মুরগীর ছানা
মুরগী তার বাচ্চাকে ডেকে বলল, এই ছোঁড়া, অমন করে খোঁড়াচ্ছিস কেন রে?
বাচ্চা বলল, একটা কাঁটা ফুটেছে মা।
কেন, দেখে পথ হাঁটতে পার না। কেবল দস্যিপনা!
হ্যাঁ, দস্যিপনা! কাঁটাগুলো কেমন করে চোরের মতন লুকিয়ে থাকে, আর দেখ না দেখ, কুটস করে ফুটে বসে। ওদের দেখা যায় নাকি? বাচ্চা নাকী সুরে বলল।
না, দেখা যায় না! কই, আমাদের পায়ে তো ফোটে না।
বাচ্চা এবার সুযোগ পেয়ে মাকে চেপে ধরল, তোমাকে ক’দিন বলেছি মা, আমি চোখে ভালো দেখতে পাই না, আমাকে একটা চশমা এনে দাও। তা তুমি কিছুতেই দেবে না।
আহা-হা, কি কথার ছিরি! মুরগীরা আবার চশমা পরে কোনো দিন?
তবে ওরা পরে কেন? ওই-যে ও-বাড়ির ছোট্ট বাচ্চাটা, তার চোখেও এই এত্তো বড় একটা চশমা। আঃ, কি সুন্দর দেখতে! কেন, আমায় তুমি একটা দিতে পার না?
মা বলল, হারে পাগলা, ও যে মানুষের বাচ্চা। ওরা তো পরবেই। আর আমরা হচ্ছি মুরগী, আজ আছি কাল নেই। কথায় বলে মুরগীর প্রাণ! ওদের যখন খুশী হবে সাবাড় করে দেবে। আমাদের আবার চশমা। তোর কথা শুনে হাসব না কাঁদব!
কথাটা বলে ফেলেই মুরগী জিভ কাটল। ছি ছি, এইটুকুন বাচ্চার কাছে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। আছে নিশ্চিন্তে থাকুক, যে ক’টা দিন না জানে ভালো। আগে থেকেই শুনিয়ে লাভ কি?
বাচ্চাটা বাচ্চা হলে কি হবে, বিষম টনটনে! একটা কথাও ওর কান এড়ায় না। কোথায় কি ঘটছে না ঘটছে, চশমা না থাকলে কি হবে, সবই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। মা ভাবে, আহা, অবোধ শিশু, কিছুই বোঝে না। কিন্তু সে এরই মধ্যে অনেক কিছুই জেনে নিয়েছে। সাবাড় করা কাকে বলে, পুরোপুরি না বুঝলেও কিছু কিছু সে বুঝল। একদিন একটা মোরগকে ওরা কেটেছিল। উঃ, কি তার চেঁচানি। তারপর কতক্ষণ ঝটপট করে মোরগটা সেই-যে পড়ে রইল আর উঠল না। বাচ্চা পিট পিট করে সব কিছুই দেখছিল। তার বিষম ভয় করছিল। তারপর ক’দিন সে আর ঠিকমত ঘুমোতে পারেনি। এর নামই বোধ হয় সাবাড় করে দেওয়া।
মুরগীকে জিভ কাটতে দেখেই বাচ্চা বুঝল মা যেন কি কথা বলতে গিয়েও চেপে গেল। ব্যস আর তাকে পায় কে, কারা সাবাড় করে, কেমন করে সাবাড় করে আর কেনই বা সাবাড় করে? উহু, না বললে কিছুতেই ছাড়বে না সে! কি ছেলে বাবা, মায়ের কানের পোকা একেবারে খসিয়ে ছাড়ল।
একটু একটু করে বাচ্চাটা কথা আদায় করে নিল। বলব না, বলব না, করতে করতেও মাকে কিছু কিছু বলতেই হলো। একবার একটু বেফাঁস কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলে আর কি উপায় আছে। বাচ্চা আগে যা জানত আর এখন মার মুখে যা শুনল দুটোতে যোগ করে নিয়ে মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝল। আগে মনে করেছিল, ওই মোরগটা বুঝি কপাল দোষে অমন করে সাবাড় হয়ে গেল। আর এখন বুঝল, কপাল টপাল কিছু নয়। মোরগ-মুরগী যত আছে, সবারই এই একই দশা ঘটবে। দুদিন আগে আর পরে। তার মানে, সে আর তার মা, তারাও এ থেকে বাদ যাবে না। কি সর্বনেশে কথা! এমন কথা তো সে কোনো দিনই ভাবতে পারেনি।
চিন্তাটা ভারী হয়ে তার মাথার মধ্যে ঝুলতে লাগল। এক মুহূর্ত রেহাই দেয় না। এই একই কথা কত রকম করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে তার মার কাছে শুধোতে লাগল। মা বলল, রাখ বাছা, এসব কথা অতবেশী ভাবতে নেই। ভাবতে গেলেই জ্বালা। অদেষ্টে যা আছে, তাই হবে।
হুঃ, মার যেমন কথা! ভাবতে নেই বললেই কি আর না ভেবে থাকা যায়? তার খেতেও ভালো লাগে না, শুতেও ভালো লাগে না। কিছু ভালো লাগে না। এক দম চুপ মেরে থাকে। এমন ঠান্ডা স্বভাব আর তার কখনও দেখা যায়নি। মা বলে, হ্যাঁরে, তোর হলো কি? অসুখ বিসুখ করেনি তো?
সুখ আর কোথায় আছে? বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মা, যখন ওরা আমাদের সাবাড় করে, তখন খুব ব্যথা পাওয়া যায় না? তখন সবাই বুঝি খুব চেঁচায়, না গো? আমরা তো পায়ের তলায় একটু কাঁটা ফুটলেই বিষম ব্যথা পাই।
হা আমার কপাল। এখনও তুই সেই কথাই ভাবছিস?
না মা, বল না।
ব্যথা? ব্যথা কি না পেয়ে পারে?
বাচ্চা কি তা বোঝে না? ভালো করেই বোঝে, তবু জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা মা, আমরা যখন ব্যথা পেয়ে চেঁচাই, ওদের মনে একটু দুঃখ লাগে না?
দূর পাগল, মুরগী ব্যথা পেলে ওদের কি? ওদের দুঃখ লাগবে কেন?
তবে ওরা অত আদর করে আমাদের খাওয়ায় কেন?
মুরগীর মুখ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, খাইয়ে দাইয়ে আমাদের মোটাতাজা না করলে ওরা পেট ভরে মাংস খাবে কি করে? কিন্তু কথাটা বলতে গিয়েও সে কোনো মতে সামলে নিল।
মুরগী চেয়ে দেখল, ভেবে ভেবে ছেলেটা যেন একেবারে হাড্ডিসার হয়ে গেছে। ক’দিন ধরেই লক্ষ করেছে সে। কেনই বা সে ওসব কথা তুলতে গেল! ভাবল, দেখা যাক, ছেলেটার মনটা একটু অন্য দিকে ঘুরানো যায় কি না।
সে মাথা নাচাতে নাচাতে বলল, হ্যাঁরে ছেলে, তুই পোকামাকড় খাস না?
হ্যাঁ, খাই, খুব খাই।
কেন খাস?
বারে, খাওয়ার জিনিস খাব না? সৃষ্টিকর্তা তো আমাদের খাওয়ার জন্যই ওদের পয়দা করেছিল।
মুরগী একটু হেসে বলল, ওরাও তো এই কথাই বলে। বলে, মোরগ মুরগীরা নাকি ওদের খাওয়ার জন্যই পয়দা হয়েছিল।
বাচ্চা এবার একটু বিপদেই পড়ে গেল। তবু সে বলল, ওরা মিথ্যে কথা বলে, না মা?
কি জানি বাছা।
মাও এই কথা ঠিকমত জানে না। তবে?
কিন্তু আমরা যে ব্যথা পাই?
পোকমাকড়ও তো ব্যথা পায়?
বাচ্চা মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। মা আবার এ কি কথা বলছে।
দূর, এতটুকুন পোকামাকড়, ওদের আবার ব্যথা-বেদনা কি? এক কামড়েই শেষ।
মুরগী বলল, আরে বোকা, আমরাও তো মানুষের কাছে এইটুকুনই। সেই জন্যই তো ওরা আমাদের দুঃখ বোঝে না।
মুরগীর বাচ্চা এরপর আর কি বলবে। এত বড় বক্তা, কিন্তু তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোল না।
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments