মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রসবিনী চট্টলা
দিগন্তে কালো মেঘের ঘনঘটা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাস স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ফুটে উঠছিল। বিপ্লবী আন্দোলনে গৌরবময় ঐতিহ্য-মণ্ডিত চট্টগ্রাম শহরের মানুষ এক আসন্ন ঝড়ের পূর্বসঙ্কেত শুনতে পেয়ে ব্যগ্র ও উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষায় দিন গুণে চলছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের দীর্ঘদিনের একটানা শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আহ্বান এসেছে। নেতাদের কাছ থেকে নয়, ছাত্র-জনতার উদ্বেল হৃদয়-সমুদ্র মন্থনের ফলে এই সংগ্রামী আহ্বান পর্যায়ের পর পর্যায় অতিক্রম করে আত্মপ্রকাশ করে চলেছে। মার্চের প্রথম ভাগ থেকেই সারা বাংলাদেশেই মানুষের মনে ঘনঘন উত্তেজনার বিদ্যুৎস্ফুরণ। চট্টগ্রামের মানুষ এ বিষয়ে কারু চেয়ে পেছনে পড়ে নেই। শহর আর শহরবাসীদের চেহারা ও চরিত্র দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে। মার্চের প্রথম থেকে এমন কোনো দিন নেই যেদিন শহরে কোনো মিছিল বেরোয় নি। জনতার মধ্যে এমন কোনো স্তর নেই যারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে সাড়া দেয় নি। কী আশ্চর্য, কোন্ যাদুমন্ত্রে এতো দিনের সেই পুরানো মানুষগুলি দেখতে দেখতে নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। ওদের যেন চিনেও চেনা যায় না।
উত্তেজিত জনসমুদ্রের এই বিক্ষুব্ধ মূর্তি দেখে সামরিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মনে সন্ত্রাসের ভাব জেগে উঠেছিল। আসন্ন ঝড়ের পূর্ব লক্ষণগুলি তারাও দেখতে পেয়েছে। ২০-এ মার্চ তারিখে তার প্রথম পরিচয় পাওয়া গেল। প্রশাসন কর্তৃপক্ষ শহরের অস্ত্রের দোকানগুলির উপর ছোঁ মেরে বসল। ওরা সেখান থেকে সমস্ত অস্ত্র সরিয়ে নিয়ে যাবে, যাতে সেগুলি বিদ্রোহী জনতার হাতে গিয়ে না পড়তে পারে। আসন্ন ঝড়টা ভেঙে পড়বার আগেই তারা তৎপরতার সঙ্গে এই কাজে হাত দিয়েছে।
পরদিন ২১-এ মার্চ তারিখে ওরা আন্দরকিল্লার চারটি অস্ত্রের দোকানে গিয়ে হানা দিল। কিন্তু এর ফলে জনতার মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, সেটা তারা কল্পনাও করতে পারে নি। সচেতন জনতা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল না, তারা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসে বাধা দিল। এ বাধা শুধু মৌখিক বাধা নয়, যারা অস্ত্রগুলি ছিনিয়ে আনতে গিয়েছিল তারা চমকে উঠে চেয়ে দেখল, উত্তেজিত জনতা তাদের ঘেরাও করে ফেলেছে। এ অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ করতে গেলে নির্ঘাত সংঘর্ষ বেধে যাবে, জনতার চোখ-মুখের ভাবে তা সুপরিস্ফুট।
যারা ঘেরাও করেছিল, তারা সুস্পষ্টভাবে তাদের রায় শুনিয়ে দিল যে, তারা কিছুতেই এই অস্ত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে দেবে না। সেই চেষ্টা করতে গেলে অনর্থ ঘটবে। তাদের এই মারমুখী মূর্তি দেখে প্রশাসন কর্তৃপক্ষের অনুচরেরা ভয় পেয়ে গেল, তারা জোর করে অস্ত্রগুলি ছিনিয়ে নিতে সাহস করল না।
ওরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এইভাবে আটক অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল, নানারকম স্তোববাক্য শুনিয়ে জনতাকে শান্ত করতে চাইল, কিন্তু কোনো কথাই কোনো কাজে এল না। জনতা যে-সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্তে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।-না, তারা কিছুতেই এই অস্ত্র সরিয়ে নিতে দেবে না। জনতা তার সহজ সংস্কারের বশে এই দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিল। লড়াই করতে গেলে হাতিয়ারের প্রয়োজন, এই সহজ সত্যটা সম্পর্কে অনেক রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও সেদিন তারা অধিকতর সচেতনতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল।
এ এক অভিনব দৃশ্য। সর্বশক্তিমান সামরিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা জনতার দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। উত্তেজিত জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের গর্জন এখন মিষ্টি কথায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। যতই সময় যাচ্ছে অবরোধকারীদের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে, বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্র ফুলে ফুলে দুলে দুলে উঠছে। ওরা বুঝল এ অবস্থায় আপোষ করা ছাড়া উপায় নেই। তাতে মর্যাদাহানি ঘটবে, কিন্তু প্রাণে বাঁচা যাবে। তখন শহরের আওয়ামী লীগের নেতাদের সামনে ওরা একটা আপোষের প্রস্তাব তুলল। তারা অস্ত্র সরিয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, তবে আপাতত দোকানগুলি সীল মেরে তালা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
দুটো করে তালা থাকবে, তাদের একটি চাবি প্রশাসন কর্তৃপক্ষের হাতে, অপরটি আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। শেষ-পর্যন্ত দু’পক্ষ এই প্রস্তাবে একমত হলো। প্রস্তাব-অনুযায়ী স্বস্থানে ফিরে গেল, আর উল্লসিত জনতা বিজয়গর্বে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সারা শহর মুখরিত করে তুলল। বীর জনতা এইবার প্রথম জয়ের আস্বাদ পেয়েছে।
যতদূর মনে পড়ে, তারিখটা ছিল ২৩-এ মার্চ। কোনো একটা ইংরেজী দৈনিক পত্রিকার উপরের পাতার হেড লাইনের দিকে তাকিয়ে ভীষণ চমকে উঠেছিলাম। সাত কলম জুড়ে এক বিরাট হেডলাইন-গরষরঃধৎু ্ ডড়ৎশবৎং পড়হভৎড়হঃ বধপয ড়ঃযবৎ. চট্টগ্রামের সংবাদ। সংবাদটা পড়ে দেখলাম, চট্টগ্রামের হাজার হাজার শ্রমিক জাহাজঘাট ঘেরাও করে দাঁড়িয়ে আছে। মিলিটারি কর্মচারীরা ১৭নং জেটির অস্ত্রবাহী জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু শ্রমিকরা বাধা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারা কিছুতেই এই অস্ত্র নামাতে দেবে না। দু’পক্ষই নিজ নিজ সঙ্কল্পে অটল হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কাউকে পথ ছেড়ে দেবে না। ঘণ্টা কয়েক ধরে এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতি চলছে। এক তীব্র যন্ত্রণাদায়ক প্রতীক্ষা-কাল! কী-যে এর পরিণতি ঘটবে, উদ্বিগ্ন চিত্তে তাই ভাবছিলাম! মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত জঙ্গী বাহিনীর লোকেরা কি জনতার এই বাধা অবনত মস্তকে মেনে নেবে? সেই সম্ভাবনা খুবই কম। সহজে তারা তাদের মর্যাদাকে ধূলি-লুণ্ঠিত হতে দেবে না। যদি তাই হয়, তবে তার অনিবার্য পরিণতি হবে এই যে, দেখতে দেখতে জাহাজঘাটে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, এই সমস্ত জীবনপণ মেহনতী মানুষের রক্তে কর্ণফুলীর কালো জল লাল হয়ে উঠবে।
কি অদম্য সাহস এই শ্রমিকদের। হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যু-ভয়কে অগ্রাহ্য করে উদ্যত মেশিনগানের সামনে স্থির নিষ্কম্প চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। মাত্র ক’মাস আগে আমরা এমন কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। কিন্তু এখন বদলে গেছে হাওয়া। সেদিন যা অকল্পনীয় অসম্ভব ছিল এখন তা সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
সংবাদটা খুবই উদ্বেগজনক, কিন্তু একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে নি, কিছু দিন আগে থেকেই এই ধরনের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগের সঙ্কল্প ঘোষিত হওয়ার পর থেকে সারা বাংলাদেশের মানুষের মতো চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক ভাইয়েরা জঙ্গী সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ করে আসছিল। কিছুদিন আগে একটা রহস্যজনক জাহাজ কড়া সামরিক পাহারায় জাহাজঘাটে এসে ভিড়েছে। সন্ধান নিয়ে জানা গেছে জাহাজে আরোহী নেই, সাধারণ মাল-পত্রও নেই। অনুমান করা যাচ্ছে, এই জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ আছে, যেগুলি এখানকার লোকদের উপর প্রয়োগ করবার জন্যই আমদানি করা হয়েছে। যখন জাহাজ থেকে মাল নামাবার জন্য ডাক এলো, তখন বন্দরের দলমত-নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমিক একবাক্যে জানিয়ে দিল যে, তারা কেউ এই মাল নামাবে না। তাছাড়া বাইরে থেকে এসে কেউ যদি এই মাল নামাতে চায়, তবে সেটাও তারা বরদাস্ত করবে না। তাদের এই ধর্মঘটে ফাটল ধরাবে, এমন শক্তি কারো ছিল না। শ্রমিকদের মধ্যে যারা এতদিন দালালের কাজ করে এসেছে তারাও হাওয়ার গতি বুঝতে পেরে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল, অথবা তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে সাহস পেল না। অবস্থা বেগতিক দেখে সামরিক কর্তৃপক্ষ জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামাবার চেষ্টাটা আপাতত স্থগিত রেখেছিলেন।
কিন্তু এবার তারা ধীর সঙ্কল্প নিয়ে কাজে নেমেছেন,-যে করেই হোক অস্ত্র নামাতেই হবে। তাদের এই প্রচেষ্টার ফল এক মারাত্মক সঙ্কটের সৃষ্টি করে তুলেছে। সংবাদপত্রের পাতায় সেদিন তারই বিবরণ বেরিয়েছিল। অবশেষে সেই সঙ্কটের পরিণতি কি ঘটেছিল, এবার তাই বলছি। বন্দরের শ্রমিকদের এই সঙ্কল্পের প্রতি অন্যান্য শ্রমিকদেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল। শুধু তারা কেন, শহরের সমস্ত মানুষ ছিল তাদের পক্ষে। শুধু শ্রমিকদের সমস্যা নয়, এটা একটা জাতীয় প্রতিরোধের সমস্যা। জাহাজঘাটের এই অবরোধে শ্রমিকদের পেছনে দলে দলে সাধারণ মানুষও এসে যোগ দিয়েছিল। যারা ঘেরাও
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment