উত্তর সিকিমের ভূত বাংলো
এবার আমি তোমাদের গোগোলের গল্প শোনাতে পারলাম না। তাই ঠিক করেছি, এ বছরে, আমার নিজে চোখে দেখা একটা ভুতুড়ে ঘটনার কথা তোমাদের শোনাব। ভুতুড়ে ঘটনাটা সত্যি ভূতের কাণ্ডকারখানা কিনা, সেটা তোমরাই বিচার করবে।
প্রায় চৌদ্দ বছর আগে আমি প্রথম সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে বেড়াতে গিয়েছিলুম। কোথায় কোন্ হোটেলে উঠব, সে-সব আগের থেকেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু সেখানে কারোকেই চিনি নে। আমি একলা মানুষ। গল্প করার কথাবার্তা বলার লোক নেই। একমাত্র হোটেলের মালিক আর তার মেয়ে, বউ ছাড়া। হোটেলের মালিক ছিল একজন বাস্তুহারা তিব্বতী। চীনারা যখন তিব্বত দখল করে নিয়েছিল, তখন দলাই লামার সঙ্গে হাজার হাজার তিব্বতী ভারতবর্ষে চলে আসে, আর নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এখনও সেই সব তিব্বতীরা আমাদের দেশেই থেকে গিয়েছে।
গ্যাংটক শহরের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হল, প্রায় দু'কিলোমিটার জায়গা অনেকটাই সমতল। শহরের বাজার, দোকান-পাট, হোটেল রেস্টুরেন্ট, সবই সেই সমতল রাস্তার দু'ধারে। আর এই রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে, নীল আকাশের গায়ে সব সময়েই দেখতে পেতাম, কাঞ্চনজঙ্ঘার বেশ বড় একটা অংশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল থেকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙও বদলাতে থাকত। সেই দিকে তাকালে, বাকিটা সবই নিচের পাহাড়ী অঞ্চল, গাছপালায় নিবিড় সবুজ আর নীল দেখাত। আবার অন্য দিকে পাইন দেবদারু নানা গাছের ফাঁকে ফাঁকে, পুলিশের ব্যারাক, সরকারি অফিসগুলো দেখা যেত। সমতল পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই চলে যেতাম, এককালের রাজা ছগিয়ালের প্রাসাদের দিকে। সেখানে একটি বৌদ্ধ মন্দিরে দেখতাম, তিব্বতী লামা ও ভক্তরা গম্ভীর স্বরে মন্ত্রোচারণ করছেন। আর একটি অনির্বাণ প্রদীপ সব সময়েই জ্বলছে। অনির্বাণ প্রদীপ মানে হল যে প্রদীপ একবার জ্বালালে আর কখনও নিভবে না। তিব্বতী বৌদ্ধদের কাছে এ অনির্বাণ প্রদীপ খুবই পূণ্যের জিনিস।
দু'দিন বাদেই এক বাঙালি ভদ্রলোক এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। তিনি একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সংবাদদাতা। জিজ্ঞেস করলুম, 'কী করে জানলেন আমি এখানে এসেছি?'
সাংবাদিক ভদ্রলোক হেসে বললেন, 'আমাদের কাছে কোন সংবাদই চাপা থাকে না। কলকাতার এক খবরের কাগজের সাংবাদিক বন্ধু আমাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন আপনি গ্যাংটক বেড়াতে এসেছেন। খবর পেয়েই হোটেলগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানলুম, আপনি এই হোটেলে উঠেছেন। তাই আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলুম।'
আমিও ভদ্রলোককে পেয়ে খুশি হলাম। তিনি ওর বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁদের একটি পাঁচ বছরের মেয়ে ছিল। হাসিখুশি মেয়েটির সঙ্গেও আমার খুব ভাব জমে গিয়েছিল। সে আমাকে গ্যাংটকের অনেক গল্প শোনাত। সাংবাদিক ভদ্রলোক গ্যাংটকের যা কিছু দেখবার, সবই আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন, মিলিটারি ক্যাপটেন টি. কে.বাসুর সঙ্গে। টি. কে. বাসু অর্থাৎ তাপসকুমার বসু।
গ্যাংটকের মতো জায়গায়, একজন বাঙালি মিলিটারি ক্যাপটেনের সঙ্গে আলাপ হওয়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। ক্যাপটেন বাসু একদিনের আলাপেই আমার এমন বন্ধু হয়ে গেলেন, পরের দিনই তিনি আমাকে তাদের মিলিটারি মেসে দুপুরে খাবার নিমন্ত্রণ করলেন। বললেন, 'আপনি হোটেলেই তৈরি হয়ে বসে থাকবেন। আমি নিজে না আসতে পারলে, গাড়ি পাঠিয়ে দেব। মিলিটারি ড্রাইভার আপনার খোঁজ করে আপনাকে নিয়ে যাবে।'
গ্যাংটকের মতো জায়গায়, এরকম একজন ক্যাপটেনকে পেয়ে আমার খুবই আনন্দ হল। পরের দিন একজন মিলিটারি পোশাক পরা সর্দারজী অর্থাৎ শিখ ড্রাইভার বেলা এগারটায় হোটেলে এলেন। আমি হোটেলের নিচের তলায় রেস্টুরেন্টে বসেছিলুম। ড্রাইভার সর্দারজী হোটেলের মালিককে আমার নাম বলতেই তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন। সর্দারজী আমাকে একটি ছোট চিরকুট দিলেন। তাতে লেখা ছিল, 'দাদা ড্রাইভার যশোবন্ত সিং আপনাকে নিয়ে আসবে। আপনি এর সঙ্গে চলে আসবেন। ইতি, তাপস।'
আমি যশোবন্ত সিংয়ের সঙ্গে একটা জীপে চেপে বেরিয়ে পড়লুম। সমতল পাহাড়ী পথ দিয়ে, মিলিটারি মেসে যেতে আমার রীতিমতো ভয় হয়েছিল। মেসটা ছিল একটা পাহাড়ের মাথায়। রাস্তাটা এমন উঁচু আর খাড়া একটু এদিক ওদিক হলেই একেবারে সোজা যমালয়ে যেতে হবে।
যাই হোক, মেসে পৌঁছুলুম। সামনে লন। একটা গাড়ির পক্ষে পুরোপুরি পাক খাবার মতো জায়গাও নেই। মেস রুমটা বেশ বড়। ক্যাপ্টেন টি. কে. বাসু ছাড়াও আরও বেশ কিছু ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা ছিলেন। ভদ্রলোকেরা সকলেই নানা স্তরের অফিসার। এবং যিনি মিলিটারি ডাক্তার ছিলেন, তিনি একজন ওড়িয়া। ক্যাপটেন বাসু ছাড়া আর কোন বাঙালি না থকলেও সকলের সঙ্গেই আমার খুব ভাব হয়ে গেল।
অনেক রকম রান্ন। হয়েছিল। সবই দেশীয় রান্না। মাংসের বিরিয়ানি, কাবাবের কোনও তুলনা ছিল না। খাওয়া-দাওয়া মিটতেই প্রায় বেলা তিনটে বেজে গিয়েছিল। ক্যাপটেন বাসুই ছিলেন মেসের ইনচার্জ। আর মেসের গায়েই ছিল তাঁর ছোট দুই কুঠরির থাকবার ঘর। সেখানে বিশ্রাম নেবার সময়েই ক্যাপটেন বাসু আমাকে বললেন, 'উত্তর সিকিম হল মিলিটারির হাতে। সেখানে সাধারণ মানুষ, এখান থেকে যেতে পারে না। বিশেষ অনুমতি লাগে। আর উত্তর সিকিমে যারা বাস করে, তারাও কেউ এদিকে আসতে পারে না। এই সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক কাড়াকড়ি খুব বেশি। তবে আপনি যদি উত্তর সিকিমে বেড়াতে যেতে চান, আমি তার ব্যবস্থা করতে পারি। আমাদের সঙ্গে গেলে আপনার কোন অনুমতির দরকার হবে না।'
আমি তো শুনে খুব খুশি। তখনই রাজী হয়ে গেলুম।
দু'দিন পরেই সকাল বেলা একটা জোংগা জীপে চেপে আমরা উত্তর সিকিমের পথে রওনা হলুম। জোংগা জীপ এমন গাড়ি, যা খাড়া পাহাড়ী পথে চলতে পারে। ক্যাপটেন বাসু ছাড়া, আমি, আর ডাক্তার মেজর মোহান্তি, এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন। গাড়ির চালক ছিলেন সেই যশোবন্ত সিংহ।
উত্তর সিকিমের পথটা গিয়েছে তিস্তার উৎসের দিকে। অর্থাৎ তিস্তা যেখান থেকে বরফ গলে, পাহাড় থেকে নেমে, শিলিগুড়ির পাশ দিয়ে সমতলে নেমেছে। আমরা সেই ওপরে উঠছিলুম। আর আস্তে আস্তে পাহাড় পর্বতের দৃশ্যও বদলে যাচ্ছিল। খুব সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে, খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে আমাদের জীপ চলছিল। আর তিস্তাকে একটা সরু নীল ফিতের মতো অনেক নিচে দেখা যাচ্ছিল। গাছপালা কমতে কমতে, আমরা পৌঁছে গিয়েছিলুম বরফের রাজত্বে। চারদিকের পাহাড়ই অধিকাংশ বরফে ঢাকা ।
রাত্রে আমরা যেখানে থাকব, সেখানে রান্নার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু দুপুরের খাবার সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, একটা বাংলোয় আমরা দুপুরের খাবার খাব। সেখানেই একটু বিশ্রাম করব। বাংলোটা মিলিটারির অধীনেই ছিল। কিন্তু ডাক্তার মেজর মোহান্তির স্ত্রী মিসেস মোহান্তি ভয় পেয়ে বললেন, 'আমি শুনেছি, ওটা ভূত বাংলো। আমি ওখানে ঢুকব না।'
মিসেস মোহান্তির কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেন। ক্যাপটেন বাসু বললেন, ‘দিনের বেলা সেখানে আপনার ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া, বাংলোটা মিলিটারি পাহারা দেয়। বাইরের ঘরে অফিসাররা মাঝে মাঝে অফিসের কাজ নিয়েও বসেন। দুটি খুব ভাল শোবার ঘর আর বাথরুম আছে। আমরা আছি, আপনার কোনও ভয় নেই।'
প্রায় বেলা একটার সময় আমরা সেই বাংলোর সামনে এসে দাঁড়ালাম । চারদিকেই বরফে আবৃত পাহাড়। উত্তরে, আকাশের গায়ে তুষার ঢাকা পর্বত ছাড়া কিচ্ছু নেই। কোথাও কোনও শব্দ নেই। এমন কি একটা পাখির ডাকও শোনা যায় না। বাংলোর গেটেই দেখা গেল, বন্দুক হাতে একজন সিকিমি সৈনিক পাহারা দিচ্ছে। আমাদের আসার সংবাদ নাকি আগেই দেওয়া হয়েছিল। সিকিমি সৈনিক মিলিটারি কায়দায় সেলাম ঠুকে, বাংলোর দরজার তালা খুলে দিল। আমরা ভিতরে ঢুকলুম।
বাংলোর বাইরের ঘরটা বেশ বড়। সোফা-সেট ছাড়াও রয়েছে মস্ত বড় একটা টেবিল। অনেকগুলো চেয়ার। টেবিলের ওপর রাখা জলভরা কাচের জগ। অনেক প্লেট থাকে থাকে সাজানো। আর ডজন খানেক জলের
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment