দেয়ালে ঝুলছিলো রঙিন পাখিরা
[দুবাংলায় ছোটোকাগজ অসংখ্য, পছন্দেরও কমতি নেই—তালিকা দীর্ঘ, আবার প্রিয় সম্পাদক, প্রিয় কবি, প্রিয় গল্পকার, প্রিয় প্রবন্ধকার কিংবা চিত্রকর অনেকেই রয়েছেন; তবুও কেন জানি বিশেষ করে সেইসকল দিনের কথা মনে হয়, যখন ছোটো ছিলাম, মিশনারী স্কুলে পড়তাম, পঁচিশে ডিসেম্বর এলে বাবা দিতেন নতুন বছরের ডায়েরি আর শিশুবার্ষিকী, বাবা আজ নেই তবু সেসকল স্মৃতিমধুর দিনগুলি শীতের আবেশে ছড়িয়ে থাকে, ছড়িয়ে থাকে ছোটোকাগজ করার মূল প্রেরণাশক্তি দেয়াল পত্রিকার গল্পও। বন্ধুরা কে কোথায় ছড়িয়ে গেছে যার যার আপন কর্মে, বছরের কোনো কোনো দিনে কদাচিৎ দেখা হয়, এভাবেই বহমানতার ভেতর দিনগুলি। ছেলেবেলায় যে সপ্তবর্ণা দিয়ে পথচলা, সেই সময়ের পর অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে, নির্মাণ হয়েছে অনেক গল্প—থলিতে জমেছে নিজের ছোটোকাগজ করার অভিজ্ঞতা; বারুদ, শিশির, বঙ্গসভা, রূপকথা—এর সকলই একান্তই নিজের আকাঙ্ক্ষা, প্রচারবিহীন, বিজ্ঞাপনহীন পথ চলা। প্রিয়পাঠক, এ রচনা কেবলই ছেলেবেলার একটি দেয়াল পত্রিকার গল্প, যেখানে বেড়ে উঠেছে লেখকের শৈশব, কৈশোর। এখানে ছলহীন-বলহীন পত্রিকার প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে নিজের ভালোবাসার কাগজ করার দুঃসাহস নিয়ে পথ চলার প্রথম পর্বটি সম্পন্ন হলো, এখানে নিয়ম-নীতির ছুরি-কাঁচি তাই নিষ্প্রয়োজন, বিচারহীনভাবে সেদিনের স্মৃতি রমোন্থনের আখ্যান এটি]
ফেলে আসা গ্রাম...
আমার ভেসে আসা গেঁওয়াফল মধু-গোলপাতার নদী
পালতোলা টাবুরি, ঢাকি-শিবসার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসে অকৃত্রিম সুন্দরবনের সুর ও স্বর; সেই স্বরের খেলায় কখনো বনবিবি, গাজীকালু চম্পাবতীর পালায় পালায় বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরেরা বড়োদের মতো করে যেনো একদা মেতে উঠেছিলো আপন ভুবনে। সে ভূবনজুড়ে ছেলেবেলার উৎসবমুখর ঋতুগুলো। পাড়ার বড়োরা ছোটোকাগজ করে, প্রভাতীতে ছন্দ করে চিঠি লেখে, বড়োরা উৎসবে কবিতার সংকলন প্রকাশ করে, বিকালে মাঠে আড্ডা বসে ছড়ার—আর হেমন্তে নবান্ন এসে মৌ মৌ করে নতুন ধানের গন্ধে ভাসে, মাতোয়ারা গাঁয়ের উদোম আকাশ; পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয় খেলার আয়োজন, দাবাখেলা, কুইজ উৎসব, ক্যারাম খেলা, ক্রিকেট খেলা, ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা আর দুর্গা পূজায় তো কথা নেই মোড়ে কয়েকটা ব্যানার টানানো, স্কুলের নোটিশ বোর্ডে লেখা চেয়ে দূর্গা পুজার সংকলনে লেখা পাঠানোর আহ্বান! দেখে একেবারে চোখ ছানাবড়া, এ তো ভালো আয়োজন, তবু লিখতে পারিনা। লিখতে হবে তবে, এ যেন এক নতুন খেলা। বাবার হাতে ছেলেবেলায় নতুন নতুন কতোরকম বই পেয়েছি, পত্রিকা পেয়েছি সেসব বই-পত্রিকার ফিরিস্তি যেনো শেষ হবে না এখানে, তো যা চিন্তা সেটিই করতে বসা। প্রথম বারে যখন দেখা পেলাম পত্রিকার বিজ্ঞাপন, তবে তো লেখা জমা দেওয়া উচিত। লিখতে হলে কতো কী জানতে হয়, কতোরকম বুদ্ধি থাকতে হয়—সেকল বড়োরা বলতে থাকে। বাড়িতে বাবার চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রটি মাটির বৈঠকখানায়। সেখানে তো যত্তো রাশিয়ান বই ছিলো ছোটোদের তা গোগ্রাসে গিরতে দারুণ আনন্দ পেতাম, সেই আনন্দই যেনো লিখতে অনুপ্রেরণা দিলো। লিখতে শুরু করলাম, সে বছরে লেখাটি পাঠাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল, কিন্তু কী আশ্চর্য—দেরিতে লেখা পেলেও আরো একটি পত্রিকা সে বছর ডিসেম্বর মাসে বের হলো, উন্মুক্ত সাহিত্যপত্র ‘বরষা’। একদিন সকালে বটতলার নীচে দাঁড়িয়ে, অপেক্ষায় ছিলাম লঞ্চে উঠবো, গীর্জার স্কুল বেশিদিন ছুটি দেয় না, পঁচিশে ডিসেম্বর বড়োদিন, সে উৎসবও আমার শৈশবের অমূল্য স্মৃতি। বড়োদিনের উৎসবে যাওয়ার জন্য এ যাত্রা। শীতের সকাল, পরিচিত এক যুবক এসে জানতে চাইলো আমার বাবার নাম, ঘাড় নেড়ে সায় দিতে বললো, আমার সঙ্গে এসো, এগিয়ে গিয়ে বাজারের একটা দোকানে দেখলাম নতুন পত্রিকা(বরষা, সম্পাদক শৈলজানন্দ রায়), কমলেশ রায় নামের একজন জানালেন তিনি ছড়াকার, ছড়া লেখেন; বললেন, তোমার লেখা বেরিয়েছে, দারুণ ব্যাপার। নাও লেখক কপি।
১৯৯৫ সাল বছরের শেষ মাস, হাতে নিই বরষা, শাদা ভাঁজে ভাঁজে অপূর্ব মায়া জড়ানো।
কতো কতো কবিতা, নতুন বেরিয়েছে এ পত্রিকা, তাতে নিজের লেখা, আনন্দ যেনো থরে থরে বয়ে যায়।
দেয়াল লিখন যেনো স্মৃতিময় দুপুরের মতো ঝলমলে...
আমাদের দেয়ালে ঘাসেরা বাসা বাঁধে
চড়ুইয়ের ঘুলঘুলিতে নাচে সাপের ফণা...
ছোটোকাগজ—ছোটো আন্দোলন সেসব কিছু নয়, লেখার আনন্দ, ছাপার আনন্দ।
সময়কে ঘড়ি দিয়ে মাপা যায়, আবার স্মৃতি সময় দিয়ে মাপা গেলেও তা থাকে মস্তিষ্কের ভেতর জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো যেখানে প্রতি মুহূর্তে রিফাইন হয় স্মৃতি নামক স্টোর। সে স্টোরে সহজে কিছু রাখা যায় না সংরক্ষণ করে, কেননা—রবিবাবুর ছুটি গল্পের ফটিক চক্রবর্তীর মতো সেও বড়ো দুরন্ত, মানে না সে বাঁধা কোনো। সেই কারণে যে স্মৃতি এমনিতেই রমোন্থিত হয়, তা অকৃত্রিম কাঁচাসোনা।
‘দেয়াল পত্রিকা’ ছোটোকাগজের লড়াইয়ের প্রথম ধাপ কিংবা ভেঙে ভেঙে তৈরি হওয়ার যাত্রাপথ। যদিও ছোটোকাগজ কর্মীদের এ বিষয়ে দ্বিমত, তবু একথা বলতেই হয়—সময়ে যারা ছোটোকাগজ করেন তাদের সে পথে একটি অমোঘ দর্শন থাকা জরুরি, সেই দর্শনটি কী এবং কেন এমন আরো একটি প্রশ্ন এসে যায় সমুখে! যেহেতু আমার ছোটোকাগজের পথ মোটেও কণ্টকমুক্ত নয়, সমকালে ছোটোকাগজ যেটিই প্রকাশ করি না কেন, সেটির শুরু সেই অজপাড়াগাঁতেই, যেখানে শিবসার ঢেউ এসে কেওড়াগাছের ছাল ভিজিয়ে রাখতো, বিকালে বিষন্ন ঢেউ ফেরার মতো করে শাদা বকের সারি সারি উড়ে এসে ডাকাডাকিতে মত্ত হতো—কোনো কোনো শিকারি সেখানে ফাঁদ পেতে ধরতো সেই শফেদ বক, যা হরিপদ মুচির পছন্দ হয়নি কখনো, ফলে সে তার লেঠেল কুকুর লালুকে ডাকতো, অ্যাই লালু দ্যাখ তো, কে গেলো বাঁদালে? হরিপদ কাকা হারিয়ে গেছে, কালের ঢেউ তুলে কোথায় সে হারালো কে জানে, কেবল তার প্রিয় লালু জ্যোৎস্না ঠেলে ঠেলে রাতগুলো পাহারা দেয় শিবসার খেয়াঘাট এবং শাদা বকের সারি সারি দলগুলো।
গ্রামে থাকা সেই সময়ে আমার সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রটিকেই প্রেরণাস্থল বলে ধরে নিতে পারি। কেননা ছেলেবেলা দুরন্ত, দুরন্ত উদোম দুপুর, চলছে সে দিনগুলো হেঁটে, যেখানে নেই দলবাজী, যেখানে নেই ছাপাকালির কোনো গন্ধ আবার ছাপাখানার ভূত বলে কেউ বলতে পারবে না, এটা আমরা করিনি। সাহিত্যচর্চার প্রথম ধাপটি সেক্ষেত্রে আমি জানি গ্রামে থাকার সময়ের দেয়াল পত্রিকা।
সপ্তবর্ণা যেভাবে শুরু হয়েছিলো...
বরষা-তে লেখা ছাপা হওয়ার পর যেন নিজের ভেতর বালকসুলভ আনন্দ আর তা বারংবার দেখাতেই ছিলো স্বস্তি এবং অসম্ভব আনন্দ, এমন আনন্দ আমার ছিলো না পূর্বে। বন্ধুদের মধ্যে জেনে গেলো সকলে, বাংলার শিক্ষক হাশেম মোল্লা ডেকে পাঠালেন, জানতে চাইলেন,
—কবিতা লিখিস?
—জ্বী, স্যার!
—কী লিখিস দেখবো! আগামী সপ্তাহের কালচারাল ক্লাবে কবিতা শোনাবি, তোর কবিতা চাই।
—জ্বী, স্যার; যাবো?
—হ্যাঁ, যা— তবে কবিতা চাই কিন্তু...
তারপর আমার ছেলেদের মতো ভাবতে থাকি, কবিতাটা কী লিখবো, কীইবা হবে না লিখলে? সেসব কথাকে তুড়ি মারলাম পরের দিন লিখে ফেললাম জিজ্ঞাসা, সে কবিতার হদিস এখন আর আমার নিকট নেই। কেননা, নদীকূলে বাস করা মানুষেরা সর্বদাই ভাসমান। কখন রোদ আসে আর কখন বা নামে বৃষ্টি সে উপায়ও নেই জানার, ফলে নদীর ঢেউ একদিন রাতে আছড়ে পড়ে ভাসিয়েছে সব, শৈশবের ডায়েরি, টুকলু সম্পাদক অমল দার (অমল ত্রিবেদী) চিঠি কিংবা পোস্টকার্ডে সুকুমার বড়ুয়ার কয়েকটি বাক্যেও মতো তিন কার্টন চিঠি, ছোটোকাগজের মেলা সব ভেসে গিয়েছে। এখন সেসব স্মৃতি, ছোটোকাগজ কর্মীরা যখন বড়ো বড়ো সংগ্রামের কথা বলেন কিংবা চিন্তাগত জায়গাকে স্পর্শ করতে চান, তাদের সঙ্গে আমার চিন্তা ও ভাবনার অশেষ অমিল। তারা ভাবেন গোষ্ঠী, তারা ভাবেন গোষ্ঠীর বাইরেও তারা সেরা এবং আলাদা, ফলে তাদের সাহিত্যচর্চা নিয়ে আমার
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments