শ্বেত তিস্সা
পনের বছর আগে শ্বেত তিস্সা তার দুই ছেলে পিওতর আর সেমিওনকে টেনে নিয়েছে।
বসন্তের বন্যার সময় তারা ভেলিকয়ে বিচ্কভোর দিকে কাঠ ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল। পাথুরে চড়ার গায়ে পড়ে হিমশীতল জলের তখন কী গর্জন আর ফেনা ছড়ান! সংকীর্ণ কার্পেথিয়ান উপত্যকা সে গর্জনে ভরে গেছে আর হৃৎসুলের ভেলাওয়ালা জলের ঝাপটায় রামধনু রং তুলে তরতর করে ভেলা নিয়ে চলেছে—এত জোরে যে ঘোড়ায় চড়েও তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চলে না।
দুপাশের গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা আর ঘরকুনো বুড়োরা ভেলা দেখতে নদীর পাড়ে ছুটে এসেছে।
‘সা-মা-ল!’ ভেলাওয়ালাদের উদ্দেশে চেঁচাচ্ছে বুড়োরা।
তারা নিজেরাই একদিন শ্বেত তিস্সার বুকে ভেলায় কাঠ নিয়ে পাড়ি দিয়েছে।
‘সা-মা-ল!’ ছোট ছেলেরা বুড়োদের প্রতিধ্বনি তুলছে।
তারাও একদিন ভেলা নিয়ে পাড়ি জমাবে।
ভিজে জুবজুবে ভেলার মাল্লারা কিন্তু আগে থেকেই সতর্ক হয়ে রয়েছে। পা ফাঁক করে সামনে একটু ঝুঁকে তারা দাঁড়িয়ে আছে, যেন পাহাড়ের ঢালু বেয়ে স্কি-খেলুড়েরা নামছে। নদীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে চোখ তাদের বেজায় টনটন করছে, ভেলার মাথায় বসান লম্বা লম্বা হালগুলো তারা শক্তহাতে ধরে রেখেছে।
ভেলাগুলো একটা আরেকটার পিছনে ভেসে চলেছে, মাঝখানে কেবল কয়েক মিনিটের ব্যবধান। নদীর বুকের উপর ঝোলা ছোট্ট সাঁকোগুলোর তল দিয়ে ভেলাগুলো সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মাল্লারা তখন উবু হয়ে বসে পড়ছে, কাঠের সাঁকো প্রায় তাদের মাথা ঘেঁষেই বেরিয়ে যাচ্ছে। সাঁকো পেরন মাত্র তাদের শরীরগুলো এক ঝটকায় আবার খাড়া হয়ে উঠছে।
পিওতর আর সেমিওনের ভেলার সঙ্গে আবার একটা ছোট্ট ভেলা লাগান ছিল। আসল ভেলাটা চব্বিশটা ফারগাছের গুঁড়ির তৈরী। তার পিছনে বাঁধা রয়েছে অন্যটা। সামনের ভেলাটার মাঝখানে দুটো গুঁড়ির মধ্যে একটা দুমুখো তক্তা গুঁজে দেওয়া হয়েছে। তার উপর ঝুলছে সবুজ ফ্ল্যানেলের পাড় দেওয়া দুটো সাদা জ্যাকেট আর ক্যানভাসের একটা থলে, তাতে রয়েছে কিছু বেকন আর কর্ণরুটি।
ভেলা চলেছে পিওতর আর সেমিওনের গ্রাম পার হয়ে। ছোট ভাই সেমিওন, মুখে তার বসন্তের দাগ, বয়স নেহাৎ কম, হঠাৎ দেখতে পেল বাচ্চা কোলে একটি মেয়ে তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে মেয়েটি ভেলা দেখাবার জন্য বাচ্চাটিকে দুহাতে তুলে ধরেছে। চোখে রোদ পড়ায় তার চোখ কুঁচকে গেছে।
‘এই পিওতর!’ সেমিওন তার ভাইকে ডেকে বলল, ‘ঐ যে তোমার ওলিওনা য়ুরকোকে নিয়ে তীরে দাঁড়িয়ে!’
‘ওসব এখন দেখতে হবে না!’ পিওতর ধমকে বলল, বউ আর দুবছরের ছেলেটাকে দেখার ইচ্ছে অবশ্য তারও ছিল। জলে রোদের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। জীর্ণ টুপির কানাৎটা পিওতর চোখের উপর আরো টেনে নামিয়ে দিল।
ঠিক পাঁচমিনিট পিছনেই আসছে ওদের বাবা, বুড়ো মিখাইলো বেলানিয়ুক তার ভেলা নিয়ে। এখনো সে খুব বুড়ো হয়ে পড়েনি, তবে তিস্সার যত ভেলার মাল্লাদের মধ্যে সেই সেরা। ছোট্টখাট্ট লোকটিকে তাই সবাই শ্রদ্ধা করে। পঞ্চান্ন বছর বয়স হলে কী হবে, তার মতো সাহসী আর দক্ষ মাল্লা আর নেই। নদী কোথায় হঠাৎ নিচে নেমেছে, কোথায় কোন পাথর আর চড়া লুকিয়ে আছে সব তার নখদর্পণে। এই ছোট্ট ভীষণ নদীর মনমেজাজ তার ভাল করেই জানা, যেন এক বাড়িতেই দুজনে থেকেছে। কখন তার সঙ্গে ছলচাতুরী করতে হবে, কখন কিছু গায়ের জোরি, তা সবই তার জানা। কোন জায়গায় বিশ্বাস করে স্রোতের মুখে ভেলা ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, সে কথাও তার অজানা নয়। তিস্সাকে কি সে ভালবাসে? সে কথা নিয়ে বুড়ো বেলানিয়ুক কখনো মাথা ঘামায়নি। বউয়ের কাছ থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে নেয়, প্রেমিকার কাছ থেকে দয়িতকে, তীরের কবরখানাগুলোয় প্রতিবছর বাড়িয়ে চলে ক্রুশের সংখ্যা, এমন নদীকে কি ভালবাসা যায়। অবশ্য বেলানিয়ুকের পরিবারের প্রতি সে সদয়। বেলানিয়ুকের বাবা আর ঠাকুর্দা দুজনেই মারা গেছে স্বাভাবিকভাবে। আর মিখাইলোও তো দিব্যি নির্ঝঞ্ঝাটে ছেলেদের নিয়ে কাঠের গুঁড়ি ভাসিয়ে চলেছে। নদীর সত্যিকার পরিচয় মিখাইলো জানে। তাই তিস্সার সঙ্গে তার সম্পর্কটা অত্যন্ত সহজ সরল, নিছক কাজের সম্পর্ক।
ছেলেদের বেলায় মিখাইলো খুব কড়া। তাদের নিয়ে গর্বও খুব, যদিও মুখ ফুটে কাউকে সেকথা সে বলে না। ছেলেদুটি যেমনি সাহসী তেমনি খাটতে পারে। বউ যখন মারা গেল মিখাইলোর তখন কতই বা বয়স, কিন্তু তবু সে আর বিয়ে-থাওয়া না করে নিজের হাতেই ছেলেদের মানুষ করেছে। গ্রীষ্মের উষ্ণ দিনে ছোট ছোট ছেলেদুটির হাত ধরে সে চলে যেত নদীর ধারে। ঢেউয়ে ধোয়া চ্যাপ্টা একটা পাথর খুঁজে নিয়ে তার উপর ছেলেদের দাঁড় করিয়ে দিত, তারপর কনকনে ঠান্ডা জলে তাদের স্নান করত।
অন্য কোন ভেলার মাল্লা এ কাজ করলে তাকে নিয়ে কম হাসিঠাট্টা হত না, মেয়েলি কাজের জন্য তার একটা নামও দেওয়া হত। কিন্তু শ্বেত তিস্সার রাজা স্বয়ং এ কাজ করলে সে কথা আলাদা—বনরক্ষকরা বেলানিয়ুককে ঐ নামেই ডাকে।
বড় ছেলে পিওতর যখন বিয়ে করে তার ঘর ছেড়ে কনের বাড়িতে গিয়ে উঠল, মিখাইলোর তখন খুব খারাপ লাগে। মনের ঈর্ষা সে মনেই চেপে রাখল, সুন্দরী হাসিখুসি পুত্রবধূটিকে সে মোটে দেখতে পারত না—ছেলেকে সে কেড়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেই ঘৃণাও সে লুকিয়ে রাখল। নাতির মুখ দেখেও ওলিওনার প্রতি বুড়োর রাগ দূর হল না। পিওতরের বাড়ি মিখাইলো খুব কমই যায়, তাও যায় যখন নাতিকে আর কোন ভাবে দেখার উপায় থাকে না, তখনই। সে থাকে সেমিওনের সঙ্গে। বুড়োর মনে ভীষণ ভয়, কোনদিন কোন সুন্দরী এসে তার ছোট ছেলেটিকেও না নিয়ে যায়।
তাও নিল, কিন্তু কোন সুন্দরী মেয়ে নয়, শ্বেত তিস্সা। তাও আবার একসঙ্গে দুছেলেকেই।
গ্রাম পেরিয়ে একটা জোরাল বাঁক ঘুরেই পিওতরদের ভেলা পড়ল গিয়ে একেবারে স্রোতের মাঝখানে। উপত্যকাটা এখানে বেশ চওড়া, অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সংকীর্ণ গিরিবর্তের মুখ থেকে নদীটা তার উপর এসে পড়ছে প্রবল বেগে।
‘ডাইনে সামলে। নইলে স্রোতে টেনে নেবে!’ পিওতর ভাইয়ের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠে সারা শরীরের ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল হালের উপর।
সেই স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন ব্যাপার। দুহাতের মাংসপেশি যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। জল থেকে উঠে আসা ঠান্ডা আর বাতাস সত্ত্বেও ভীষণ গরম লাগছে, হাঁপ ধরে যাচ্ছে। শাদা ফেনা ওঠা ঢেউগুলো ভেলার দুধারে ভীষণ জোর বাড়ি মারছে। কাঠের গুঁড়িগুলো পায়ের তলে সশব্দে লাফিয়ে উঠছে, আড়কড়িতে তারা যেন বাঁধা থাকতে চায় না। কিন্তু পিওতর আর সেমিওন, মাথা ঠান্ডা করে খুব বুদ্ধি খাটিয়ে ভেলাটাকে কিছুটা শান্ত জলের দিকে নিয়ে এল।
আর কয়েক মিটার মাত্র বাকি এমন সময় হঠাৎ এক তুমুল তোলপাড় শব্দ। জলের নিচে লুকনো তীক্ষ পাথরে লেগে ভেলা হঠাৎ থেমে গেছে। পিওতর আর সেমিওন কিছু বোঝার আগেই পিছনে বাঁধা ছোট ভেলাটা খাড়া হয়ে উঠে বাঁধন ছিড়ে সোজা একেবারে বড় ভেলাটার উপর এসে পড়ল। ভেজা কাঠের গুঁড়ির উপর দিয়ে গড়িয়ে পিওতর আর সেমিওনের পিঠে লাগাল এক মারাত্মক ধাক্কা। পিওতর আর সেমিওন ছিটকে পড়ে গেল। ছোট ভেলাটাও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে আবার জলের উপর পড়ল। ছেলেদুটির সার্ট মুহূর্তের জন্য বাতাসে চমকে উঠে সেই উজ্জ্বল উন্মত্ত জলের অতলে সব মিলিয়ে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই মিখাইলো বেলানিয়ুকের ভেলাটা গিরিবর্তের ভিতর দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল। বিপর্যয়ের চিহ্নগুলো বুড়োর চোখে পড়ল, তার সঙ্গীরও। একটা খোঁটামতো পাথরের চারপাশে একটা আধভাঙা ভেলা পাক খাচ্ছে, যেন ঐ পাথরটাতেই সেটাকে নোঙর করে রাখা হয়েছে। কয়েকটা ভেজা কাঠের গুঁড়ি খাড়া পাড়ের কাছে ভেসে গিয়ে
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments