সাগর তীর্থে
লাইট হাউস
জাহাজ ধীরে ধীরে সাগরে গিয়ে পড়ল। টের পেলুম না, কখন, কি করে সাগরে এসে গেছি। তীরের উপর চোখ রেখে চলছিলুম—সেই তটরেখা এক সময় চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল—স্বপ্ন যে ভাবে মিলিয়ে যায়—তেমনি ধীরে ধীরে।
যাত্রীদের দিকে তাকালে করুণা জাগে—এত বড় একটা সাগর, যার সঙ্গে মিশেছে মহাসাগর—দুনিয়ার সকল মহাসাগরের সঙ্গে যার যোগাযোগ—তার সম্বন্ধে তারা একান্তই উদাসীন। চোখ খুলে তাকাবারও যেন গরজ নেই কারো। বিরাট একখানা উপন্যাসের মত জাহাজটা সাঁতার কেটে চলেছে। তার ভেতরে অনেক চরিত্র, অনেক চঞ্চলতা, অনেক উপাখ্যান—আপনাতে আপনি মশগুল তারা, বাইরের দিকে বড় একটা কেউ তাকায় না—তাকালেই যেন তাদের জীবনের ছন্দপতন হয়ে যাবে। উপন্যাস এগিয়ে চলেছে নিজের জোরে। ততোধিক এক বিরাট পুরুষ যেন ধ্যানস্তিমিত চোখে সেখানা পড়ে চলেছেন। তাঁরই মনের চৌম্বক আকর্ষণে সব কয়টি চরিত্র একটি দ্বীপের লবণাক্ত জলে ধুয়ে মুছে নিত্য পরিষ্কার করা একটি ক্ষুদ্র বালুচরের দিকে নিবিষ্ট চিত্তে এগিয়ে চলেছে। সে পাঠকের যে কোনো নাম হতে পারতো। পুরাণ রচয়িতা তাঁর নাম দিয়েছেন কপিল মুনি।
সাগর আমার চোখ জুড়িয়েছে। কিন্তু মনে চিন্তার উদ্রেক করেছে যারা, তারা বহু যোজন ব্যবধানে, দুইটি দীপাগ্রভাগে অবস্থিত বড় বড় দুইটি লাইট হাউস। বিপুল দুর্গম, ভয়াবহ সুন্দরবন তাদের হাঁটুর নিচে পড়ে আছে, আর স্পর্ধাভরে আকাশে মাথা তুলে সাদা-কালোর ডোরাকাটা বিরাট দুইটি লাইট হাউস। মানুষের তৈরি, কিন্তু মানবাতীতের ইঙ্গিত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেলায় একদিন হোগলার চালার নিচে রাত্রি যাপন করছিলুম। একধারে গুটিকয় পুরুষ, অন্য ধারে তিন-চারজন মহিলা। অনেকেই অনেকের নিকট অপরিচিত। অথচ একই চালার নিচে।
বাইরের জ্যোৎস্না, হোগলার ফাঁক দিয়ে ভেতরের আঁধার পাতলা করে দিচ্ছে। বহু যাত্রীর ছাউনি বনের ধারে। মাঝরাতে সেখান থেকে সহসা সমবেত কণ্ঠের এক আর্তনাদ ভেসে এলো। অমনি চারদিক থেকে গুঞ্জন উঠলো, বুঝি বাঘ এসেছে। ধর্ম বিশ্বাসীদের সংখ্যাই বেশি। তারা অনেকে বললো, "বাঘ ফি বছরেই আসে, মানুষও ধরে নেয় না। বাবা কপিলমুনি এই বিধান করে গেছেন। আজও তা উপেক্ষিত হয়নি।"
একেবারে কো-এডুকেশন। কারো চোখে ঘুম নেই। এই রকম পরিবেশে গল্প খুব জমে। জমলোও। ও হরি, কেবল বাঘের গল্প। অথচ অন্য জিনিস নিয়েও তখন গল্প চলতে পারতো। বুঝলুম, কপিল মুনির শাসনাধীনে এসে আমরা রসবোধ হারিয়ে বসেছি। লাইট হাউস দুটি আমার মনে বেশ রোমান্টিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। বললুম, তলায় সোঁদরবন, দিনরাত বাঘ ভালুকের হামলা, এর ভেতর মানুষ থাকে কি করে। উত্তর দিলেন এক মহিলা—"নিতান্তই দ্বীপচরের বনবাসী। কয়েকজন লোক মশাল জ্বালিয়ে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে সম্বৎসরের খোরাক দিয়ে আসে। লোকগুলি সারা বছরে তাই খায়। উপরে খায় উপরে থাকে, তলায় নামে না।"
"বেশ ত জানেন আপনি। আপনার স্বামী বুঝি জাহাজ কোম্পানীর বড় অফিসার। আপনি বুঝি সেই জাহাজে কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছেন; আর লাইট হাউসগুলোকে স্টাডি করেছেন," এই কথাগুলো তাকে বলতে পারতুম; কিন্তু রাত্রিকাল বলে কথা বাড়ালুম না।
মেলায় নেমে আমার এক নতুন উপলব্ধি হয়েছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো বহু যুগ আগেকার এক দৃশ্য। সে দৃশ্য প্রাগৈতিহাসিক সময়ের। মহামুনি কপিল তখন এইখানে তপস্যা করতেন। দক্ষিণে দিক-দিগন্ত প্রসারিত সীমাহীন বারিধি। অতলস্পর্শী লবণাক্ত জল এইখানে আছড়ে পড়তো। বিশাল পুরুষ কপিল কমণ্ডলু হস্তে এসে সেই জলে হস্তপদ প্রক্ষালন করতেন। তারপর তেজোদ্ভাসিত বদনমণ্ডলে তাপের কঠোরতা মাখিয়ে সগর্বে পদচারণা করে ধ্যানের আসনে গিয়ে বসতেন। সামনে সীমাহীন নীলাম্বু, পশ্চাতে গভীর গহন বনরেখা। এই অসীম নিঃসঙ্গতার মধ্যে বসে তিনি ধ্যানের গহনতায় ডুব দিতেন।
দুটো একটা বাঘ গভীর বন থেকে মাঝে মাঝে জলপান করতে এসে (লোনা জল পানে তারা নিশ্চয়ই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল) দূরে দূরে থেকে তাকে নিরীক্ষণ করত, তারপর সভয়ে তাঁর দিকে চাইতে চাইতে আবার বনাভ্যন্তরে প্রবেশ করত। শুনলুম সমুদ্রে এখানে কোনোকালেই ঢেউ উঠে না, আজও উঠেনি। কোনোদিন ঢেউ হয়তো ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। তাঁর অলি সঙ্কেতে একেবারেই স্তব্ধ হয়ে আছে।
শোনা যায় তিনি খুব রাগী ছিলেন। তাঁর বিদ্যুৎনেত্র দিক-দিগন্ত ভেদ করে সাগরের একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াতেন না, দিগন্তের পর দিগন্ত ভেদ করে তাঁর দৃষ্টি ক্ষিপ্রগতিতে বঙ্গোপসাগর ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত হতো। ছোট ছোট ঢেউগুলি তাঁর পা দুটি ধুয়ে দিত। খানিক বিলম্ব করে তিনি আবার আসনে গিয়ে বসতেন। তাঁকে নিয়ে এই স্বল্পপরিসর বালিময় বেলাভূমিটুকু একটি লাইট হাউসের মতই জ্বলজ্বল করতো। আজও দেখে মনে হলো, পুণ্যার্থী মানবগণের তীর্থ-সলিল উত্তরণের এ একটি লাইট হাউস। দিশেহারা, দিকহারা, কুলহারা মানুষ অনেক দুঃখক্লেশ ভোগ করে এখানে এসে উপস্থিত হয়। কেন? কিসের আশায়? এর জবাব দেওয়া সহজ নয়।
পথে ও পথের প্রান্তে
এইবার গোড়ার কথা বলছি।
সামান্য কিছু পোঁটলাপুটলি বেঁধে গাড়িতে চাপলুম। খুব ভিড় ছিল না। যাত্রীরা কোনমতে একরূপ ঠাঁই করে নিয়েছিল। কিন্তু ঝামেলা বাধাল ডেইলি প্যাসেঞ্জারের দল। তারা আসবে ঠিক শেষ মুহূর্তে, অথচ প্রাত্যহিক অভ্যাসের ক্ষিপ্রতায় নিজের জন্য হাজার ভিড়েও জায়গা ঠিক করে নেবেই। প্রত্যেকের হাতেই একটা কিছু দ্রব্য—সওদা করে এনেছে, রাতে ও প্রাতে রান্না হবে; কাল সকালে খেয়ে গাড়িতে উঠবে। ইলিশ মাছের দিনে থাকে ইলিশ মাছ, সেদিন ছিল প্রত্যেকের হাতে একজোড়া করে কপি। এদের মধ্যে এই একটা সাধারণ ধর্ম চোখে পড়ল, কারো জন্য এদের কারো সহানুভূতিও নেই বিরাগও নেই। একজন হয়ত শতজনের বাধা নির্লিপ্তভাবে উপেক্ষা করে গাড়ির কামরায় এসে ঢুকেছে। পরের জন ঢোকবার সময় সে-ই দিল প্রথমে বাধা। অথচ সে বাধা উপেক্ষা করে শেষের জন ঢুকে যেই তার পাশে বসলো, অমনি দুজনের মাঝে জমে গেল হৃদ্যতার আলাপ। তারপর যেই তৃতীয়জন ঢুকতে পা দিয়েছে, অমনি দুজনাতে মিলে জায়গা নেই, অন্য গাড়িতে যান বলে প্রবল বাধা দিতে থাকে। এসব বাধা ঠেলে এক প্রৌঢ় উঠে এলো, বাধাদানকারীদের মাঝে বসে গল্প জাঁকিয়ে তুললো, কিন্তু একটু পরে যেই আরেকজন উঠতে যাবে, সে উঠে গিয়ে মারমুখো হয়ে দরজা আগলে দাঁড়াল।
গাড়ি চলার বিশ মিনিটের মধ্যেই কোনো এক ছোটো স্টেশনে সে নেমেও গেল, কিন্তু নেমে অন্ধকারে পা ফসকে গড়াতে গড়াতে একেবারে খানায় গিয়ে পড়ে আর কি; হাতের কপি-জোড়াটি হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু তার চেয়েও বড় দুঃখ এই যে একটু আগে যারা তার সঙ্গে পরম হৃদ্যতার সঙ্গে আলাপ করছিল, তাদের সে কি হাসি! ভারি নিঃসঙ্গ মনে হলো বেচারাকে। হয়ত এরই সঙ্গে এদের কেউ কেউ একই অফিসে কলম পেষে। রেলে না হয় কোনো সদাগরি অফিসে। গাড়ি চললো। এবার কান গেল মাড়োয়াড়িদের কোলাহলের দিকে। কিন্তু একটা লোক তখনো হেসে চলেছে। হাসছে, আর টুকরো টুকরো কথা বলছে—"গোড়ার দিকটা দেখতে পাইনি মাইরি। আমি যখন চাইলুম, তখন দেখি বেটা গড়াচ্ছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। চাল মেরেছিল; বলে কিনা কপির দাম দশ আনা! আমার ছ' আনারটার চাইতে কোন দিক দিয়ে ভালো, বলতে পারো? যাক কপি তো হাত থেকে খুলে গেল। চেয়ে দেখি বেটা গড়াচ্ছে আর হাত দুটো এইরকম এইরকম করছে—"
সে-রাতে ডায়মন্ডহারবারে এক বাড়িতে গিয়ে উঠলুম। আমার কেউ নয়। সহযাত্রীর আত্মীয় তারা। বাড়িটাকে মনে হলো ভয়ানক নিঃসঙ্গ। খোলা মাঠে দ্বিতল অট্টালিকা। পুরুষদের অনেকে বিদেশে চাকরি করে। যারা তা করে না, তাদেরও সকাল থেকে অনেক রাত অবধি চোখে দেখবার উপায় নেই। ভোজনের আহ্বানকে উপেক্ষা করলুম। উপর থেকে দুগ্ধ ফেননিভ শয্যা এসেছিল, তার পাশে ছিন্ন
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment