সারারাত সমরেশের ঘুম হয়নি। কেবল ছটফট করেছে। মাথার ওপরে মস্ত বিপদ। কি যে করে! যেভাবে হোক জগদীশ ঝাকে চাই। একবার যদি দেখা হয়ে যায়। সকালে উঠেই ঝা'জীকে বের করতে হবে। নইলে উদ্ধার নেই।

জগদীশ ঝা'র বাড়ি দ্বারভাঙা জেলার লৌকাহা থানায়। গ্রাম ঝুনকুনপুর। জগদীশ ঝা'র বাবা চুনচুন ঝা ছিলেন জনপ্রতিনিধি। স্বাধী-নতার পর বিহারের প্রথম মন্ত্রীমন্ডলীতে ছিলেন রাজ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয়তে ক্যাবিনেট মন্ত্রী। সেই থেকে পরপর দুবার ক্যাবিনেটে জায়গা পেয়েছেন। হঠাৎ শিবরাজপুর স্টেশনে বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু। লৌকাহার স্থায়ী শহীদ। দলবদল করেছেন, দল তৈরী করেছেন, দল ভেঙেছেন, ইস্তফাও দিয়েছেন। কিন্তু সবার উপরে জিন্দাবাদ থেকেছে লৌকাহা।

জগদীশ ছোটবেলায় খেলা করতেন আহুজার চোঙা নিয়ে। কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতেন অনুপস্থিত শ্রোতার দিকে 'কমলা বালনের ওপর সেতু হবে। লোঁকাহা বর্ষায় আর জলবেষ্টিত হয়ে যাবে না। লৌকাহার সঙ্গে যোগাযোগ হবে সারা পৃথিবীর।' সেতু হয়নি। পথঘাটও তেমন হয়নি।

বালক জগদীশের আরেকটি প্রিয় খেলা ছিলো, হিন্দুস্থান পাকিস্তান। মাটিতে আড়াআড়ি দাগ কেটে, দাগের দুপারে সবাই দুদলে ভাগ হয়ে দাঁড়াতো। তারপর কাঠিকুটি জড়ো করে হাওয়ায় শপাং শপাং সবাই শব্দ করে নাচতো। কে কত বেশী শব্দ করে নাচতে পারে। এই অস্ত্র-নৃত্যে জগদীশ কুমাগত শব্দ বৃদ্ধি করে জিতিয়ে দিতেন নিজের দেশকে। হিন্দুস্থান জিন্দাবাদের রকমারি ব্যবহার শিখেছিলেন বাবার দেখাদেখি।

একটা ব্যাপার জগদীশ ঝা টের পেয়েছিলেন। একটা যুৎসই জিন্দাবাদ এগিয়ে দিতে পারলেই যাবতীয় সমাধান। কিন্তু লৌকাহার মানুষ চুনচুন ঝা, স্ত্রী মনোরমা ঝা এবং জগদীশ ঝা'কে কোনদিন ভুলবে না। প্রতিবার রিলিফ ঠিক পেয়ে আসছে লৌকাহা। এবছর ঘোষণা করা হয়েছে ফ্লাড এ্যফেক্টেড এরিয়া, গতবার ছিল ড্রট এ্যাফেক্টেড এরিয়া। এইবা মন্দ কি!

সমরেশের আজ যেভাবেই হোক চাই জগদীশ ঝা'কে। ঝা'জীর শরণে যেতে পারলেই হলো। মাত্র একটা কথাই উনি সবাইকে বলেন: 'কোই বাত নহী, ঠিক হো জায়গা। ধীরজ রখখো।'

মনোরমা দেবী এখনও জনপ্রতিনিধি। একবার হেরেছিলেন বৈভব মিশ্রার কাছে। লৌকাহার মানযে দেখে নিয়েছে মিশ্রাজীকে জিতিয়ে কোন ফল হয়নি। সেতুর একটা নক্শা তৈরী হয়েছিল। কিন্তু ঐ অব্দি। রিলিফ হয়নি মিশ্রাজীর আমলে। লৌকাহার মানুষের পরিশানি বরং বেড়েছিল। ঝা'জীর পরিবারই ঠিক। বর্ষা আসে। জলবেষ্টিত হয় লৌকাহা। প্লেনে করে দেখে যান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দিল্লী থেকে রিলিফ আসে। ঝা'জীদের কল্যাণে লৌকাহার মানুষ তো বেঁচে আছে। এর বেশী আর কি চাই।

সমরেশের আজ বড় প্রয়োজন এই জগদীশ ঝাকে। চুনচুন ঝা জগদীশকে ঢুকিয়ে ছিলেন স্ট্যাটিসটিকস ডিপার্টমেন্টে। বি.এ. পাশ করার পর সামান্য স্ট্যাটিসটিশিয়ান হিসেবে। সেখান থেকে ডেপুটেশনে কল্যাণ বিভাগে প্রমোটি আই.এ.এস. যখন ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টর হলেন, জগদীশ ঝা'র জন্য পৃথক মাকেটিঙ এ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস সেল হলো। সেপারেট ক্যাটাগরি। প্রথমে এ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর। তারপর ডেপুটি ডাইরেক্টর।

তারপর প্রমোটি আই.এ.এস. এলেন ডিপার্টমেন্টে জয়েন্ট সেফ্রেটারী হয়ে। এবার ক্যাটাগরি এক হয়ে গেল। জগদীশ ঝা জয়েন্ট ডাইরেক্টর। এস্টাবলিশমেন্টের ইনচার্জ এখন জগদীশ ঝা'র রমরমা। যখন ইচ্ছে অফিস যান। সকাল থেকে মোটামুটি কাটান এইভাবে। সকালে বন্দনা রেষ্টুরেন্টে, দুপুরে এসেম্বলির চত্বরে, বিকালে কফি হাউসে, রাত্রে প্রেসিডেন্সি ক্লাবে। মাঝে হয়তো একবার অফিস। জনপ্রতিনিধিরা সবাই চেনেন। পারিবারিক সম্বন্ধ।

সমরেশ সকালে উঠেই চলে যায় বন্দনায়। প্রত্যেক টেবিলে মানুষ। গমগম করছে পরিবেশ। জিলিপী কচুরি ঘুঘনি আসছে। মাঝে মধ্যে সমস্ত আওয়াজ ছাপিয়ে এক একটা টেবিল থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঠহাকা। ঠহাকা অর্থাৎ প্রাণখোলা হাসি। অর্থাৎ, কোই বাত নহী, হো জায়গা!

সমরেশের তো হতে হবে। এ যে মাথার ওপর মস্ত বিপদ। সেবারও এমনই বিপদে একদিনের মধ্যে ফাইল নম্বর 6/85-এ ফেভারেবল অর্ডার করিয়ে ছিলেন জগদীশ ঝা। সে যাত্রা সমরেশের বিপদ কেটে গিয়েছিল। বিপদ যে বার বার ফিরে ফিরে আসে। ঘুরে ফিরে আসে পঞ্চবার্ষিকী। জগদীশ ঝা এখনও আসেননি। দেখা হয়ে যায় প্রকাশের সঙ্গে। প্রকাশেরও দরকার জগদীশ ঝাকে। প্রকাশেরও মস্ত বিপদ।

প্রকাশ বলছিল বিনোদ ঠাকুরকে দিয়েও পৈরবীর কাজ হয়। ওঁরই গ্রামের ঠাকুরজী দুবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু বিনোদ ঠাকুরের সঙ্গে রমেশ শ্রীবাস্তব কিংবা দেবেশ সাকসেনার পরিচয় আছে। পরমানন্দ রামকে দিয়েও অবশ্য কাজ হয়। প্রমোটি আই.এ.এস. রামবিকাশ পান্ডের সঙ্গেও রামের ভালো রিলেশন। কিন্তু সমরেশ বা প্রকাশের সঙ্গে তো রিলেশন নেই।

কি যে হবে। জগদীশ ঝাকে যেভাবেই হোক চাই।

ঝাজী সেবার কি একটা রঙ যেন বলেছিলেন। মন্ত্রীর স্ত্রী পছন্দ করেন হাল্কা বেগুনী রঙ। জয়েন্ট সেফ্রেটারীর বউ পছন্দ করেন ক্যাকটাস। কমিশনারের বউ পছন্দ করেন রঙীন মাছ আর মানানা এবং ঘিয়ের টিন। দ্বারভাঙার খাঁটি ঘি। আর বিকেলের দিকে একসঙ্গে মার্কেটিং কার বউ না পছন্দ করেন।

সমরেশের এই ফ্রাইসিস। জগদীশ ঝাকে যেভাবেই হোক চাই। প্রকাশেরও তো দরকার। বন্দনায় নেই। এ্যাসেম্বলীতে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। হয়তো পাওয়া যাবে কফি হাউসে কিংবা প্রেসিডেন্সীতে। কোথাও এক জায়গায় পাওয়া যাবেই।

বন্দনায় সোসাল গসিপ, এসেম্বলীতে রাজনীতি, কফি হাউসে কালচার, প্রেসিডেন্সীতে ধর্মালোচনা। কোথাও জগদীশ ঝাকে পাওয়া যাবেই। একটু খুঁজতে হবেই এই যা। নেতাও বলেছেন, পরিশ্রম কে সিবা কোই চারা নহী।

সমরেশ খুঁজতে থাকে। সমরেশ যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবেই।

সমরেশের মনে পড়ে কলেজ থাকতো। সঙ্গে থাকতেন ঠাকুমা। সেই শরীরে সব কাজ করতেন। জীবনের কথা। তখন উত্তরপাড়ায় বয়স ঢের হয়েছে। তবুও নড়ে চড়ে সকালে উঠেই ঘর পরিষ্কার। সেদিনও ঘর ঝাঁট দিচ্ছিলেন, এমন সময় চড়ুই পাখিদের হুল্লোড়ে ডানা ঝাপটানিতে পুরানো আয়না পড়ে গিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটিয়ে যায়।

একটা ঈষৎ বড় টুকরো হাতে ধরে ঠাকুমা মুখ দেখেন মনোযোগে।

তারপর সমরেশের দিকে চেয়ে বলেছিলেন:

হ্যাঁরে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, আমাকে সত্যি সত্যি দেখতে খুব খারাপ হয়ে গেছে, তাই সবাই কেমন করে তাকায় আমার দিকে। কতকাল আমি আমার মুখ দেখিনি।'

ঐ দূরে জগদীশ ঝা আসছেন প্রকাশের দিকে অথবা সমরেশের দিকে সমরেশ ও প্রকাশ পৃথকভাবে একত্রে অপেক্ষা করে।

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion