পরিশেষ হিসেবে

অক্টোবরের এক সুন্দর দিনে ভোরবেলা আমি স্নেগোভেৎস ছেড়ে চলেছি। দিনের এই প্রথম ঘণ্টায় পাহাড়ের উপরে জাঁকিয়ে বসেছে হেমন্তের ঠুনকো কুয়াশার পর্দা। মনে হচ্ছে হঠাৎ নড়লে বা চেঁচিয়ে উঠলে চারপাশের সবকিছু টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে, জেগে উঠবে এক শুভ্র রূপোলি শব্দের বিচিত্র তরঙ্গ।

কাজ শেষ হয়ে গেছে। আমায় উজগরদ নিয়ে যাবার জন্য নিচে, হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আলোটা না জ্বালিয়েই ভোরের আধো আলো আধো অন্ধকারে আমার পাণ্ডুলিপি বাক্সে ভরে নিলাম। পাতাগুলোর ক্ষীণ খস্‌খস্ আওয়াজ কানে পৌঁছল, মনে হল ওরা যেন নিজেদের মধ্যে কানাকানি করছে।

আবার মনে পড়ল তাদের কথা, যাদের সঙ্গে গিরিদ্বারের কাছের জেলার এই ছোটো হোটেলটায় এ কয়দিন একসঙ্গে থেকেছি। তাদের গলার স্বর এখনো কানে বাজছে। আমার কাছে তারা তাদের ভাবনা চিন্তা প্রকাশ করেছে, তার ফলে হঠাৎ পরিচয় পেয়েছি সরল মানুষের হৃদয়ের শান্ত সৌন্দর্যের। সেই সৌন্দর্য আমাদের আনন্দ দেয়, বিরাট প্রান্তরে একটুখানি আলোর হাতছানির মতো সে আমাদের খুসী করে তোলে, বুঝতে পারি এই সৌন্দর্যই হল জীবন, আমাদের সকলের জীবন।

স্নেগোভেৎস এখনো ঘুমিয়ে। হোটেলের অতিথিরাও ঘুমে মগ্ন। এরা অধিকাংশই নতুন, আমার অপরিচিত। এদের মধ্যে চারজন হচ্ছে লরী ড্রাইভার। মলদাভীয়া থেকে পাহাড় পার হয়ে এতটা পথ এসেছে বিখ্যাত কার্পেথিয়ান বীচকাঠের জন্য। আর আছেন এক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনান্ট কর্ণেল। এখন তিনি উজগরদে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বক্তা। এছাড়াও ঘুমচ্ছে টেলিফোন মেকানিকরা, দূরের গ্রামগুলিতে টেলিফোন বসানর কাজে তারা এসেছে। একেবারে শেষ বিছানাটায় কম্বলে মাথা মুড়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে ইভান শেকেতা, পাসেকির কাঠুরে সে। কয়েক বছর পর তার সঙ্গে দেখা হল। বুড়ো ভাসিল য়াৎসিনা আর তার মেয়ে আন্নাকে নিয়ে গল্প লেখার সময় তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ইভান কিন্তু আগের মতোই আছে—ছিপছিপে, পাৎলা, সুদর্শন, উদ্ধত। গতকাল রাত্রে সে তার বউ আন্না য়াৎসিনাকে স্নেগোভেৎসের হাসপাতালে নিয়ে এসেছে, তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম আসন্ন।

ঘুমন্ত অতিথিদের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি, “নতুন দিন সুরু হবার পর মনের কোণে লুকনো কোন চিন্তা এরা পরস্পরের কাছে প্রকাশ করবে কে জানে, কোন নতুন ‘অলৌকিকের’ বার্তা বয়ে আনবে সেই দিন? কী বলবে এরা? এদের হৃদয়ের কোন অনুভূতি আমার আর জানা হয়ে উঠবে না?”

হোটেল ছেড়ে যাব বলে মন খারাপ হয়ে গেল। যদিও ভাল করেই জানি জীবন সর্বত্রই রয়েছে, সবখানেই রয়েছে জনগণ। জানি, বই হল জীবনেরই মতো, কোথাও শেষ দাঁড়ি টানা যায় না...

স্নেগোভেৎসের হোটেলে, মাৎভেই তেভেলেভ, অনুবাদ: শুভময় ঘোষ ও সুপ্রিয়া ঘোষ, আঁকিয়ে: আ তারান, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice