ইতিহাসকে বদলায় জনগণের অপ্রতিরোধ্য প্রাণশক্তি, তার উদ্বোধন করেন যারা তাঁরাই হয়ে ওঠেন ইতিহাসের প্রাণপুরুষ। কিউবা-বিপ্লবের অন্যতম নায়ক চে গুয়েভারা তেমনি একটা যুগের ঐতিহাসিক পুরুষ। বুর্জোয়ারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, এবং ভক্তরা ভক্তির আতিশয্যে চে'র ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে কিংবদন্তীর আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে। তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনা যা হয়েছে সবই কিউবা বিপ্লবের পর থেকে, বিপ্লবী হিসেবে তাঁর গড়ে ওঠাকে করা হয়েছে অস্বীকার। চের জীবনালেখ্য রচনার উদ্দেশ্যে নয়, কিংবদন্তীর আড়ালের প্রকৃত মানুষটির পরিচয় পাওয়ার জন্য এই আলোচনা ।

আর্জেন্টিনার এক স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্নেস্টো গুয়েভারা নামের এই ছেলেটি জন্মাবধিই দুঃসহ হাঁপানীতে কষ্ট পেত। তাই বোধহয় তার নিরন্তর প্রয়াস ছিল দৈহিক বাধাকে ছাড়িয়ে ওঠার, প্রলোভন ছিল কঠোর পরিশ্রমের কাজের । অল্প বয়সেই সাইকেলে দূরভ্রমণ ও বরফ-ঢাকা পাহাড়-চূড়োয় ওঠার জন্য নাম কিনেছিল সে। কবিতা পড়তে ভালোবাসত আর জানা ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব এবং গেরিলা-বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপের ইতিহাস। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ফ্যাসিবিরোধী সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চিন্তার সঙ্গে মিলেছিল বাবা-মার বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট বন্ধুদের সাহচর্য ও ভালোবাসা। বাড়ীর লাইব্রেরীতে পেয়েছিল বিশ্বের চিরায়ত সাহিত্যের সঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের রচনাবলীর পরিচয়।

যদিও ছাত্রাবস্থায় সরকারী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সেও সহযোগী ছিল কিন্তু তার মানসিক আপত্তি ছিল পুলিশের লাঠির কাছে মাথা-নোয়াতে । তার ধারণা ছিল এর একমাত্র জবাব দেওয়া যায় হাতিয়ার হাতেই । নিজেকে গেরিলা নেতা হিসেবে কল্পনাও করে নি সেদিনকার কিশোর, কিন্তু অনর্থক প্রাণের অপচয় তার চিন্তাধারা-বিরোধী ছিল ।

ভাক্তারী পড়তে পড়তে বেরিয়ে পড়েছিল বন্ধুর সঙ্গে মোটর সাইকেলে গোটা মহাদেশটাকে ঘুরে দেখবার দুঃসাধ্য সাধনে। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়েছে পায়ে হেঁটে। দীর্ঘ ৯ মাসের ভ্রমণ শেষে বাড়ী ফিরেছে, সঙ্গে করে এনেছে প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি প্রত্যক্ষ করার অনাস্বাদিত পুলক আর সেই সভ্যতার ধারক ইণ্ডিয়ানদের জীবনের করুণ অবস্থার প্রতি সহমর্মিতা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে। শেষের কটা মাস ছিল আমাজন-মধ্যবর্তী দ্বীপে নির্বাসিত কুষ্ঠ রোগীদের হাসপাতালে। সেখানকার বাসিন্দারা চে ও তার বন্ধুর মধ্যে পেয়েছিল এমন মমতাময় মানুষকে যারা সভ্যসমাজ থেকে বহিষ্কৃত মানুষদের গ্রহণ করেছিল সম-মর্যাদা। সেখান থেকে দুর্মদ আমাজন পার হয়েছিল রোগীদের ভালোবাসার দান ভেলার নৌকায়। সে এক মর্মস্পর্শী বিদায় দৃশ্য। যারা অবহেলিত, নিষ্পেষিত তাদের জন্য ন্যায়ের এক জগৎ প্রতিষ্ঠার সংকল্প তখন থেকেই মনের মধ্যে বাসা ছিল ।

এক বছর পর মাত্র চব্বিশে পা দেওয়া যুবক আর্নেস্টো ডাক্তারী ডিগ্রী নিয়ে ঘর ছেড়েছিল বলিভিয়ার উদ্দেশ্যে । উপেক্ষা করেছিল ধনীর দুলালী প্রেমিকার অনুরাগ, লোভনীয় চাকরী এবং গবেষণার হাতছানি । এ কি শুধুই রোম্যান্টিক ভাবালুতা ! মোটেই নয়। এর কিছু দিন আগেই রক্ষক-ভক্ষক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাকের ডগায় দিনে একটা করে বিপ্লবের দেশ বলিভিয়ায় হয়ে গেছে এক নতুন ধরনের বিপ্লব যাতে অংশ নিয়েছিল সেই প্রথম খনি শ্রমিক ও কৃষকরা । 'সোনার খনির ওপর বসা ভিখারী রাজা’র দেশের এই অন্য ধরনের বিপ্লবকে বুঝতে চাইছিল সে।

সে গেছে খনি শ্রমিকদের ধাওড়ায়, ইণ্ডিয়ান-কৃষকের সঙ্গে এক অন্ন ভাগ করে খেয়েছে ৷ বিপ্লবকে রক্ষা করার অন্য চেষ্টা চালিয়েছে, এমনকি সরকারী দপ্তরে কাজও করেছে— কৃষি সংস্কারকে বোঝার জন্য । কিন্তু বীতশ্রদ্ধও হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি ।

বুর্জোয়া নেত্বত্বের বাগাড়ম্বর, অর্থ ও ক্ষমতার লোভ, অপশাসন ও শোষণ দেশটাকে আবার এক অন্ধকারের দিকেই যে ঠেলছিল সেটা বুঝতে পারছিল সাম্রাজ্যবাদ ও দেশের শোষক উভয়ের প্রতিই সমান ঘৃণা বুকে নিয়ে পরিস্থিতিটা অসহ্য বোধ হয়েছিল তার ।

তখন লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ গুয়াতেমালার সদ্যপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক প্রগতিশীল সরকার, পরন্তু বুর্জোয়া। বুঝতে পেরেছিল রাষ্ট্রপতি আরবেনজ বিপ্লবী নন। কিন্তু তিনি বিরাট বিরাট জমিদারীর মালিকানা কেড়ে নিয়েছিলেন, বলিভিয়ার প্রধান সম্পদ টিন খনি জাতীয়করণ করেছিলেন, সর্বোপরি শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। চে'কে যারা আগুন-খেকো বিপ্লবী বলে তারা তার জীবনের এ অধ্যায়কে কী বলবে? লাতিন আমেরিকা যেকালে মার্কিনী বহুজাতিকের বাড়ীর পেছনের বাগান সেখানে যে কোনও রকম প্রগতির পদক্ষেপই যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বৈপ্লবিক এই ধারণা ছিল চে'র। আরবেনজ সরকারকে সমর্থন করেছিল অন্যান্য প্রগতিশীল দল এবং গুয়াতেমালার লেবার পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি )। অবশ্য এই দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মাত্র ৪ বছর আগে ১৯৪৯-এ এবং দেশের মধ্যে বড় রকম কোনো রাজনৈতিক প্রভাব গড়ে ওঠেনি কিন্তু চে সহজেই এদের সঙ্গে নিজের সহমর্মিতা খুঁজে পেয়েছিল এবং এর যুব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল নিজেকে ।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে সংস্কারবাদও ‘ভয়ঙ্কর’ ও ‘কমিউনিস্ট’। বিশেষ করে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জন ডালেস বহুজাতিক ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানীর অন্নতম অংশীদার এবং তার মুনাফায় হাত পড়েছে । অতএব সি আই এ তৎপর হয়ে উঠল । পার্শ্ববর্তী হণ্ডুরাসে জড়ো হচ্ছিল সি আই এর ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী। এই সময় গিয়ে পড়ল চে । যখন ভাড়াটে বাহিনী আরবেনজ সরকারকে উচ্ছেদ করতে অপারগ হল, মার্কিনীরা তখন সরাসরি চাপ সৃষ্টি করল আরবেনজের ওপর। ওয়াতেমালার সৈন্যবাহিনী ছিল পুরোপুরি মার্কিনী শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। ভাড়াটে বাহিনীর বিরুদ্ধে এই সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ করতে অস্বীকৃত হলে চে আহ্বান জানালো শ্রমজীবী জনগণের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলতে । কিন্তু বুর্জোয়াদের সকল দোদুল্যচিত্ততা নিয়ে আরবেনজ ভাবলেন আলোচনার মাধ্যমে আপোষ মীমাংসায় আসবেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করল মার্কিন সরকার। চে'র কথায় কর্ণপাত করেনি সংস্কারবাদী সরকার । তাকে যেতে দেওয়া হল না যুদ্ধরত অঞ্চলে কিন্তু সে চুপচাপ বসে হাত কামড়ায় নি। পরন্তু দেশপ্রেমিক শ্রমজীবী ছাত্রদের সঙ্গে বিমান আক্রমণ প্রতিরোধী গোষ্ঠীতে কাজ করছিল এবং অস্ত্র-শস্ত্র যোগানোর কাজে ব্যস্ত রেখেছিল নিজেকে।

সি আই এর তালিকায় তার নাম উঠল 'বিপজ্জনক কমিউনিস্ট' হিসেবে এবং পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। তাকে বাধ্য হয়ে সরে আসতে হল আর্জেন্টিনার দূতাবাসে। সেখানে আরবেনজ পন্থী গুয়াতেমালানদের সঙ্গে চে এবং অন্যান্য সহানুভূতিশীল কিউবানরাও আশ্রয় নিল। গণতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট দুটি দলে বিভক্ত এই আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে চে ছিলেন কমিউনিস্টদের সঙ্গে। যদিও তিনি কোনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। তাকে সুযোগ দেওয়া হল দেশে ফেরার । কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম । কিউবা ও গুয়াতেমালার বিপ্লবী সঙ্গীদের অনেকেই নতুন উদ্যমে বিপ্লব সংগঠনের জন্য মেক্সিকো পৌঁছেছিল। চে-ও গেল সেইখানেই ।

কিউবার উপকূলে বিপ্লবী-বাহিনীর সঙ্গে অবতরণ করার আগে গুয়েভারার জীবনে এই হচ্ছে মোটামুটি বড় ঘটনা । এর থেকে তার যে পরিচিতিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা হল বিপ্লবী পরিস্থিতি অনুশীলনরত এক সংগ্রামী ছাত্রের ।

গুয়াতেমালায় থাকার সময়ে তাঁর সময় কাটত কার্যত রুটী-রোজগারের ধান্ধার সঙ্গে সঙ্গে বরং আরো বেশী করে কিউবা, গুয়াতেমালা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশাগত বিপ্লবীদের সান্নিধ্যে, শ্রমিকদের বস্তিতে এবং বন্ধু-জনের সঙ্গে প্রতিদিন বিপ্লব সম্পর্কে তর্ক-বিতর্কে । এই সময়েই তাঁর সামনে মার্কসীয় জ্ঞানভাণ্ডারের দ্বার সম্পূর্ণরূপে খুলে গিয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর আলাপ- আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা, শ্রেণী-সংগ্রাম, কৃষি সংস্কারের গুরুত্ব আর লাতিন আমেরিকার জন্য সমাজতন্ত্রের সোনালী ভবিষ্যৎ ।

এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও উল্লেখের দাবী রাখে। তাঁকে যারা চিত্রিত করতে চেয়েছেন দুঃসাহসিক এবং হঠকারী তরুণ মাত্র বলে, যে সর্ব অবস্থায়ই মুষ্টিমেয় কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ তরুণের দ্বারাই সাফল্যমণ্ডিত বিপ্লব সমাধা করা যায় মনে করে, বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না বলে, বলিভিয়া ও গুয়াতেমালায় তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর কাজ, বিপ্লবকে রক্ষা করার তাঁর

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion