রঘু রাও-এর বয়স বাইশ বছর। জেলে আজ ওর শেষ রাত। কাল ভোরেই ফাঁসি।

ফাঁসি সেলে শুয়ে শুয়ে রঘু রাও তার অতীত জীবনের দিকে তাকালো। স্বল্প পরিসর জীবনের প্রতিটি লহমা সে গুণতে লাগলো। কৃষক যেমন তার নিজের টাকাটি পকেটে রাখার আগে বেশ ভাল করে উল্টেপাল্টে দেখে নেয়, ঠিক তেমনিভাবেই, সেই রকম যত্ন, সেই রকম সতর্কতা ও তেমনি সংশয়মনা হয়ে রঘু রাও নিজের জীবনের প্রতিটি পল ভালো করে দেখছে। কেননা তার সমগ্র জীবনের ছাঁচটি তার নিজের হাতেই গড়া। জন্ম, মা বাবার কোল, বাবার কাঁধ, এই ধরনের কিছু কিছু লহমা নিশ্চয়ই তার বাপ মায়ের, আর কিছুটা তার সমাজ ও বংশের টাকশালের ছাপ নিয়ে এসেছে। কিন্তু জীবনের বহু মুহূর্ত—যে মুহূর্তগুলি সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে কার্যকরী আর সবচেয়ে দামী ও সুন্দর, সবটাই তার নিজের। আর এই মুহূর্তগুলি গড়ে তুলতে ওর নিজের ইচ্ছে ও মেহনতের ভূমিকাটিই ছিল প্রধান, অর্থাৎ সে যা হয়েছে, যা কিছু ভাবনা-চিন্তা, যা কিছু কাজকর্ম সে করেছে, যতটুকু তার নিজের বুদ্ধি বিবেচনা হয়েছে তার সবটার উপরই তার ব্যক্তিত্বের গভীর ছাপ রয়েছে লেগে। এর ভিতর কোন দেবতার অনুগ্রহের লেশমাত্র নেই।

প্রত্যেক লোকের জীবনের ভাঁড়ে কিছুটা থাকে ভালো আর কিছুটা মন্দ। সেগুলির বাছবিচার দরকার; নিজের না হলেও পরের জন্যেও বটে। রঘু রাও-এর জীবন তো ফুরিয়ে এসেছে, কিন্তু তবুও শেষ বারের মত বিচার করতে গিয়ে গভীর চিন্তা-সমুদ্রে মগ্ন হয়ে যেতেই ফেলে আসা জীবনের দিকটা ঘুরে এলো। ওর প্রশস্ত ললাটে চিন্তার গাঢ় ছাপ ফুটে উঠলো।

রঘু রাও-এর পায়ে ডাণ্ডাবেড়ী, হাত জেলের দেয়ালে ঠোকা পেরেকের সঙ্গে বাঁধা। কিন্তু তবুও ওর বুদ্ধি ও মন এই সব দুঃখকষ্ট উপেক্ষা করে সাগ্রহে ও সযত্নে জীবনের বিগত দিনগুলির ভাল মন্দ পরখ করতে লেগে গেল।

অন্য কেউ হলে জীবনের শেষ মুহূর্তগুলি নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু যারা সময়টাকে দুনিয়ার রাস্তা বলে জানে এবং তার ফলে সময়ের অধীন হয়ে পড়ে, রঘু রাও সে ধরণের লোক নয়। দীর্ঘ চেষ্টায় রঘুর এ উপলব্ধি এসেছিল যে, সময়টা মানুষের কাছে একটা সাদামাটা মেয়েমানুষের মত—যাকে নিজের মর্জিমত গড়ে পিটে নেওয়া যায়, যার সাথে নিজের পরিশ্রম যুক্ত করে মানুষ দুনিয়াটাকে বদলে দিতে পারে। নিজের স্বল্প পরিসর জীবনে রঘু রাও তাই-ই করে এসেছে। তাতে সে কতটুকু সফল আর কতটুকুই বা বিফল হলো আজ জীবনের এই শেষ মুহূর্তগুলিতে সে তাই যাচাই করে দেখতে চায়। এরই জন্য তার জীবনের সমগ্র নক্সাটাকে সামনে বিছিয়ে নিয়ে সে দেখতে লাগলো।

এই ওর মা। তিন বছরের শিশু রঘুকে রেখে তিনি মারা যান। মায়ের কথা ওর অত্যন্ত আবছা আবছা মনে পড়ে। ওই ডাগর কালো কালো চোখ, স্তন ভরা কাঁচা দুধ, যেন ঠোঁট পর্যন্ত ঝরে পড়ছে। একটি নরম ও গরম কোল। আর মায়ের বুকে হাত রেখে শুয়ে পড়া। ব্যস এইটুকুই ওর মনে পড়ে। আদরের চুমু খেয়ে এই স্মৃতি ও একপাশে সরিয়ে রাখল।

এই ওর বাবা ভেরাইয়া, ভেরাইয়া ছিল ওর মা ও বাবা দুই। ছিল ওর বন্ধু। লড়াইতে ছিল ওর সাথী, আবার গুরুও—বিভিন্ন পর্যায়ের সমন্বয়। রঘু রাও-এর জীবনে এরা প্রত্যেকে যদি আলাদা আলাদা লোক হত তবে ভালোই হত, জীবনটা মধুর, গভীর আর সুন্দর হয়ে উঠত। কিন্তু সমাজ স্বজনেরও কিছু ছাপ জীবনের উপর থাকে, যার ফলে সম্বলহীন জীবন মাটিতে গুঁড়িয়ে যায় না। মানুষকে এই সমাজ ও স্বজনের সাহায্যেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হয়। মূল কথাটা এই যে, ভেরাইয়া ছিল একজন ক্ষেতমজুর। নিঃস্ব, বেগার খাটিয়ে। এমনই গরীব যে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করার মত সামর্থ্যও তার ছিল না। ছেলেকে স্কুলে পাঠাবার ক্ষমতাও নেই।

রাও বাবার এই ছবিটি উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল। ভেরাইয়ার শরীর বেঁটে, মাথা নেড়া। চোখ দুটো ছোট ছোট। নগ্ন পা দুটো কালো আর মজবুত। পায়ে জুতোর প্রয়োজন ছিল না। বড় হয়ে রাও-এর পা দুইখানিও এই রকম হয়ে গেছে। রাও নিজের পা দুখানি দেখতে চাইছিলো, কিন্তু তার উপায় নেই, ডাণ্ডা বেড়ীতে বাঁধা। সে একটু স্মিত হাসলো।

ভেরাইয়া রাওয়ের জানটা খুব শক্ত করে গড়ে দিয়েছে। কারণ সে ওকে ঠিক মায়ের মতন পালন করতে পারেনি। অবশ্য একটা ক্ষেতমজুরের মা তার ছেলেকে ঠিক মায়ের মতন পালন করতেও পারে না। ভেরাইয়ার তো কথাই নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত তার কাটে কঠোর পরিশ্রম করে। কেননা রামলু, রঙড়, শোমাপ্পার মত তারও কোন জমি নেই। ওদের গাঁ শ্রীপুরমে আরো অনেকেরই জমি নেই। জমি রয়েছে জমিদারের, এরা সব জমিদারের সেই জমিতে মজুর খাটে। এরা জমিদারের বেগার, গোয়ালা আর ঘোড়া, দরকার মত মোরগও, প্রয়োজনে নিজেদের বউ-বেটির দালালও বটে। একটা লোককে যখন তার নিজের জীবনের জন্য এত কিছু করতে হয়, তখন সে যদি তার ছেলের জানটা খুব শক্ত করে গড়ে না তোলে তখন বুঝতে হবে, সে তার ছেলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাই করেছে।

ভেরাইয়া আর সবকিছু ছিল—কিন্তু সে বিশ্বাসঘাতক পিতা নয়। এ জনাই রাও ছেলেবেলা থেকেই বুভুক্ষু ও খালি পায়ে ঘুরে ফিরে জীবনের নীরস ফুল থেকে কোন না কোন প্রকারে অল্প স্বল্প রস নিঙড়ে নিতে শিখেছে। এর বেশী আশা তার নেই। ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ওদের সমাজের চেহারা এমনই যে ওর আশা আকাঙ্খা এর চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়নি। সম্পূর্ণটা ঠিক মনে নেই। তবে এটা ওর ভাসাভাসা মনে পড়ে, ও যখন খুব ছোট আর জানুয়ারী মাসের সকালে ও বিছানায় শুয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে চাইত, তখন ওর বাবা ওকে পিঠে বেঁধে নিয়ে জমিদারের ক্ষেতে কাজ করতে চলে যেত। ঘন্টার পর ঘন্টা ও কাঁদত। ওর বাবার সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা, কান্নারত ছেলেটাকে পিঠে ফেলে সে জমিদারের তুলো ক্ষেতে ফুল তুলছে, ফলে ও কেঁদে কেঁদে চুপ করে যেতে শিখল। দুধের বদলে তেঁতুল পাতার চাটনি খেতে শিখল। নিজের হাতে রুটি তৈরী করতে শিখল। ও নিজে ক্ষেতে কাজ করতে না শেখা পর্যন্ত দীর্ঘকাল বাবার জন্য রুটি তৈরী করে ক্ষেতে নিয়ে যেতে লাগলো। এটা বিশেষ কঠিন কাজ নয়; প্রথমে ও বাজারগুলো চাউলের মত জল দিয়ে ফুটিয়ে নিত। তারপর পিষে পাতার চাটনি করে নিত। শেষে দুটো কলার পাতায় বেঁধে ওর বাবার কাছে ক্ষেতে নিয়ে যেত।

কখনো কখনো জমিদার বাড়ী থেকেও লপসী এসে যেত। লপসী আর চাটনি দিয়ে ভাত খেয়ে ক্লান্ত বাহুতে শক্তি এসে যেত। ভেরাইয়া ফসল কাটতে লাগত আর রাও কাটা ফসল এক জায়গায় জড়ো করত। শেষে এমন দিনও এসে গেল যখন রাও নিজে বীজবোনা ও ফসল কাটা এবং দুটি কাজেই আগাগোড়া লেগে থাকতে শিখল। এখন ও পুরো ক্ষেতমজুর হয়ে গেছে। পুরো শিক্ষাও হয়ে গেছে। ভারবাহী গাধা যেমন অত্যন্ত প্রীতির সাথে নিজের ভারবাহী ছেলের দিকে চায়—ঠিক তেমনি গোলাম বাবা তার গোলাম ছেলেকে সগর্বে দেখলো। পিতৃস্নেহ এই যে ছেলেটার বোঝাটা একটু কম করে দেয়, ছেলের ভালবাসা হোল এই যে, বাবার বোঝা নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়। আর জমিদারের ধারা এই যে, সে দুজনের উপরই বোঝাটা আস্তে আস্তে বাড়িয়ে যায়।

রাও এই নক্সাটিকে আবার উল্টেপাল্টে দেখলো। আকৃতি, রং ও গরিবী। ওর বাবা আর ওর মধ্যে কত বিষয়েই মিল। আকৃতি ও রংটা তো সে বদলাতে পারে না। সেটা করার কোন ইচ্ছেও

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion