ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধের কবি লোরকা
বিগত শতাব্দীর বিশ ও তিরিশের দশকে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনী ও জার্মানিতে হিটলার সেসব দেশের একছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী এক মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ব্রাসেলস শহরে। তাছাড়া ১৯৩৫ সালের ২১ জুন প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন -ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব রাইটারস ফর দি ডিফেন্স অব কালচার। সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন জিদ, মালরো, হাক্সর্লি, স্ট্রাচি প্রমূখ মনীষীগণ। সেখান থেকে ডাক দেয়া হয় ফ্যাসিবাদী মানববিধ্বংসী বর্বরতা প্রতিহত করার জন্য। দেশে দেশে সাড়াও পড়েছে। এতো সব সত্ত্বেও ইউরোপে ফ্যাসিবাদের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর ও হিটলারের প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৩৬ সালের ১৮ই জুলাই স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থান ঘটে। অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করা হয়। সে বছরেই গঠিত হয় যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধীলীগ। স্পেনের গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার ও জনগণকে সহায়তা করার জন্য বিশ্বের কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগদান করেন। সেখানে শহিদ হন র্যালফ ফক্স (১৯০০-১৯৩৭), জন কনফোর্ড (১৯১৫-১৯৩৭), জুলিয়ান বেল, ক্রিস্টোফার কডওয়েল (১৯০৭-১৯৩৭), ফেদেরিকো লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৭) প্রমুখ। লোরকা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৮ সালের ৫জুন এবং মারা যান ন্যাস স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৬ সালের ১৮ আগষ্ট। তাঁর মৃতদেহটি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজও চলছে সে খোঁজাখুঁজি। নিজের মৃত্যুর পরের ঘটনা যেনো নিজেই আগে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন—
‘আমাকে এরপর ও খুঁজে পায়নি তারা।
তারা কি আমায় খুঁজে পায়নি?
না! আমাকে তাঁরা খুঁজেপায়নি।’
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ছিলেন স্পেনীয় সাহিত্যেও অন্যতম মৌলিক কবি। লোরকা হলো তাঁর বংশ নাম। তাঁর জন্ম হয়েছিল সুপ্রাচীন ঐতিহ্যময় গ্রনাডা শহর থেকে ১৮ কিমি দূরে ফুয়েন্তের সাংস্কৃতিক পরিবারে বাকেরোস গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ফেদেরিকো গার্সিয়া রোদ্রিগেস। তিনি পেশায় ছিলেন একজন অবস্থাপন্ন কৃষক। চিনি উৎপাদন করে সচ্ছল হয়েছিলেন। তার মা—বিসেন্তে লোরকা রোমেরো। তিনি পেশায় ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষয়ত্রী। সেই গ্রামে কেটে যায় লোরকার ১১টি বছর অর্থাৎ গোটা বাল্যকাল। গ্রামের সহজ সরল সাধারণ মানুষের সঙ্গে গভীর বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিলো তাঁর হৃদয়। দেখা ও শোনার সে এক অনন্যসাধারণ জগৎ যেন সে গ্রাম। ক্ষেতে কাজ করে ব্যস্ত কৃষক, জিপসীদের পাড়া, ফসলের জমি, উদার আকাশ, একাকীত্ব অর্থ্যাৎ সারল্য। যা লোরকার কাব্যচিন্তায় গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় লোরকার গ্রামের কিছু বিবরণ লেখক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরীর ভাষায় তুলে ধরা হলো—
...চোখের সামনে বেগা বা সবুজ সমতল গ্রামাঞ্চল, এর আলোকিত জলগাইকুঞ্জ এবং এর স্বচ্ছ প্রবাহমান জলস্রোত, আকাশের নীল এসে সবুজ সমতলে মিশেছে। নদীর ধারের পপলার অরণ্য যেন হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। সবকিছুতেই এক কাব্যময়তা স্থানের চমৎকারিত্ব রঙের আভায় উদ্ভাসিত চারদিক। বেগা বা উর্বর সমতলভুমির ভেতর দিয়ে তরতর করে বয়ে যায় ফেনিল নামের নদী। নিকটবর্তী সুউচ্চ পর্বত সিয়েরা নেবাদা-ও পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে ফেনিল নদী তার শরীর বাঁকিয়ে। উপত্যকার মাঝে এই উর্বর সমতলভুমি বা বেগা-র বিস্তার। পাহাড় দিয়ে ঘেরা উপত্যকার ক্যানভ্যাস জুড়ে জলের ছোটাছুটি আর চাষের জমি। ঋজু গপলার এবং কমলালেবু বাগানের ঘন ল্যাগুস্কেপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আধা- শহর আর গ্রাম। (সংসদ সাময়িকী, ৫ জুন ২০২৪,পৃ.৭)
১৯১৯ সালের ২১বছর বয়সে লোরকা গ্রানাডা থেকে মাদ্রিদ যান। সেখানে শিক্ষক হিসাবে পান স্বনামধন্য ফার্নান্দো হিনের দে লোস বিয়েসকে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ছাত্রাবাসে ভর্তি হন। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে লুইসা বুনুয়েল সালভাদোর দালি, প্রেদ্রো সালিনোস প্রমুখের সঙ্গে। পরবর্তীকালে তাঁরা প্রত্যেকেই স্পেনীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তখন তাঁরা সকলেই ছিলেন তরুণ। এক সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া, চা খাওয়া ছিলো নৈমিত্তিক ব্যাপার। স্পেনীয় শিল্প সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বের পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক পর্যায়ে তাঁদের নামে সমকামিতার অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে লোরকা- দালির মধ্যকার সম্পর্ক। এক সময় দালি রঙ তুলি ছেড়ে কবিতা লিখছেন। আর লোরকা কবিতা ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন স্কেচ বা ড্রয়িং-এ। পরবর্তীকালে অবশ্য তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরেছিলো একটি সিনেমা নির্মাণকে কেন্দ্র করে। ফলে ১৯২৯ সালে লোরকা কিউবা ও নিউইয়র্ক ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন।
১৯০৯ সাল পর্যন্ত তিনি নিজগ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। পরে ঐতিহ্যবাহী গ্রানাডা শহরের স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৬-১৭ সাল পর্যন্ত সাহিত্যের চেয়ে বেশি ঝোঁক ছিলো সংগীতের প্রতি। সংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছে হলো ছেলেকে আইন বিষয়ে পড়াবেন। ভর্তি করেন গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ফের্নান্দো দে লোস রিয়োস-এর মতো কয়েকজন লব্দ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকের অধীনে পড়াশোনা শেষ করে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময়ে সবচেয়ে নামকরা সংগীতকার গ্রানডার আর এক কৃতী সন্তান মানুয়েল দে ফাইয়ার সঙ্গে লোরকার পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা জন্মে। লোরকার জীবনে ফাইয়ার দারুণ প্রভাব পড়ে। তাঁদের দুজনের উদ্যোগেই ১৯২২ সালের জুন মাসে আন্দালুসিয়ার লোকজ কান্তে হোন্দো সংগীতের প্রথম উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। যদিও লোরকা ছিলেন মূলতঃ কবি— স্পেনীয় সাহিত্যের সেরা বাস্তববাদী কবিদের অন্যতম। যদিও তাঁর কাব্য ভাবনায় স্পেনীয় প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রত্নসাহিত্য বিশেষভাবে স্থানলাভ করেছে। প্রকৃতিপ্রাণ জীবনবাদী কবির কাব্যচেতনায় ঘুরে ফিরে এসেছে বাল্যকালের নিজগ্রামের স্মৃতিও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাঁর সুন্দর একটি বর্ণনাও দিয়েছেন রফিক-উম-মুনীম চৌধুরী—
... গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এক গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়ে ছিল তাঁর হৃদয়। দেখা আর শোনার এক অনন্যসাধারণ জগৎ যেন সে গ্রাম; ক্ষেতে কাজ করে ব্যস্ত কৃষক, জিপসিদের পাড়া, রাখাল, ফসলের জমি, আকাশ, একাকিত্ব সংক্ষেপে বলতে হয় সারল্য। লোরকার কবিতার উৎস খুঁজতে গিয়ে আমি গ্রানাডার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি— উর্বর সবুজ সমতলভূমি বেগা আর সাররো-ফেনিল নদীর পাড়ের মানুষ, ক্ষেত- ফসলের জমিতে কাজ করা মানুষ— কিন্তু সকলেই তাঁর কবিতার কথা বলতে গিয়ে কেবলই তাঁর মৃত্যু প্রসঙ্গে এসে যান, আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে ঘটে যাওয়া সে মর্মান্তিক কাহিনি কেই বা ভুলতে পারে! (সংবাদ সাময়িকী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭)
লোরকার রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রোমানসেরো জিতানো (১৯২৮), জিপসি ব্যালাডস এবং পোয়োতা এন নুয়েবা ইয়র্ক (১৯৩০) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত কাব্যনাট্য সমূহের মধ্যে যদি পাঁচ বছর কেটে যায় (১৯২৯), জুতা নির্মাতার আজব স্ত্রী (১৯৩২), রক্তসাত বিবাহ (১৯৩৩), ইয়ারমা (১৯৩৪) অন্যতম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক ভ্রাম্যামাণ নাট্যদল লা বারবাকা গড়েছেন স্পেনের প্রজাতন্ত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতায়। আন্দলুসিয়া তথা ¯েপনের গ্রামে তাঁরা নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। মানুষকে শিক্ষিত করে তোলাই মূল লক্ষ্য ছিলো। পরবর্তীকালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালে লোরকা ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কো বাহিনীর বিপক্ষে প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন মার্কসীয় তত্ত্বের অনেকটা আনুসারী। তাই তাঁর কবিতা সর্বদা শোষিতের পক্ষাবলম্বন করেছে। সুতরাং লোরকা আমাদের জিপসিদের গান শোনান। তাছাড়া নিগ্রো, ইহুদি, সমকামী, বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষ তথা সমাজের নিপীড়িত ও অপদস্ত মানুষের গুনগান প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর গোটা লেখনিতে। লোরকার প্রথমদিকের কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তাঁরই বন্ধু রাফায়েল আলবর্তি স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন :
১৯২৪ সালের অক্টোবর, মনে পড়ছে মাদ্রিদের ছাত্রাবাসের সেই ছোট বাগানটিতে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্বের সেই প্রথম দিন। তুমি তখন গ্রানাডার ফুয়েন্তে ডাকরোস থেকে সবে ফিরেছ। সঙ্গে এনেছ তোমার প্রথম গাথা কবিতার বই:
‘সবুজ তোমায় সুবজ যেন পাই
সবুজ হাওয়া সুবজ ডালপালা...’
শুনছি তুমি প্রথমেই সেটি পড়ছ।
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment