জলার্ক:কৃষণ চন্দর সম্পর্কে আপনার প্রাথমিক স্মৃতি কি?

শিবরাজ:কৃষণজীর সঙ্গে পরিচয় হয় তিনি যখন দিল্লীর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ড্রামা ডাইরেক্টর ছিলেন তখন। অতি সুক্ষ্ম চিন্তার উন্নতমানের গল্প লেখক হওয়ার সুবাদে এ.আই.আর তাঁকে এই দায়িত্বে নিয়োগ করে। আমি ছিলাম ওখানকার শিল্পী। প্রতি সপ্তাহে একটি করে ড্রামা হতো, ফলে তাঁর সঙ্গে গভীরভাবে মেশবার সুযোগ হলো। তিনি ছিলেন মহৎ অন্তঃকরণের আশ্চর্য মানুষ। সকলের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিলো মধুর এবং হঠাৎ আমরা জানলাম যে তিনি পুনা থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন। ডব্লু. জেড. আহমদ ছিলেন ওখানে। আহমদ সাহেব চেয়েছিলেন সব সেরা লেখকেরা শালিমার স্টুডিওতে যুক্ত হোন। কৃষণজী বললেন, রেডিওতে আমার সীমাবদ্ধ সুযোগ। তাই ওখানে গিয়ে কিছু করার ইচ্ছে। আমরা সকলে খুব ভেঙে পড়লাম। তিনি বললেন, তোমরাও চলে এসো, একসাথে কাজ করা যাবে। ফলে অল ইন্ডিয়া রেডিও ছেড়ে দিয়ে পুনায় চলে গেলাম এবং শালিমার স্টুডিওতে তিনশ টাকার বেতনে চাকুরিতে যোগ দিলাম। এভাবে ওখানে কিছুকাল কাজকর্ম চলার পর শালিমার স্টুডিও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে। কৃষণজী ন্যাশনাল স্টুডিও থেকে আমন্ত্রণ পান।

কৃষণজীর লেখা ‘সরাএ কে বাহর' ছিলো এক মনোজ্ঞ নাটক। ন্যাশনাল স্টুডিওর অধিকর্তা কৃষণজীকে বলেন এত সুন্দর নাটক ফিল্ম করছেন না কেন! তিনি ছিলেন প্রযোজক। কৃষণজী বম্বে চলে গেলেন ন্যাশনাল স্টুডিওতে যোগ দিতে। তিনি ডাইরেক্টর নির্বাচিত হলেন। আমিও শালিমার-এ ইস্তফা দিয়ে বম্বে চলে গেলাম। তিন-চার মাস লেগেছিলো কাজ জোগাড় করতে। ফিল্ম-এর কাজ শুরু হয়। নয় মাস সময় লাগে এটা শেষ হতে। বক্স অফিসে এটা খুব কার্যকরী হতে পারেনি। তখন পার্টিশনের সময়। দাগা চলছিলো। তাই চলচ্চিত্রটি অর্থনৈতিক সাফল্য পেলো না। 'নভেলটি' সিনেমায় রিলিজ হয়। আমরা সকলে খুব ভেঙে পড়লাম। কৃষণজী বললেন কী আর করা যাবে ঠিক আছে, আবার দেখা যাবে। এরপর উনি লেখেন 'রাখ'। এটা নাটক হলো না। ছবি শেষ হলো বটে কিন্তু সাফল্য এলো না। এর কোন স্টার ভ্যালু ছিলো না। এরপর কৃষণজী 'চার আদমি' নির্দেশনা করেন, কিন্তু তাও মাঝ পথে পরিত্যক্ত হয়। কৃষণজী ছিলেন সফল চিত্রনাট্যকার, এবং একই সময়ে ঐ ছবিগুলি টেকনিক্যাল দিক থেকে কোন অংশেই অনুন্নত মানের ছিলো না; বরং শৈলী ছিলো। তাঁর কল্পনা ছিলো উন্নতমানের এবং তাঁর এই ধারণাও ছিলো কী করে লেখাকে ছবির ভাষায় রূপান্তর করা যায়। এসব গুনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়নি।

জলার্ক:'সরাত্র কে বাহর' সম্পর্কে বলুন।

শিবরাজ:দেখুন 'সবার কে বাহর' ছিলো রেডিও ড্রামা। এটার ফিল্ম হয়েছিলো। সরাত্র অর্থ হলো ইংরাজীতে যাকে বলে ইন্ (INN)। ভ্রাম্যমান মানুষজন চলতে গিয়ে যেখানে রাত্রি যাপন করেন এবং ভোজন করেন। এই সরাই- এর অঙ্গনে গেটের বাইরে একজন ভিখারী থাকতো। তারা যত্রীদের কাছ থেকে খাদ্য ভিক্ষা করে খেতো। ভিখারীদের একটি অতি সুন্দরী মেয়ে ছিলো। একদিন একদল তাকে সরাই-এর মধ্যে টেনে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে। মেয়েটির খুব করুণ জীবন শুরু হয়। এই ছিলো ছবির গল্প। এ ছবির সাফল্য আসেনি।

জলার্ক:আপনি এই ছবিতে কোন ভূমিকায় অভিনয় করেন?

শিবরাজ:এতে আমি ল্যাংড়া ভিখারীর অভিনয় করি। একজন বিকৃত ভিখারী। আমার কাজ ছিলো কী ঘটনা ঘটছে তাকে বর্ণনা করে যাওয়া।

জলার্ক:একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে কৃষণ চন্দরকে কীভাবে নিতেন? শিবরাজ: নিশ্চয়ই, তিনি ছিলেন অতি সুন্দর মানুষ। ফিল্ম নির্মাণেও অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি এবং একই সময়ে যাঁর উন্নত মানের কল্পনা ছিলো। বহু নবীন অভিনেতারা তাঁর কাছে এসে শিখেছেন। এদের কোন রকম পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিলো না। কৃষণজী এদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিলেন। অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে এই ছবি নির্মিত হয়েছিলো অথচ অর্থনীতিক সাফল্য এলো না। দাঙ্গার সময়, কোন মানুষ নভেলটি থিয়েটারে গিয়ে ছবিটি দেখার সাহস করতো না।

জলার্ক:তাঁর নির্দেশিত অন্য কোন ছবিতে অভিনয় করেছেন?

শিবরাজ:'রাখ'-এ অভিনয় করেছি লোহারশন-এর ভূমিকায়। সে নায়িকার সঙ্গে প্রণয় সম্পর্কে জড়িয়েছিলো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে। রাখ-এর গল্প এখন ঠিক বলতে পারবো না। অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছিলো। 'চার আদমিতে, অভিনয় করেছি কার সাপার ভূমিকায়। চারজন বিভিন্ন জীবিকার লোক। 'সরাত্র কে বাহুর' নির্মাণ হয়েছিলো ১৯৪৫ সালে। এরপর ১৯৪৫/৪৬ এ নির্মাণ হয় 'রাখ', তারপরেই 'চার আদমি'। ১৯৪৭ সালে 'সরাত্র কে বাহর' মুক্তি পায়।

জলার্ক:কৃষণ চন্দর সম্পর্কে আপনার স্মৃতি থেকে টুকরো কিছু খবর দিন।

শিবরাজ:দেখুন, কৃষণ চন্দর ছিলেন আমাদের গডফাদার। আজ আমাদের যতটুকু প্রতিপত্তি হয়েছে, বেঁচে থাকার যেটুকু যতটুকু সংস্থান করতে পেরেছি সব তাঁরই জন্য। নতুবা কার এত সাহস ছিলো বম্বে এসে এই জীবিকার যুক্ত হবার। তাঁকে সকলে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতো বলে অনেকেই এ.আই.আর ছেড়ে দিয়ে বম্বে চলে এসেছিলেন। আবার কৃষণজীও প্রত্যেকের যত্ন নিয়েছিলেন। রেম আগরওয়াল ছিলেন এআইআর-এ, তিনিও চলে এলেন বম্বেতে। গোলাম হোসেন ছিলেন লক্ষ্ণৌ রেডিওতে। যখন শুনলেন কৃষণজী ফিল্ম ডিরেকশনে খুব নাম করেছেন, তিনি চাকুরী ছেড়ে নিয়ে চলে এলেন এবং ছবিতে অভিনয় শুরু করলেন। রাধিকাও ছিলেন দিল্লীতে এআইআর-এ। তাঁর ছিলো অত্যন্ত সুন্দর গলা এবং উচ্চারণ। তাঁকেও কৃষণজী ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেন। কৃষণজীর ইচ্ছা ছিলো সব দিক থেকে যোগ্যতা সম্পন্ন ফিল্ম ইউনিট গড়ে তোলার, কে এ আব্বাস-এর মতো। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো না।

জলার্ক:এতগুলি বছরের যোগাযোগের সুবাদে কৃষণ চন্দর সম্পর্কে আপনার বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতাতো নিশ্চয়ই হয়েছে। কোন ক্ষোভ, বিক্ষোভ!

শিবরাজ:তিনি সেই ধরনের মানুষই ছিলেন না তো কী বলবো। শুধু একদিন আমার শুটিং-এ পৌঁছাতে দেরী হয়েছে। তিনি বললেন, দেরী হলো কেন। কারণ বললাম। তিনি বললেন ঠিক আছে, ঠিক আছে. তৈরী হয়ে নাও, আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তিনি 'দিল কী আওয়াজ' তৈরী করেছিলেন। অনেক বছরের কথা। স্মৃতি অনেক ঝাপসা হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত 'রাখ'-এর নাম পরিবর্তন করে 'দিল কী আওয়াজ' রাখা হয়েছিলো। 'রাখ' খুব শুভ নাম ছিলো না। কৃষণজীর এক উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ফনি মজুমদার-এর স্বাধীনতা আন্দোলন ছবির জন্যে চিত্রনাট্য লেখা। এটা খুব অভিনন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছিলো। তিনি চিত্রনাট্য লেখেন 'গরিবি হটাও'। এটি তারকা সমৃদ্ধ না করে নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী দ্বারা করা হয়েছিলো। তাই নাম করতে পারেনি। এই সব কাজকর্ম চলতে থাকার পর তাঁর হার্ট-এর সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের দুই জনের একই—ডাক্তার সিংঘল। তাঁর মুখ থেকে কৃষণজীর স্বাস্থ্যের খবর পেতাম। পরে তিনি বেশী লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইতেন না। আমরাও কম যেতাম।

জলার্ক:চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর প্রকৃত ইচ্ছা কি ছিলো? উপন্যাসের বক্তব্যকে এই অডিও ভিশুয়াল মাধ্যম দিয়ে তুলে ধরা?

শিবরাজ:নতুন ধরনের মুভি তৈরী করা। কিন্তু সফল হতে পারেননি। কে এ আব্বাস, আর কে বি পি সাঠে—এঁদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিলো, তবুও অনেক কিছুই তিনি করতে পারেননি।

জলার্ক:কৃষণজী কি আর্ট ফিল্ম তৈরীর চেষ্টা করেছিলেন?

শিবরাজ:তখনকার দিনে কমার্শিয়াল ফিল্মের দারুণ প্রভাবের মধ্যে দাঁড়িয়ে কৃষণজী নতুন যে কাজটি করতে চেয়েছেন তা আজকের দিনের প্রকৃত আর্ট ফিল্ম ও কমার্শিয়াল ফিল্মের মাঝামাঝি মনোজ্ঞ এক ছবি করা।

জলার্ক:কিন্তু মানুষজন কেন তা গ্রহণ করলো না?

শিবরাজ:প্রথমত আমি মনে করি এর প্রচার হয়নি। মানুষ যদি ছবির খবরই জানতে না পারে তবে দেখবে কি করে। কৃষণজী ছিলেন প্রবলভাবে প্রচার বিমুখ এবং লাজুক। মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর তেমন বেশী যোগাযোগ না থাকাতে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion