মানুষের পরিচয়

স্তুদেনিৎসায়, স্তুদেনিৎসা কেন, সারা স্নেগোভেৎস অঞ্চলেই ওলিওনা স্তেফাকের ছেলে আন্দ্রেইয়ের মতো সুপুরুষ ব্যক্তি আর পাওয়া যাবে না।

তার সবকিছুই সুন্দর চলাফেরা,—তামাটে মুখের কাট, ধূসর তীক্ষ্ণ চোখদুটি, বাঁ ভুরুর বাঁকা ভঙ্গিমা সবই। ভুরুর ঐ বাঁকাভাবটির জন্য তার মুখে একটা বিস্ময় বা ঠাট্টার অভিব্যক্তি লেগে থাকে।

আন্দ্রেই স্তেফাক শুধু যে তার সৌন্দর্যের জন্যই খ্যাত তা নয়, তার মতো ফুলবাবুও আর কেউ নেই। পাহাড় অঞ্চলের কাঠের কলের ট্র্যাক্টরড্রাইভার সে, বয়স তার মাত্র উনিশ, কিন্তু সাজসজ্জা প্রসাধনের দিকে তার যা নজর, ভেরখভিনার নাম করা সুন্দরীরাও হার মেনে যায়। সবুজ কানাৎ দেওয়া সাদা পশমের জ্যাকেট, পুঁতির নক্সাকরা সার্ট, ফারের গুচ্ছ লাগান টুপি আর কাঁটা লাগান উঁচু পাহাড়ে জুতো—এই হল তার বেশবাস। হাঁটার ভঙ্গীটি বেশ হাল্কা, ধীরমন্থর। জামাকাপড় পরার কায়দায় একটা চেষ্টাকৃত অযত্নের ভাব।

ফিওদর স্ক্রিপ্‌কা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আন্দ্রেই, ব্যাপারটা কী বল তো, কাজের দিনে এরকম ছুটির দিনের সাজ কেন?’

‘কাজের দিন বলে আমার কাছে কিছুই নেই ভুইকু,[☆‌] সবদিনই আমার ছুটির দিন’, আন্দ্রেই বেশ গম্ভীরভাবে বলল।

আন্দ্রেই নাচে খুব কম সময়েই যোগ দিত, কিন্তু তবু সে কখনো কোনরকম পার্টি বা বিয়ের আসর বাদ দিত না। দেয়ালের ধারে দাঁড়িয়ে ঘাসের শীষ চিবতে চিবতে সে যেন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে নাচিয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকত।

মেয়েরা তো তার জন্য পাগল। কিন্তু আন্দ্রেই কাউকে বিয়ে করতে চাইলে বোধ হয় উত্তর দেবার আগে ব্যাপারটা অনেকক্ষণ ভাল করে ভেবে চিন্তে দেখে নিত। অনেক দীর্ঘনিঃশ্বাস চোখের জল ফেলেও শেষ পর্যন্ত কোন মেয়ে আন্দ্রেইকে বিয়ে করার ঝক্কি নিত না।

‘ওকে বিয়ে করলে ভোগান্তির শেষ হবে না,’ প্রবীণারা বলত, ‘সুন্দর লোককে বিয়ে করার অসীম দুর্গতি, তার উপর ওর আবার কথাবার্তা চোখের চাউনিও মোটেই সুবিধার নয়…’

আন্দ্রেই স্তেফাক সম্বন্ধে শুধু মেয়েরাই যে একথা বলে তা নয়। এমন কি গরুলিয়া—না ভেবে চিন্তে ঝট করে কারো সম্বন্ধে মন্তব্য করা তার স্বভাব নয়—সে পর্যন্ত দুঃখ করে বলে, ওলিওনার ছেলেটার আছে কেবল চেহারা আর জাঁক। আর কিছুই না।

গরুলিয়া একদিন স্নেগোভেৎস থেকে স্তুদেনিৎসায় ফিরছে।

খামারের পশুশালার জন্য যন্ত্রপাতি নিয়ে একটা লরী আসছিল। গরুলিয়া লরীতে উঠে পড়ল।

তখন মার্চের মাঝামাঝি, বরফ হঠাৎ গলতে সুরু করেছে। উপত্যকায় স্বল্প বৃষ্টি, ওদিকে পাহাড়ে দুদিন ধরে পাতলা বরফ মেশানো প্রবল ধারাপাত। চারদিক ঘোলাটে, ঝাপসা। ছোট ছোট পাহাড়ে নদীগুলো ফেপে ফুলে উঠেছে, পাৎলা কাঠের সাঁকোগুলো জলের ধাক্কায় কেপে কেপে উঠছে। বেজায় স্যাঁৎসে'তে, এমনকি ড্রাইভারের কামরাতেও ভেজাভেজা লাগছে।

গরুলিয়া ড্রাইভারের পাশে বসে ঠান্ডায় কাঁপছে। বাতাসে ক্যানভাস হুডের কানাৎটা পৎপৎ করে নড়ছে। গরুলিয়া তারই আওয়াজ শুনে চলেছে। তারপর এমনই কপাল, হঠাৎ ইঞ্জিনটা গেল বিগড়ে। ড্রাইভার তো গালাগাল করতে করতে গাড়ি সারাতে লাগল। সারানো সাঙ্গ হল যখন তখন কুয়াশায় ঢাকা সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ভেজা বরফের ভারি পর্দা আর গোধূলির অন্ধকার ভেদ করতে পারে গাড়ির হেড্‌লাইটের সে ক্ষমতা নেই। স্তুদেনিৎসা তখনো বহুদূরে।

অবশেষে গাড়ি তো চলল। পথটা ক্রমশই পাহাড়ের উপরে উঠে গেছে। ইঞ্জিনটা গজরাতে গজরাতে গাড়ি প্রাণপণ চেষ্টায় উপরে উঠেছে। গিরিদ্বারের দিকে যতই এগোতে থাকে, ততই হাওয়ার জোর বেড়ে যায়, বরফ ঘন হয়ে পড়তে থাকে।

গরুলিয়া দেখে চলেছে ড্রাইভার কী চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে ঐ আঁকাবাঁকা পাহাড়ে রাস্তা দিয়ে লরীটাকে নিয়ে যাচ্ছে।

ড্রাইভার কায়দা করে একেকটা বাঁক ফেরা মাত্রই গরুলিয়া বাহবা দিয়ে একটা শব্দ করে ওঠে। এই বয়সেও গরুলিয়া অন্যদের যে কোন কাজের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হতে সক্ষম, বিশেষ করে যে কাজ সে নিজে পারে না।

তারপর এল গিরিদ্বার। লরীটা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে গুঁড়ি মেরে এগোতে লাগল। হেড্‌লাইটের আলোটা যেন জলে গুলে গিয়ে তেলচিটচিটে হয়ে উঠেছে। খালি ডাইনে বাঁয়ে নড়ছে। হঠাৎ সেই আলোয় অন্ধকারের বুকে একটি মানুষের শরীর ফুটে উঠল। লোকটি লরীর দিকেই এগিয়ে আসছে। রাস্তা ছেড়ে একেবারে খাদের ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

‘এরকম দিনে কে বেরতে পারে?’ গরুলিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

ড্রাইভার ব্রেক চেপে ধরে গাড়ি থামিয়ে দরজাটা খুলল। ইঞ্জিনটা থামার সঙ্গে সঙ্গেই গরুলিয়ার কানে এল গিরিদ্বারে হাওয়ার তুমুল গর্জন।

‘শুনছেন,’ গরুলিয়া চোঁচিয়ে বলল, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’

‘বেশি দূরে নয়,’ শান্ত কণ্ঠে জবাব এল, ‘বসতিতে যাব।’

‘কিন্তু আপনি লোকটি কে?’

‘আমায় চিনতে পারছেন না?’

লোকটি লরীর দিকে এগিয়ে এল। গরুলিয়া তীক্ষ। দৃষ্টিতে দেখতে লাগল।

‘আরে, আন্দ্রেই যে!’

‘হ্যাঁ, আমিই ভুইকু। আচ্ছা, আসি তাহলে!’

‘এমন দিনে হঠাৎ বসতিতে চলেছ, ব্যাপার কী?’

‘কিছুই নয়, একটু মজা করতে চলেছি।’

‘মরগে, যাও!’ গরুলিয়া জ্বলে উঠে থুক করে থুতু ফেলল। ‘তোমার মতো হতভাগাকে আটকান দায়!’

আন্দ্রেই হেসে উঠল। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে যেন মনের অনেক বাধা কাটিয়ে উঠে আস্তে আস্তে বলল।

‘তবে শুনুন ব্যাপারটা, স্তেপান ওস্ত্রোভ্‌কার ওখানে চলেছি।’

গরুলিয়ার কান খাড়া হয়ে উঠল। বুড়ো স্তেপানের মেয়েটি বছর খানেকের বেশি খুব ভুগছে। অনেক দিন উজগরদে হাসপাতালে ছিল, এখন তাকে কিয়েভে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অপারেশন হবে। অপারেশনে বিশেষ কিছু ফল হবে বলে মনে হয় না, কিন্তু তবু একবার শেষ চেষ্টা, যদি মেয়েটিকে বাঁচান যায়। রোগটা তার সাংঘাতিক।

‘ওস্ত্রোভ্‌কার কাছে কেন?’ গরুলিয়া জিজ্ঞেস করল।

‘এমনি,’ আন্দ্রেই শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘গ্রাম সোভিয়েতে আমি থাকতে থাকতেই বুড়োর নামে একটা টেলিগ্রাম এল। সব ঠিক আছে, গাফিয়া একেবারে ভাল হয়ে যাবে।’

‘তাই নাকি? সত্যি?’

‘হ্যাঁ, সত্যি।’

‘তুমি বুঝি টেলিগ্রামটা নিয়ে চলেছো?’

‘অফিসে টেলিগ্রামটা তো সেই সকাল পর্যন্ত পড়ে থাকবে?’ আন্দ্রেই বলল, ‘বুড়োর তো এমনিতেই রাত কাটতে চায় না… আচ্ছা, চলি তাহলে!’

জলে ভেজা টুপির কানাৎটা চোখের উপর টেনে দিয়ে আন্দ্রেই চলতে সুরু করল।

স্তুদেনিৎসার বাকি আট কিলোমিটার পথটায় গরুলিয়া আর ড্রাইভার একটিও কথা বলল না। ড্রাইভার থেকে থেকে খালি লরী থামিয়ে উইন্ড স্ক্রীনের বরফ মোছে। লরীটা গ্রামের পথ দিয়ে চলতে সুরু করার পর গরুলিয়া প্রথম কথা বলল।

‘মিখাইলো!’ ড্রাইভারের উদ্দেশে এমন ভাবে চেঁচিয়ে উঠল যেন সে অনেক দূরে রয়েছে।

‘কী বলুন কমরেড সেক্রেটারী,’ ড্রাইভার জবাব দিল।

‘বলছিলাম কী,’ গরুলিয়া চিন্তান্বিতভাবে বলল, ‘অন্যের দুঃখ বা আনন্দের সময়েই মানুষের সত্যিকার পরিচয় পাওয়া যায়। সে পরিচয়ে কখনো ভুল হয় না!’

[☆‌] খুড়ো—বয়সে যারা ছোট তারা বড়দের এই বলে ডাকে।

স্নেগোভেৎসের হোটেলে, মাৎভেই তেভেলেভ, অনুবাদ: শুভময় ঘোষ ও সুপ্রিয়া ঘোষ, আঁকিয়ে: আ তারান, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice