শত্রু
সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক অন্ধকার রাত্রে, নটা বাজার কিছু পরে, জেমস্তভোর ডাক্তার কিরিলভের একমাত্র পুত্র ডিপথিরিয়া রোগে মারা গেল। ডাক্তারের স্ত্রী সবে মাত্র আশাভঙ্গের প্রথম আঘাতে মৃত সন্তানের শয্যাপাশে নতজানু হয়ে বসেছে, এমন সময় সদর দরজার ঘণ্টাটা সজোরে বেজে উঠল।
ডিপথিরিয়ার ভয়ে বাড়ির চাকরবাকরদের সকাল থেকেই বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিরিলভ যে অবস্থায় ছিল, পরনে শুধুমাত্র সার্ট আর বোতাম খোলা একটা ওয়েস্টকোট, সেই অবস্থাতেই, এমনকি চোখের জলে ভেজা মুখ ও কার্বলিক এসিডের দাগ-লাগা হাতদুটো না মুছেই, দরজা খুলতে গেল। হলঘরটা অন্ধকার, আগন্তুককে দেখে এইটুকু শুধু বোঝা গেল, সে মাঝারি লম্বা, তার গলায় একটা সাদা মাফলার জড়ানো আর তার প্রকাণ্ড মুখটা এমন বিবর্ণ যে মনে হল তাতে যেন ঘরের অন্ধকারটাও ফিকে হয়ে গেছে...
‘ডাক্তারবাবু কি বাড়ি আছেন?’ ঘরে ঢুকেই সে প্রশ্ন করল।
‘হাঁ, আমি আছি,’ কিরিলভ উত্তর দিল। ‘আপনি কি চান?’
‘যাক, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে বাঁচলাম!’ লোকটা হাঁফ ছেড়ে বলল। অন্ধকারে ডাক্তারের হাতের সন্ধান করে সাগ্রহে দুহাত দিয়ে চেপে ধরল। ‘সত্যিই বাঁচলাম...কী আর বলব! আপনার সঙ্গে আমার আগেও দেখা হয়েছে। আমার নাম আবোগিন... গুনুচেভদের ওখানে আপনার সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়েছিল, মনে আছে? গত গ্রীষ্মে? আপনার দেখা পেয়ে সত্যিই খুব খুশি হলাম। এক্ষুনি আমার সঙ্গে আসতে হবে। দয়া করুন...আমার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। আমার গাড়ি হাজির রয়েছে।’
আগন্তুকের হাবভাব কথাবার্তা থেকে বোঝা যাচ্ছিল সে খুব একটা মানসিক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। তার নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন, গলার আওয়াজ কাঁপছে, কথাও বলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মনে হচ্ছে যেন আগুনে পোড়ার হাত থেকে কিংবা পাগলা কুকুরের তাড়া খেয়ে কোনক্রমে সে এইমাত্র বে'চে এসেছে। শিশুর মত কোন রকম ভনিতা না করে সে কথা কয়ে যাচ্ছে ভাঙা ভাঙা অসম্পূর্ণ তার কথা আতঙ্কগ্রস্ত ব্যক্তির মত। মাঝে মাঝে এমন কথাও বলছে আসল বক্তব্যের সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক'ই নেই।
‘আপনাকে বাড়িতে পাবো না ভেবে তো ঘাবড়িয়েই গিয়েছিলাম,’ সে বলে চলল। ‘কী দুর্ভাবনায় যে এতটা পথ এসেছি...কোটটা পরে ফেলুন, দোহাই আপনার, চলে আসুন ঘটনাটা এই: পাপচিনস্কি আলেক্সান্দ্র সেমিওনভিচ আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আপনিতো তাকে চেনেন। আমরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা কয়ে চায়ের টেবিলে গিয়ে চা পান করতে বসেছি হঠাৎ, আমার স্ত্রী বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠে সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল। আমরা দুজনে ধরাধরি করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তার রগ দুটোয় এমোনিয়া ঘষে দিলাম...জল ছিটলাম, কিন্তু মড়ার মত অসাড় হয়ে সে পড়ে রয়েছে। আমার তো ভয় হচ্ছে, শিরাটিরা ছিড়ে গেল না তো? দয়া করে চলে আসুন...ওর বাবাও অমনি শিরা ছিড়ে মারা গেছেন...’
কিরিলভ চুপচাপ শুনে গেল। ভাবটা যেন সে রুশ ভাষা বোঝেই না।
আবার যখন আবোগিন পাপচিনস্কির ও তার শ্বশুরের কথা তুলে অন্ধকারে কিরিলভের হাতটা সন্ধান করতে লাগল, ডাক্তার মাথাটা পিছন দিকে হেলিয়ে নির্বিকারভাবে ধীরে ধীরে বলল: ‘অত্যন্ত দুঃখিত, আমি যেতে পারছি না। পাঁচ মিনিট আগে আমার...
আমার ছেলে মারা গেছে।’
‘না না, সে কি!’ এক পা পিছু হটে আবোগিন অস্ফুটম্বরে বলল। ‘হা ভগবান, কী দুঃসময়ে আমি এসে হাজির হলাম। উঃ, আজকের দিনটা কী দুর্দিন...বাস্তবিক, মনে রাখার মত। কী যোগাযোগ...কেউ কি এ কথা ভাবতে পেরেছিল!’
সে দরজার হাতলটা ধরল, তার মাথাটা নুয়ে পড়েছে যেন দারুণ ভাবনায়। স্পষ্টতই সে ঠিক করতে পারছে না চলে যাবে, না আসার জন্যে ডাক্তারকে অনুনয় চালিয়ে যাবে।
‘শুনুন!’ কিরিলভের সার্টের আস্তিনটা ধরে আবেগভরে সে বলতে লাগল। ‘আপনার অবস্থাটা সম্পূর্ণ বুঝছি। এই সময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমি যে কত লজ্জিত তা ভগবানই জানেন। কিন্তু আমার উপায় কী বলুন। আপনি নিজেই ভেবে দেখুন, আমি কোথায় যাই। আপনি ছাড়া এ অঞ্চলে আর একজনও ডাক্তার নেই। দোহাই আপনার, একবার আসুন। নিজের জন্যে আমি আপনাকে ডাকছি না...আমার নিজের কোন রোগ হয়নি!’
দুপক্ষই কিছুক্ষণ চুপচাপ। কিরিলভ আবোগিনের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। দু-এক মিনিট ওইভাবে থেকে হলঘর থেকে ধীরে ধীরে সে চলে এল বসার ঘরে। অন্যমনস্কভাবে ও অনিশ্চিত যান্ত্রিক পদক্ষেপে যেভাবে সে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল এবং ঘরে ঢুকে নেভানো বাতির ঢাকার কিনারটা যে রকম মনযোগের সঙ্গে টেনে সোজা করল, টেবিলের মোটা বইটায় যেভাবে চোখ বোলাতে লাগল, তা থেকে স্পষ্টই বোঝা গেল, সেই সময়ে অন্তত তার ইচ্ছা অনিচ্ছা কামনা বাসনা বলতে কিছুই নেই, সে তখন কিছুই ভাবছে না। হয়ত সে ভুলেই গেছে হলঘরে একজন আগন্তুক অপেক্ষা করছে। ঘরের ভিতরকার আবছা আলো ও নিস্তব্ধতা আরো বেশি করে যেন তার বিমূঢ়তা বাড়িয়ে দিল।
বসার ঘর থেকে পড়ার ঘরে যাবার সময় ডান পাটা যতটুকু তোলা দরকার তার চেয়ে বেশি তুলে সে দরজাটার জন্যে হাতড়াতে লাগল। তার সর্বাঙ্গে বিমূঢ় ভাব পরিস্ফুট। মনে হচ্ছে যেন অচেনা কোন বাড়িতে এসে পড়েছে কিংবা জীবনে এই প্রথম মদ্যপান করেছে আর তার অনভ্যস্ত প্রতিক্রিয়ায় হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছে। পড়ার ঘরের একটা দেয়ালে বইয়ের আলমারিগুলোর উপর চওড়া একফালি আলো এসে পড়েছে, আলোটা আর সেইসঙ্গে কার্বলিক এসিড ও ঈথারের উগ্র গন্ধ শোবার ঘর থেকে আসছে, শোবার ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা...টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে ডাক্তার বসে পড়ল, আলোর রেখা অনুসরণ করে বইগুলোর দিকে সে একবার তাকাল, তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে শোবার ঘরে চলে গেল।
এইখানটা, এই শোবার ঘরের ভিতরটা মৃত্যুর মত স্তব্ধ। এ ঘরের নগণ্যতম জিনিসটা দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে এখানে কী ঝড় বয়ে গেছে।
সেই ঝড় এখন ক্লান্ত একটা অবসাদে স্তিমিত। সব কিছু এখন স্থির নিশ্চল। একটা টুলের উপর একরাশি শিশি বোতলের মাঝখানে একটা মোমবাতি, ও দেরাজের উপর মস্ত একটা বাতিদান থেকে সারা ঘরটা আলোকিত হচ্ছে। ঠিক জানলার নিচে বিছানার উপর একটি ছোট ছেলে শুয়ে রয়েছে, তার চোখদুটি বিস্ফারিত, মুখে চকিত বিস্ময়। ছেলেটি স্থির নিস্পন্দ কিন্তু তার খোলা চোখদুটো প্রতি মুহূর্তে যেন কালি মেরে আসছে এবং ক্রমেই কোটরস্থ হচ্ছে। মা বিছানার পাশে নতজানু হয়ে বসে, শয্যাবস্ত্রে তার মুখটা ঢাকা, হাতদুটো দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে রয়েছে। ছেলের মত মাও নিস্পন্দ, কিন্তু তার হাতদুটোয় তার দেহের রেখায় না জানি কী অস্থিরতা স্তব্ধ হয়ে রয়েছে! সে যেন তার সমস্ত সত্তা দিয়ে লুব্ধ আগ্রহে বিছানাটা আঁকড়ে রয়েছে, মনে হচ্ছে তার অবসন্ন দেহের এই যে শান্ত স্বচ্ছন্দ ভঙ্গীটি অনেক কষ্টে সে আবিষ্কার করেছে, এটি সে হারাতে চায় না। কম্বল, ছোঁড়া কাপড়ের টুকরো, জলের গামলা, মেঝের উপরে গড়িয়ে পড়া জল, এখানে ওখানে ছড়ানো চামচ, ব্রাশ, সাদা চুনের জল ভর্তি' বোতল, এমনকি ঘরের বদ্ধ ও ভারি বাতাস-সবকিছুই যেন গভীর ক্লান্তিতে শ্রান্ত ও অবসন্ন।
ডাক্তার স্ত্রীর পাশে একবার দাঁড়াল। ট্রাউজারের পকেটে হাতদুটো চালিয়ে ঘাড়টা কাত করে তাকাল সন্তানের দিকে। তার মুখের ভাব নির্বিকার। দাড়িতে যে জলবিন্দুগুলো ঝিকমিক করছে তাতেই শুধু বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে সে কেঁদেছে।
অপ্রীতিকর যে বীভৎসতা মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত শয়নকক্ষে তার লেশমাত্র নেই। ঘরের ভিতরকার নিথরতায়, মায়ের ভঙ্গীতে, পিতার সর্বাঙ্গে পরিস্ফুট নির্বিকারত্বে—কী যেন ছিল যা প্রায় মনোহর, যা মনকে নাড়া দেয়। মানবীয় শোকের এই সুক্ষা অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্য এমনিতেই সহজবোধ্য নয়, বর্ণনাতীত তো বটেই। একমাত্র সঙ্গীতের মাধ্যমে
লগইন করুন? লগইন করুন
03 Comments
Karla Gleichauf
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
M Shyamalan
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment
Liz Montano
12 May 2017 at 05:28 pm
On the other hand, we denounce with righteous indignation and dislike men who are so beguiled and demoralized by the charms of pleasure of the moment