ফ্যাসিস্ট নায়কের উত্থান-পতন
[১৯৩৮ সালে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেই, জর্জ বার্নাড শ ‘জেনিভা’ নাটক রচনা করেন। ১৯৪৫ সালে সেই নাটকের জন্য যে ভূমিকা তিনি লেখেন, তারই দুটি পরিচ্ছেদের কিছুটা সংক্ষেপিত অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হল। জিবিএস’র বিশিষ্ট রচনারীতির সাক্ষ্যবহ এই রচনায় ফেবিয়ান সোশ্যালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক দিকটি যেমন পরিস্ফূট, তেমনই স্পষ্ট তার আত্যন্তিক সীমাবদ্ধতাও।—অনুবাদক]
হিটলার
জার্মান প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে দূরতম প্রত্যন্ত প্রদেশ পর্যন্ত সর্বত্র তখন পচন ধরেছে। ১৮৭১ সালে বোনাপার্তিস্ট ফরাসী বাহিনীকে প্রচণ্ডভাবে পরাজিত করে সামরিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত জার্মানির হোহেনজোলার্ন রাজতন্ত্র ১৯১৮ সালে ফরাসী সাধারণতন্ত্রের আঘাতে পর্যুদস্ত হল। রাজার শাসনের জায়গায় এল সকলের দ্বারা নির্বাচিত যার তার শাসন। লোকের ধারণা, এতেই জনসাধারণের সবচেয়ে বেশি কল্যাণ, অর্থাৎ গণতন্ত্রের যা লক্ষ্য, কিন্তু কার্যত এতে যে-কোনো উচ্চাভিলাষীর রাজনৈতিক উন্নতির পথ খুলে যায়। ১৯৩০-এ মিউনিখে ছিল হিটলার নামে এক তরুণ, চার বছরের যুদ্ধে সে সৈনিক ছিল। কোনো বিশেষ সামরিক গুণপনা না থাকায় আয়রন ক্রস ও করপোরালের পদের চেয়ে বড় কিছু তার ভাগ্যে জোটে নি। হিটলার ছিল গরিব। কোনো শ্রেণীতেই তাকে ফেলা যেত না। সে ছিল বোহেমিয়ান; শিল্পে কিছুটা রুচি ছিল, কিন্তু শিল্পী হিসেবে সফল হবার শিক্ষা বা প্রতিভা ছিল না। ফলে সে আটকে ছিল বুর্জোয়াশ্রেণী ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যখানে, বুর্জোয়াশ্রেণীতে যাবার মতো আয় ছিল না, আবার শ্রমিকশ্রেণীতে যাবার মতো কারিগরি দক্ষতা ছিল না। কিন্তু তার ছিল কণ্ঠস্বর, বক্তৃতা করতে পারত। সে হয়ে উঠল বীয়ারের আড্ডার বক্তা, সেখানকার শ্রোতাদের সে জমিয়ে রাখতে পারত। সে যোগ দিল এক মদের আড্ডার বিতর্ক পরিষদে (আমাদের পুরাতন কোজার্স হলের মতো), তাকে নিয়ে যার সভ্যসংখ্যা দাড়াল সাত। তার বক্তৃতার টানে আরো লোক জড়ো হল, সে হয়ে দাঁড়াল আড্ডার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। সে যেসব বাণীবর্ষণ করত, তার অনেকটাই সত্য। সৈনিক হিসেবে সে শিখেছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষেরা জনতাকে সহজেই শায়েস্তা করতে পারে; ব্রিটিশ কায়দার পার্টি পার্লামেন্ট কখনোই দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে পারে না, ঘটাবে না, যে-দারিদ্র্য তার কাছে এমন তিক্ত; যে ভারসাই চুক্তির তাড়নায় পরাভূত জার্মানি তার শেষ কানাকড়ি বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে, লুঠেরাদের সংযত করার মতো বড় একটা সৈন্যবাহিনী থাকলেই সেই চুক্তির প্রত্যেকটা শর্ত ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা যায়; য়ুরোপের অর্থনীতিকে শাসন করছে অর্থব্যবসায়ীদের যে প্রবল গোষ্ঠী তারাই চালাচ্ছে মালিকদেরও। এই পর্যন্ত হিটলার যা বুঝেছিল, তাতে কোনো ফাঁক ছিল না। কিন্তু তথ্যের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে সে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলল। সে ধরে নিল, সব অর্থ-ব্যবসায়ীই ইহুদি; ইহুদিরা অভিশপ্ত, তাই তাদের নির্মূল করতে হবে; জার্মানরা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি, পৃথিবী শাসন করার ভার ঈশ্বরই তাদের উপর, ন্যস্ত করেছেন; আর এই শাসন কায়েম করার জন্য তার দরকার কেবল এক দুর্দমনীয় সেনাবাহিনী। এইসব ভ্রান্ত মোহ হানৎস, ফ্রিট্স, গ্রেচেন এবং মদের আড্ডার রসিকদের মুগ্ধ করেছিল। ভাড়াটে গুণ্ডাদের দিয়ে নব্য হিটলারপন্থীদের ঠাণ্ডা করার চেষ্টা হলে হিটলার এমন এক শক্তপোক্ত দেহরক্ষীবাহিনী গড়ে তুলল যার দাপটে বিরোধীরা শেষ পর্যন্ত রাস্তায় দেহ রাখল।
এই সম্বল পুঁজি করেই হিটলার আবিষ্কার করল, সে নেতা হবার জন্যই জন্মেছে। জ্যাক কেড, ওয়াট টাইলার, রানী এলিজাবেথের অধীনস্থ এসেকস, ডাবলিন প্রাসাদের অধীনস্থ এবেট এবং দ্বিতীয় সাধারণতন্ত্রের অধীনস্থ লুই নেপোলিওনের মতোই সেও ভেবে বসল, রাস্তায় একটা পতাকা হাতে নিয়ে নামলেই সমগ্র জনমণ্ডলী তাকে স্বাগত জানাবে, অনুসরণ করবে। চার বছরের যুদ্ধের এক সৈন্যাধ্যক্ষ আর বীয়ারের আড্ডায় তার চাল ও বাকচাতুরীতে যারা মজেছে, তাদের সঙ্গী করে হিটলার পরীক্ষা করে দেখল। এই ছোট্ট গোষ্ঠী নিয়ে সে রাস্তায় কুচকাওয়াজে বেরোল। যে-কোনো শহরে যা ঘটে থাকে, তাই ঘটল। মজা দেখতে রাস্তার লোকের ভিড় জমল। আমি লন্ডনে দেখেছি, হাজার হাজার নাগরিক ছুটছে, অন্যরা কেন ছুটছে, তাই জানবার জন্য। ব্যাপারটা দেখায় বিপ্লবী গণজাগরণের মতোই। একবার উপলক্ষ ছিল একটা পলাতক গোরু। অন্যবার মেরি পিকফোর্ড; পুরনো নির্বাক ছবির ‘বিশ্বের প্রিয়তমা’ ট্যাক্সিতে চড়ে হোটেলে যাচ্ছিলেন।
হিটলার হয়ত একবার ভেবেছিল, মুসোলিনির রোম অভিযানের (মুসোলিনি গেছল ট্রেনে) মতো জমজমাট কিছু সেও ঘটাতে পারবে। কুর্ট আইসনারের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সাম্প্রতিক সাফল্য তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। কিন্তু আইসনারকে কেউ বাধা দেয় নি। হিটলার ও তার জনতা যখন সরকারি বাহিনীর সম্মুখীন হল, তারা হিটলারকে স্বাগত জানাল না; বুরবঁ বাহিনীর প্রবীণ সৈনিকেরা এলবা প্রত্যাগত নেপোলিওনকে যেভাবে অভিবাদন জানিয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি ঘটল না। তারা গুলি চালাল। হিটলারের জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল। বুলেটের বর্ষণ থেকে বাঁচবার জন্য হিটলার ও জেনারেল লুডেনর্ফকে শেষ পর্যন্ত রাস্তায় শুয়ে পড়তে হল। এই পাগলামির জন্য হিটলারের আট মাস কারাদণ্ড হল। হিটলার সরকারকে তেমন ভয়ও দেখাতে পারে নি যাতে কেড, টাইলার বা এসেকসের মতো তাকেও হত্যা করতে সরকার বাধ্য হয়। কারাগারে বসে হিটলার ও তার সঙ্গী-সচিব হেস ‘মাইন কাম্পফ’ (আমার সংগ্রাম, আমার কর্মসূচী, আমার মতামত অথবা যা ইচ্ছা হয় তাই) বলে এক বই লিখে ফেলল।
লুই নেপোলিওনের মতো হিটলারও এবার শিখেছে, বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান শেষ চূড়ান্ত পদক্ষেপ হতে পারে, প্রথম পদক্ষেপ কখনোই নয়। হিটলার শিখেছে, জনতার শিরোপা পাবার আগে উচ্চাভিলাষীদের আঁতাত করতে হয় অর্থব্যবসায়ীদের সঙ্গে, শিল্পপতিদের সঙ্গে, ব্যাঙ্কমালিকদের সঙ্গে, রক্ষণশীলদের সঙ্গে, কারণ যেসব দেশে জনসাধারণ নিজেদের ইচ্ছামতো শাসক নির্বাচন করে, সেই-সব দেশ আসলে চালায় এরাই। অভিনেতৃসুলভ চটকের জোরে হিটলার সহজেই একটা ব্যবস্থা করে ফেলে যাতে রাজকীয় সম্মানের চেয়েও বেশি সম্মানসহ জার্মান রাজত্বের আজীবন চানসেলারের পদে সে অভিষিক্ত হয়। অথচ তার পুঁজি বলতে জোরালো কণ্ঠ, সমাজবাদের ছিটেফোঁটা দিয়ে তৈরি এক মতাদর্শ, ইহুদিদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা, আার গণতন্ত্রের ভেকধারী পার্লামেনটারি জনতাতন্ত্রের প্রতি প্রবল অবস্থা।
নকল অবতার ও বদ্ধ উন্মাদ
এ পর্যন্ত হিটলার ছিল অর্থব্যবসায়ীদেরই সৃষ্টি, তাদেরই হাতের উপকরণ। কিন্তু অর্থব্যবসায়ীদের হিসেবে ভুল হয়েছিল। যে মুহূর্তে তারা হিটলারকে শিখণ্ডী খাড়া করল, জনতার ভক্তিবাদের উচ্ছ্বাসে হিটলার অবতার হয়ে উঠল, জননায়ক হয়ে উঠল। যে কোনো বড় ব্যবসায়ীর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা তার হাতে এসে পড়ল। বিনা দ্বিধায় পুরোদস্তুর পার্লামেনটারি অনুমোদন নিয়ে সে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যা করল। অতীতের বিখ্যাত কোনো ক্ষণে সন্ত পীটার যেমন বলেছিলেন, “তুমিই খ্রীস্ট”, জার্মান জাতিও সেই একই বাণী উচ্চারণ করল। ফলও একই হল। ক্ষমতা ও ভক্তির প্রাবল্য হিটলারের মাথা ঘুরিয়ে দিল। জাতির কল্যাণকামী যে নেতা বেকারির উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল, ভারসাইয়ের চুক্তি ছিঁড়ে ফেলে ছ-কোটি দেশবাসীর আত্মসম্মানবোধ ফিরিয়ে এনেছিল, সেই হয়ে দাঁড়াল পাগল অবতার। ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য জাতির প্রভু হিসেবে তার ঈশ্বরাদিষ্ট দ্বায়িত্ব, বাকি মানবসমাজকে যুদ্ধে পরাভূত করে পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা, জার্মান ঈশ্বরের জার্মান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা। তাকে প্রীত করে শান্ত করার কাপুরুষোচিত চেষ্টা দেখে উৎসাহিত হয়ে সে রাশিয়া আক্রমণ করল। সে হিসেব করে রেখেছিল, সোভিয়েত সাম্যবাদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে সমগ্র পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য শেষ পর্যন্ত তার সহযোগী হবে।
কিন্তু পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের অতটা দূরদৃষ্টি ছিল না। তার উপর ঈর্ষ্যা। তারা খুব একটা বুদ্ধিমন্তের মতো আচরণ করল না। তারা স্তালিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিটলারকে পিঠে ছুরি মারল। হিটলার প্রাণপণে লড়ল, ইতালি ও স্পেনে তার উচ্চাভিলাষী সহযোদ্ধারাও মদত দিল। কিন্তু হিটলার জুলিয়াস সীজারও নয়, মহম্মদও নয়। অধিবাসীদের জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটিয়ে তার বিজয়াভিযানকে গ্রহণীয় ও স্থায়ী করে তোলার চেষ্টাই সে করে নি। বরং যেখানেই সে জয়লাভ করেছে, সেখানেই তার নাম
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment