশে অনেক ঝোপঝাড় জঙ্গল। তাদের মাঝখানে ওরা কোথায় আশ্রয় নিয়ে বসে আছে কে জানে! তবে দলে ওরা ভারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে এমন করে হামলা করতে সাহস পেত না।
চন্দ্রগঞ্জ সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে এসে অবাধে লুটপাট করা যাবে, এই আশা নিয়ে তারা এখানে এসেছিল। এই অঞ্চলে তাদের একজন জামাতে ইসলামপন্থী দালাল ছিল। তার কাছ থেকে খবর পেয়েই তারা লুটের আশায় এখানে ছুটে এসেছে। তারা শুনেছিল এখানে তাদের ‘বাধা দেবার মতো কেউ নেই।’ কিন্তু হঠাৎ কে জানে কোথা থেকে এই শয়তানের দল মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে! কে জানে, হয়তো ওরা ইতিমধ্যে তাদের চারদিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে। প্রতিটি গাছ আর প্রতিটি ঝোপঝাড়ের আড়ালে যে একজন করে শত্রু লুকিয়ে নেই এমন কথাই বা কে বলতে পারে! ওদের রাইফেলগুলি এবার এলোপাথাড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ করে চলল। এইভাবে বহু গুলি অপচয় করার পর তারা থামল।
কিছু সময় নিঃশব্দে কেটে গেল। সৈন্যরা ভাবছিল, তাদের অদৃশ্য শত্রুরা সম্ভবত পালিয়ে গেছে। এমন প্রবল গুলিবৃষ্টির সামনে ওরা কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকবে! কিন্তু তা’হলেও ওদের গতিবিধি লক্ষ করা দরকার। এবার বেশ হুঁশিয়ার হয়ে এগুতে হবে। যারা হতাহত হয়ে ভূমিশয্যা নিয়েছিল, ওরা তাদের একজন একজন করে ভ্যানের উপর তুলছিল। ঠিক সে সময়ে আবার কতকগুলি রাইফেল একসঙ্গে গর্জে উঠল। গুলির পর গুলি আসছে, বিরতি নেই। সৈন্যদের মধ্যে এক অংশ আছে ভ্যানের উপরে, অপর অংশ রাস্তায়। অদৃশ্য হস্তগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এদের লক্ষ্য করে করে গুলি ছুঁড়ছে। একটি গুলিও বৃথা যাচ্ছে না। সৈন্যদের মধ্যে ভীষণ হট্টগোল পড়ে গেল। তারা একটু সামলে নিয়ে আবার প্রবলভাবে গুলিবর্ষণ করে চলল। কিন্তু তাদের সামনে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। এইভাবে কিছুক্ষণ দু’পক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলল। ইতিমধ্যে সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অপর পক্ষে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের কি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না।
অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল সৈন্যরা। কিন্তু একটু আগেই তাদের দালাল, জামাতে ইসলামীপন্থী সেই লোকটি তাদের সাহায্য করবার জন্য এসে গেছে। সে অত্যন্ত চতুর লোক, চারদিকে ভালো করে নজর করে সে এই রহস্যটা বুঝতে পারল! দূরবর্তী ইটের পাঁজাটার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে সে বলল, আমার সন্দেহ হয়, ওরা ঐ পাঁজাটার পেছনে দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক কথাই তো, এই সন্দেহটা সকলের মনেই জাগা উচিত ছিল কিন্তু এতক্ষণ এই কথাটা ওদের কারও মাথায় আসে নি।
এবার ওদের রাইফেলগুলি একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেল। সৈন্যেরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে অতি সন্তর্পণে তিনদিক দিয়ে এগিয়ে চলল। ইটের স্তূপটাকে ঘেরাও করে ফেলতে হবে। খুব সাবধান, ওদের একটাও যেন সরে পড়তে না পারে।
মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা ইটের পাঁজার আড়াল থেকে সব-কিছুই দেখছিল। সৈন্যদের মতলব বুঝতে তাদের বাকী রইল না।
আর এক মুহূর্ত দেরী করার সময় নেই। এখনই তাদের সরে পড়তে হবে। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে তারা যতটা আশা করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী কাজ হাসিল করতে পেরেছে। এবার তারা স্বচ্ছন্দে ছুটি নিতে পারে। একজন একজন করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার কিছুটা বাদে শিকার-সন্ধানী সৈন্যরা এসে সাফল্যের সঙ্গে সেই ইটের স্তূপটাকে ঘেরাও করে ফেলল। কিন্তু কি দেখল এসে? দেখল, পাখিগুলি তাদের একদম বোকা বানিয়ে দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে চলে গিয়েছে। ইটের পাঁজার পেছনে একটি জনপ্রাণী নেই। শুধু মাটির উপরে অনেকগুলি কার্তুজের খোল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
সেদিনকার যুদ্ধে সবশুদ্ধ ২৩ জন সৈন্য হতাহত হয়েছিল। আর মুক্তিবাহিনীর সাতটি জওয়ান সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। যে-দেশদ্রোহী দালালটি শত্রুদের সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এসেছিল, এর কয়েকদিন বাদেই মুক্তিযোদ্ধারা তাকেই খতম করল।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment