ছোটোবেলায় শুনিয়াছি—রূপকথার রাজপুত্র সোনার কাঠি স্পর্শ করাইয়া রাজকন্যার নিদ্রা ভাঙিয়া দেয়। বুড়া ঠাকুরমার মুখে ইহা শুনিয়া মনে হইত, নিছক একটি কাহিনি। কিন্তু বয়স হইবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশাল জনহীন পুরীর মাঝে অনুপম সৌন্দর্য—লক্ষ্মী রাজকন্যা ও তেজস্বী এক রাজপুত্রের সাক্ষাৎকার ক্রমশই অপরূপ হইয়া উঠে।

 সেইরকম একটি জীবন্ত কাহিনি ছোটোবেলায় দেখিয়াছিলাম। তখন ভাবিয়াছিলাম—মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে সত্য কতটুকু! কেবল প্রয়োজনবোধে বলিয়া ও করিয়া চলিয়াছে। কিন্তু এখন মনে হয়, কথার পিছনে যে অনুপ্রেরণাটুকু থাকে, অন্তরের ভিতরকার সেই বস্তুটির দাম অনেক। 

অভ্রভেদী অচলায়তন, অস্ত সূর্যের রাঙা রশ্মি, শাল ও দেবদারু গাছ: ইহাদিগের মাঝে দুইটি একান্ত অজ্ঞাত বালক-বালিকার ইতিহাসই আমি বলিব। ঢাকা শহরে বাড়ি। বাড়ির মালিক যিনি তিনি কায়স্থ, নাম অবিনাশ রায়। বয়সে প্রৌঢ়, দোহারা ছিপছিপে গঠন, শ্যামবর্ণ, চোখে সোনার চশমা, চুল দুই-এক গাছি পাকিয়াছে। একটি ছেলে আছে, বয়স বছর এগারো। নাম তপন। স্ত্রী নাই, অনেকদিন মারা গিয়াছে। এক বিধবা বোন আছে, আর ঝি।

একটা অয়েলক্লথের কারবার আছে, বেশ চলে। সচ্ছল, কিন্তু খাইবার লোক নাই। চারিটি মাত্র প্রাণী। কনিষ্ঠা বিধবা বোনটি ভাইয়ের পানে চাহিয়া থাকে আর ভাবে, বয়স আর এমনকী হইয়াছে যে আবার বিবাহ করিলে সংসার ওলট-পালট হইয়া যাইবে। মৃত এক প্রাণীর স্মৃতি লইয়া বাঁচিয়া থাকা মরারই সামিল। একটি ডাগর দেখিয়া বউ আনিবে, নিজে তাহাকে সাজাইয়া দিবে, না এ কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড! বউ যদি খারাপই হয়, তাহা হইলে সে আছে কী করিতে? কিন্তু বলিয়াই বা লাভ কী? আট বছর ধরিয়া তো বলা হইতেছে, কই কিছুই তো হয় না! তবুও একবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও সরযূ কথাটি ঘুরাইয়া বলে, ‘এই-তো আমাদের পাশের বাড়ির ভদ্রলোকটি আবার বিয়ে করেছেন, একপাল ছেলেমেয়েও রয়েছে। কই কেউ বলুক দেখি, কতটুকু অশান্তি ওদের বাড়িতে আছে?’ ভগ্নীর কথায় অবিনাশ মুখ তুলিয়া নীরবে হাসেন, বাহিরের পানে একবার তাকাইয়া বলেন, ‘তা আমি অস্বীকার করছিনে সরো, আমার ওরকম নাও ঘটতে পারে, এইটুকুই শুধু বলি। আর বিয়ে করলে আমাকেই বা বিশ্বাস কী? আমিও বদলে যেতে পারি। তখন তপুকে দেখবে কে? শেষ সময় অবিশ্যি সে আমাকে আবার বিয়ে করতে বলে গেছে। তোমরা বলতে পার, সে যখন বলেছে তখন তার কথাটা রাখা দরকার। কিন্তু আমি যে তার মনের কথাটি পড়েছিলাম তার মুখের উপর। আর বুঝেছিলাম এই যে, তপুর উপর কোনো খারাপ ব্যবহার হলে সারাক্ষণ তার মুখ আমার মনে পড়বে। আচ্ছা, এখন তুমিই বলো বোন, আমি যদি সুখের সংসার পেতে পুণ্যিসঞ্চয় করি, তাহলে কি তার স্বর্গগত আত্মা তৃপ্তি পাবে?’ অবিনাশের চোখদুটি ছলছল করিয়া উঠিল। সরযূ ইহার পর আর বলিবে কী?

পিছনে একটা শব্দ হইল, ‘হুম’—অনিনাশ চকিত দৃষ্টিতে ফিরিয়া চাহিলেন, দেখিলেন, তপন দাঁড়াইয়া ঘাড় কাত করিয়া মুচকি হাসিতেছে। তিনিও হাসিয়া ফেলিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এত সকালে যে ইস্কুল থেকে এলি তপু?’ তপন থপ্ করিয়া বইগুলা টেবিলের উপর ফেলিয়া বলিল, ‘আজ আমাদের ইস্কুলের ফাইন্যাল ম্যাচ কিনা, তাই ছুটি হল। আমি কিন্তু দেখতে যাব।’ তারপর পিতার গলা জড়াইয়া বলিল, ‘আচ্ছা, তোমাদের সময় তোমরা ক্রিকেট খেলতে বাবা, এই আমরা যেমন খেলি!’

অবিনাশ তপনের মুখটি দু-হাত দিয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘খেলতুম, কিন্তু তোদের মতো নয় রে। তখন এসব কেনার পয়সা জুটত না, কাজেই বানিয়ে নিতুম।’

—‘দুত্তোর, বানিয়ে আবার খেলা যায় নাকি?’

সরযূর ডাক আসিল, ‘ওরে তপু, খাবি আয়।’

তপু জুতা পায়েই মসমস করিয়া খাবার ঘরের কাছে গিয়া বলিল, ‘যা দেবে দাও, আমার হাতেই দাও পিসিমা, বাইরে থেকেই খেয়ে যাই।’ সরযূ ব্যস্ত হইয়া বলিল, ‘না, ওসব হবে না বাপু, এ আমি বলে রাখছি। জুতা

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion