আমি আর আমার তিনজন সাথী। আমরা গত ক’দিন ধরে ইয়াহিয়ার শিকারী কুকুরগুলির সন্ধানী দৃষ্টি এড়িয়ে পূর্ববঙ্গের সীমান্ত পেরিয়ে যাবার জন্য এগিয়ে চলেছি। এসব পথ দিয়ে জীবনে কোনোদিন চলি নি। এসব গ্রামের নামও শুনি নি কোনোদিন। কুমিল্লা জেলার গ্রামাঞ্চল। কুমিল্লা জেলার সীমানা ছাড়িয়ে বর্ডারের ওপারে আগরতলায় যাব। আপাতত এইটুকুই জানি, তারপর কোথায় যাব, কি করব, সে সম্পর্কে কোনোই ধারণা নেই। চলার পথের এপাশে ওপাশে, সামনে পেছনে বন্ধুভাবাপন্ন দরদী মানুষ যথেষ্ট আছে, কিন্তু শত্রুও আছে। শত্রুমিত্র বিচার করতে ভুল হলে মারাত্মক বিপদের মুখে পড়তে হতে পারে।

আজ সারাটা দিন একটানা হেঁটেছি। খাওয়া জোটে নি পথে, ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। বিকেল বেলা মাধাইয়া হাটে গিয়ে পৌঁছলাম। এখানে অবশ্যই কিছু না কিছু খাবার মিলবে কিন্তু একটু নিশ্চিন্তে বসে খাবো সেই পরিবেশটাও নেই। আমাদের ভাগ্য ভালো, মাধাইয়ার হাটে নানারকমের খাবার জিনিস পাওয়া যায়, এমনকি একটি হোটেলও আছে। খোলা বাজারের উপর হোটেলটা। আমরা চার জন তাড়াতাড়ি সেই হোটেলে ঢুকে ভাত, ডাল আর মাছের ফরমাস দিয়ে বসে পড়লাম।

মাত্র কয়েক গ্রাস মুখে তুলেছি, এমন সময় চারদিকে লোকের চোখে মুখে একটা উত্তেজনা ও সন্ত্রাসের ভাব লক্ষ করলাম। হোটেলে বসেই অনুভব করতে পারছিলাম চাপা উত্তেজনার একটা তরঙ্গ যেনো বাজারের অপর প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত পর্যন্ত গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। কোনো একটা অঘটন অবশ্যই ঘটেছে। হোটেলওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? প্রথমে সে এমন ভাব দেখাল যেন সে আমাদের এ প্রশ্ন শুনতে পায় নি। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরটা-যে আমাদের পেতেই হবে। আমরা বুঝতে পারছিলাম ব্যাপারটা গুরুতর অর্থাৎ মিলিটারি ঘটিত কিছু। আমাদের প্রশ্নের বাণ এড়াতে না পেরে শেষপর্যন্ত যেন কিছুই হয় নি এই রকম ভাব দেখিয়ে সে অবহেলার সুরে বলল, ও কিছু না, মিলিটারি-মিলিটারির গাড়ি আসছে।

ও কিছু না, মিলিটারি, লোকটা বলে কি! মিলিটারির দর্শন এড়াবার জন্য পাঁচ মাইলের পথ দশ মাইল, এমনকি পনের মাইল পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে এসেছি। শেষ কালে এই মাধাইয়া হাটের হোটেলে এই গোধূলি লগ্নে সেই মিলিটারির সঙ্গে শুভদৃষ্টি হবে। আমরা চার জন একই সঙ্গে খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

আপনারা এত উতলা হচ্ছেন কেন? আজকালকার দিনে এমন ভয় করলে চলে না। আর ভয় পাবারও তেমন কিছু নেই। এই সড়কটা ওদের সবসময়কার চলা-চলতির পথ। এখান দিয়ে ওরা নানা জায়গায় যাতায়াত করে।

একজন এসে খবর দিল একটা মিনি-বাস ভর্তি মিলিটারির লোক আসছে। হাটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ভেবে দেখলাম, এমন সময় হোটেলের আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লে বিপদের আশঙ্কাও থাকতে পারে। আর যদি মরতেই হয়, তবে মরবার আগে আরো কয়েক গ্রাস মাছ-ভাত খেয়ে নেওয়াটাই ভালো। এবার আমরা সবাই একমত হয়ে খেতে শুরু করলাম। খেতে খেতে প্রশ্ন করলাম, ওরা কি এখানে ওখানে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজার লুট-পাট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে না?

দিচ্ছে বই কি, আকছার দিচ্ছে।

তবে এই বাজারটাও তো লুট করতে পারে, পারে না?

কেন পারবে না? ওরা যদি বাজার লুট করতে চায়, ওদের বাধা দেবে কে? তবে আপনারা বেশী ভাববেন না। ওরা আর যেখানে যাই করুক না কেন আমার হোটেলের কোনো ক্ষতি করবে না। আপনাদের রকম-সকম দেখে মনে হচ্ছে আপনারা বর্ডার ক্রস্ করতে যাচ্ছেন। আপনাদের সঙ্গে বেশী টাকা-পয়সা বা সোনাদানা নেই তো?

তার প্রশ্নটা শুনে আমরা চমকে উঠলাম। মনে পড়ল, আমরা এই হোটেলে এসে বসার পর সে এমন দুটো একটা প্রশ্ন করেছিল যা থেকে তার সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক ছিল। হোটেলগুলি চিরদিনই গোয়েন্দাদের আড্ডাখানা। এখন মনে হচ্ছে এই লোকটার সঙ্গে হয়তো মিলিটারির লোকেদের যোগাযোগ আছে। সেইজন্য মিলিটারির লোক ওর হোটেলের কোনো ক্ষতি করবে না, এ সম্পর্কে সে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে।

কিন্তু হোটেলের মালিকের সম্পর্কে আর বেশী কিছু ভাবার সময় পেলাম না। হাটের জনতার মনে সন্দেহ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে সৈন্য-বোঝাই সেই মিনি-বাস হোটেলের কাছেই এসে দাঁড়াল। ভাবলাম এই পর্যন্ত ওরা এই হাটে লুটপাট করে নি, সম্ভবত আজ সেই ত্রুটি সংশোধন করবে। পরে দেখলাম, তা নয়। ওরা ওদের প্রয়োজনীয় নানা-রকম জিনিস নানা লোকের কাছ থেকে উপহার হিসেবে সংগ্রহ করছে। এবার কি ওরা এই হোটেলে এসে ঢুকবে? না, তাও নয়। ওদের বেশী দাঁড়াবার সময় নেই। ওদের মিনি-বাস বাজার ছাড়িয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল।

হোটেলের সেই লোকটার সঙ্গে আমাদের আর কথা বাড়াবার ইচ্ছা ছিল না। তার প্রাপ্য পয়সা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দিয়ে আমরা চার বন্ধু হোটেল থেকে বেরিয়ে দুখানা রিক্সা নিলাম। আপাতত যেতে হবে চান্দিনায়। তারপর? তারপর কোথায় যাবো? তারপর কোন পথ দিয়ে যাবো সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। শুনেছি চান্দিনা দিয়েই আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছুতে হয়। এখন চান্দিনায় তো যাওয়া যাক, তারপর পথই আমাদের পথ দেখাবে।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আমাদের রিক্সা দুটো আগে পাছে গায়ে গায়ে ছুটে চলেছে। চান্দিনা এখান থেকে মাইল চারেকের পথ। আমাদের রিক্সাচালক দুই জন চলতে চলতে পরস্পর যেসব কথা বলছিল তা থেকে আমরা এমন কয়েকটি তথ্য পেলাম যা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলল। সেখানে যে-কোনো সময় যে-কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পাক-সৈন্যরা আর মুক্তিবাহিনীর লোকেরা পরস্পরকে মোকাবিলা করার জন্য তৈরী হচ্ছে। তাই চান্দিনার উপরে মিলিটারির প্রখর দৃষ্টি। সেখানে আমাদের জানাশোনা কেউ নেই। এই অবস্থায় সেখানে গিয়ে আমরা হঠাৎ একটা বিপদে পড়ে যেতে পারি। আমরা মুহূর্তের মধ্যে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। চান্দিনায় পৌঁছবার কিছুটা আগেই আমরা রিক্সা থামিযে নেমে পড়লাম। রিক্সা-চালকদের পয়সা চুকিয়ে দিয়ে আমরা চান্দিনার সেই বাঁধা সড়ক ছেড়ে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। একে অজানা পথ, তাতে অন্ধকারে দেখা যায় না, কষ্টে-সৃষ্টে মাইল খানেক পথ এগুলাম। কিন্তু মুসাফির, এই অচেনা-অজানা পথে আর বেশী দূর এগোনো নিরাপদ নয়, হয়তো পথ ছেড়ে বিপথে গিয়ে পড়ব। এইখানেই কোথাও আশ্রয় নিতে হবে।

কিন্তু কে দেবে আশ্রয়? কে আমাদের জন্য এই সঙ্কটের দিনে আশ্রয় সাজিয়ে বসে আছে? অত বেশী ভাবলে চলে না। আমরা সামনে যে-বাড়িটা আছে সেই বাড়িটাতে সরাসরি গিয়ে উঠে পড়লাম।

আমাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে একটি যুবক আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে আমাদের পরিচয় জানতে চাইল। আমরা নেহাৎ যেটুকু না বললেই নয় সেইটুকুই বললাম।

আপনারা আমাদের কাছে কি চান-যুবকটি স্পষ্ট ও সহজ সুরে প্রশ্ন করল।

আমি উত্তর দিলাম, শুধু আজকের রাতটার জন্য আমরা আপনাদের আশ্রয় নিয়ে থাকতে চাই।

বেশ, থাকবেন। যুবকটি উত্তর দিল। আপনারা বর্ডার ক্রস করতে চলেছেন-এমন আপন মানুষের মতো সে এই প্রশ্নটা করল যে, আমি সত্য কথাটাকে চাপা দিতে পারলাম না; চাপা দেবার প্রয়োজনও মনে করলাম না। বললাম, হ্যাঁ, আমরা বর্ডার ক্রস করে আগরতলায় যাব।

এবার আতিথ্যের পালা। এরা জাতিতে হিন্দু, পদবী ঘোষ। গ্রামের নাম বড়কামতা। হিন্দুপ্রধান গ্রাম। এককালে বহু হিন্দু পরিবারের বসতি ছিল। দেশবিভাগের পর ভাঙন ধরল, কিন্তু বহু পরিবার চলে যাবার পরেও এখনও যা বাকী আছে তাও বড় কম নয়। আমাদের আসার খবর পেয়ে ইতিমধ্যে পাঁচ-সাত জন লোক ঐ বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছে। এখানে এখনও সাড়ে তিন শ ঘর হিন্দুর বাস।

যাঁরা আমাদের আসবার খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছেন, তাঁদের মুখে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion