মণিকাঞ্চন

স্নেগোভেৎস হোটেলের সামনে একটা কাঠের গুঁড়ির উপর বসে আছে এখানকারই ছুতোর মিখাইলো স্মুজেনিৎসা।

বয়স ষাটের কাছাকাছি। পাকাচুল ছোটখাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লোকটি। মুঠির সমান ছোট্ট মুখটি দাড়ি কামাবার সময় জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে। প্রত্যেক কাটার উপরে সযত্নে সিগারেটের কাগজ আঁটা।

দিনটা রবিবার। স্মুজেনিৎসা তাই তার পুরনো-ধাঁচের চোঙা ট্রাউজার আর পিছনে নীচের দিকে গোল করে কাটা ছোট কোটটা পরেছে। এক সময়ে স্যুটটার রঙ ছিল কালো কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ে লেগেছে সবুজের ছোপ।

স্মুজেনিৎসা এক ঘণ্টার উপর ঐভাবেই বসে আছে। সোজা গির্জা থেকে এসেছে। নিশ্চয়ই কারো জন্য অপেক্ষা করছে।

জুন মাসের শেষদিক। পরিষ্কার দিন। সাব্‌-কার্পেথিয়ার সমতলে এখন ভ্যাপসা গরম। চারপাশে পাহাড়ের ঘের দেওয়া স্নেগোভেৎস কিন্তু মাত্র স্বল্প উষ্ণ। গতরাত্রের বৃষ্টির ফলে চারদিক ঝকঝক তকতক করছে। দূরের সব কিছুকে মনে হচ্ছে হাতের কাছেই।

পাহাড়ের গায়ের ঘাসে ঢাকা মাঠগুলো হোটেলের উঠোন থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। গিরিদ্বার পর্যন্ত এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া রাস্তার দুপাশে বেড়ার উজ্জ্বল সাদা খুঁটি।

রাস্তাটা আর পাহাড়ের পায়ে চলা পথগুলোও নানা রঙে সেজেছে, পাহাড়ে গ্রামগুলোর মেয়েরা সব বিচিত্র রঙের রুমাল স্কার্ট আর এপ্রন পরে স্নেগোভেৎসের দিকে আসছে।

কিন্তু এমন সুন্দর দিনের আনন্দ স্মুজেনিৎসার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেছে। সংসারের সঙ্গে তার বনছে না, দুঃখ তার হৃদয় কুরে খাচ্ছে।

স্মুজেনিৎসার দৃঢ় প্রত্যয়, এতদিন পর্যন্ত সে কোন ভুল কাজই করেনি।

খুব বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হুঁশিয়ার ব্যক্তি সে। সব কিছু অনেক বার ভাল করে দেখেশুনে মেপেঝুঁকে তবে সে কাজ করে। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক কাজের আগে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সবাই জানে হুঁশিয়ার লোকের প্রতিই ভাগ্য সুপ্রসন্ন।

মিখাইলোর যখন অল্প বয়স তখন এই একই ভাগ্য এক ছুতোর কারখানার মালিক ভাসিলি স্ত্রিজাকের কাছে তাকে পাঠিয়ে দেয় কাঠের কাজ শেখার জন্য। স্ত্রিজাক তাকে তার ছাত্র হিসেবে নেয়।

কাপড়ের আলমারি বল, খাট বল, সবই স্ত্রিজাক বানাতে জানত, কিন্তু কফিন ক্রুশ আর গোরস্থানের বেড়া ছাড়া সে কখনো অন্য কিছুতে হাত দিত না।

এই জাতীয় ব্যবসার বিরুদ্ধে মিখাইলোর কিছু বলবার ছিল না। কিন্তু যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে আবার কফিন ক্রুশ গোরস্থানের বেড়া দুচক্ষে দেখতে পারত না। স্মুজেনিৎসাকে সে তাই হাঁকিয়ে দিল।

ওস্তাদ তখন তার হতাশ চেলাকে বলল, ‘কিচ্ছু ভেব না! আরে নতুন কাপড়ের আলমারি আর খাট কেনার মুরদ আর কজনেরই বা থাকে বল। লোকে বাপের কাছ থেকে পুরনোটাই পায়। কিন্তু কফিন আর ক্রুশ! এজিনিস বাবা, প্রত্যেকেরই চাই, সারা জীবনে একবার হলেও চাই আর ঐ মেয়েটার কথা ভেবো না! আমরা তোমায় আরেকটি খুঁজে দেব এখন!’

এখন আর সে মেয়ের নাম পর্যন্ত স্মুজেনিৎসা মনে করতে পারে না।

স্ত্রিজাকের মেয়ে গাফিয়াকে সে বিয়ে করেছে। বুড়ো স্ত্রিজাক মারা যাবার পর কারখানার মালিক হয়ে বসেছে।

এতে তার কোন ভুল হয়নি, সে তো আপনারাও বুঝতে পারছেন।

স্মুজেনিৎসা একাই কাজ করেছে, কোন সহকারীর তার দরকার হয়নি। ধনদৌলত সঞ্চয়ের চেষ্টা সে কখনো করেনি। চায়নি বলে নয়, ঠিক বাগিয়ে উঠতে পারেনি। এখানেও তার কোন ভুল হয়নি। কাঠের ব্যবসায়ী শান্দর বেইলা স্নেগোভেৎসে দোতলা এক বাড়ি তুলেছিল। ভেবেছিল নিজের জন্যই বুঝি তুলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িটা পার্টির জেলা কমিটির হয়ে গেল। স্মুজেনিৎসার ছোট্ট বাড়ি কিন্তু এখনো স্মুজেনিৎসারই আছে।

এমন কি তার কারখানার মাথায় কোনও সাইনবোর্ডও নেই। প্রতিবেশী দর্জি স্তেপান ল্যুব্‌কার মতো নামের লোভ তার নেই। ল্যুব্‌কা কতবারই না সাইনবোর্ড বদলাল। অস্ট্রো-হাঙ্গারিয়ানরা যখন এখানে ল্যুব্‌কা তখন জার্মান ভাষায় সাইনবোর্ড লাগায়। তারপর চেক ভাষায়। সেটাকেও বদলে হাঙ্গারিয়ান ভাষায় আরেক সাইনবোর্ড টাঙাতে হল। এখন সোভিয়েত আমলে ল্যুব্‌কা একেবারে নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। এর পিছনে কত টাকা ঢালতে হয়েছে স্মুজেনিৎসা তা হিসেব করে দেখেছে।

স্মুজেনিৎসার যখন চল্লিশ বছর বয়স তখন তার স্ত্রীর একটি মেয়ে হয়। ডাক্তার বলেছিল গাফিয়ার আর কখনো ছেলে বা মেয়ে হবে না।

মিখাইলো তো ঘাবড়ে গেল: সে মারা গেলে তার কারখানায় ক্রুশ আর কফিন তবে কে বানাবে? কে চালিয়ে যাবে তার কাজ? মেয়ে দিয়ে তার কী হবে, সে ছেলে চায়…

বেশিদিন তার দুঃখ রইল না, শীগ্‌গিরি এই হতাশা সে কাটিয়ে উঠল। কারখানায় ঢুকে একটা ভাল দেখে শুকনো পাটা বেছে নিয়ে সে বসে গেল বাচ্চার জন্য দোলনা-খাট বানাতে, নোটারীর ওখানে যেমনটি দেখেছে ঠিক সেইরকমটি।

এই অসাধারণ আসবাবটি তৈরী করতে গিয়ে তো স্মুজেনিৎসা ঘেমেটেমে অস্থির। কয়েকদিন ধরে সে খাটটির পিছনে লেগে রইল। মেয়ে যাতে অন্তত দশবছর বয়স পর্যন্ত ঐ খাটেই শুতে পারে সে ব্যবস্থা তাতে রইল।

খাটটি তৈরী হবার পর কারখানার মাঝখানে বসিয়ে সে দুপা পেছিয়ে গিয়ে সেটার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। সজীব মানুষের জন্য এই তার প্রথম কাজ। সেই ক্রুশ আর কফিনের টুকরোর গাদার মধ্যে খাটটাকে অত্যন্ত সজীব আর উৎফুল্ল মনে হতে লাগল, ঠিক যেন মরা পাথরের বুকে একটি সবুজ ঘাসের শীষ।

এক অদ্ভুত দুঃখ স্মুজেনিৎসার মনটাকে দলিত করে আবার মিলিয়ে গেল।

মেয়েটির নাম রাখা হল আন্না। বাদামী চোখ আর কোমল পেলব মুখাবয়ব নিয়ে সে বড় হয়ে উঠল। আন্না শুনল জীবনটা নানারকম পাপ আর বাধায় ভরা। ফলে সে একটু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তাকে শেখান হল ভগবানকে ভয় করবে আর বাবামার কথার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলবে না।

কিন্তু ভগবান তো সর্বদা ব্যস্ত, তাই পাদরীমশাই আর বাবামাই আন্নাকে ভগবানের হয়ে সবকিছু শেখাতে লাগলেন।

গাফিয়া—যেমনি স্বল্পভাষী তেমনি বিপুলকায়—মেয়েকে নিয়ে সে গির্জায় যেত। সেখানে অনেকক্ষণ ধরে আধখানা দেয়াল জোড়া একটা কালো বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত, বোর্ডের গায়ে নানারকম সব ভয়াবহ ছবি আঁকা। পৃথিবীতে পাপ করলে নরকে কী শাস্তি ভোগ করতে হবে তার ফিরিস্তি। মেয়েটি ভয়ে আঁতকে উঠত। কিন্তু তবু সে পাপ করত...সে পাপী কারণ গির্জায় দাঁড়িয়েও তার মনটা থেকে থেকেই ভগবানকে ছেড়ে মাঠের দিকে দৌড় মারত ... হাঁসের পালকে ঢাকা সবুজ মাঠ—স্নেগোভেৎসের ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া ছোট্ট নদীটির তীরে। ওখানে হাঁস পালা হয়। ছোট ছোট মেয়েরা ঐ মাঠের উপর গোল হয়ে বসে কচি গলায় গান গায়, নেকড়ার তৈরী পুতুলদের দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়ায়। ব্যাপারটা পাপে ভরা হতে পারে কিন্তু মোটেই ভয়াবহ নয়।

স্মুজেনিৎসা তো মহাখুসী, মেয়ে তার কেমন বাধ্য লক্ষ্মী।

মনে মনে সে স্বপ্ন দেখতে লাগল, আন্না একদিন বড় হবে, তার বিয়ে দিতে হবে। বেশ নির্ভরযোগ্য সচ্ছল অবস্থা ছেলের সঙ্গেই আন্নার বিয়ে দেবে। কিন্তু সে বহুদূরের কথা, এখন তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

কিন্তু একদিন সকালে গাফিয়া ঘুম থেকে উঠে তার স্বামীকে বলল: ‘মিখাইলো, দেখ দেখ, আন্না কেমন করে ঘুমচ্ছে।’

মিখাইলো তার পালকের বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে খালি পায়ে ঘষটাতে ঘষটাতে দোলনা-খাট্টার কাছে এগিয়ে গেল।

খাটটা তখন পায়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে, যাতে না দোলে।

আন্না সারা শরীর মেলে দিয়ে শুয়েছে। তার ছোট্ট পাদুটো খাটের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।

‘ছোট হয়েছে,’ স্মুজেনিৎসা বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল।

আজই প্রথম তার খেয়াল হল, মেয়ে তার বারো পার হয়েছে। আর পাঁচ বছর পরেই বিয়ের বয়স হয়ে যাবে।

কারখানার এক কোণে দোলনা-খাটটাকে তারা নিয়ে গেল। আন্নাকে পালকের গদি পাতা বড় খাট দেওয়া হল। ভাসিলি স্ত্রিজাকই এককালে ঐ খাটে শুত। স্মুজেনিৎসা আর

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice