লেখক গ্রিন—আলেক্সান্দর স্তেপানভিচ গ্রিনেভস্কির মৃত্যু হয় ১৯৩২ সালের জুলাই মাসে, প্রাচীন ক্রিমিয়ায়—প্রাচীন বাদাম গাছের বনাকীর্ণ এক ছোট শহরে। গ্রিনের জীবন ছিল কঠিন। সে জীবনের মধ্যে সব কিছুই যেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যা গ্রিনকে একজন অপরাধী কিংবা হীন কূপমণ্ডক করে তুলতে পারত। এই বিষণ্ন প্রকৃতির মানুষটি যে কীভাবে যন্ত্রণাদায়ক অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন কল্পনার প্রতিভা, অনুভূতির বিশুদ্ধতা ও সলজ্জ হাসিকে অকলঙ্কিত অবস্থায় বহন করে আনেন তা দুর্বোধ্য।

বিপ্লব-পূর্ব সমাজব্যবস্থায় যে-ধরনের মানবিক সম্পর্ক ছিল আলেক্সান্দর গ্রিনের জীবনী তার বিরুদ্ধে কঠোর দন্ডবিধান। সেকালের রাশিয়া গ্রিনকে নিষ্ঠুর পরস্কারে পুরস্কৃত করে—শিশুকাল থেকেই ছিনিয়ে নেয় বাস্তবতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা। পরিমণ্ডল ছিল ভয়াবহ, জীবন দুর্বিষহ। তা ছিল বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ডদানের বর্বর প্রথার সামিল। গ্রিন প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু বাস্তবতার প্রতি অবিশ্বাস তাঁর সারা জীবন থেকে যায়। তিনি সর্বদাই তা থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেন, কেননা তাঁর মতে প্রাত্যহিকতার ‘গ্লানি ও আবর্জনা’ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে দূরন্ত স্বপ্নকে নিয়ে থাকা ভালো।

গ্রিন লিখতে শুরু করেন এবং তাঁর বইগুলিতে সৃষ্টি করেন প্রফুল্ল ও সাহসী লোকজন, সুরভিত বন-জঙ্গল ও সূর্যালোকে পরিকীর্ণ ধরণী, এমন এক ধরণী যা কোন মানচিত্রে নেই, আর আশ্চর্য আশ্চর্য ঘটনা, যা এক চুমুক সুরার মতো মানুষের মাথাকে ঘুরিয়ে দেয়।

মাক্সিম গোর্কি—তাঁর ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’ বইতে লিখেছেন: ‘আমি সব সময় লক্ষ করে দেখেছি যে লোকে চিত্তাকর্ষক কাহিনী পছন্দ করে একমাত্র এই কারণে যে তার ফলে অন্তত কিছু সময়ের জন্য তাদের পক্ষে কঠিন অথচ অভ্যস্ত জীবন ভুলে থাকা সম্ভব হয়।’ এই কথাগুলি গ্রিনের ক্ষেত্রে পুরোপরি খাটে ৷

তাঁর কাছে রাশিয়ার জীবন সীমাবদ্ধ ছিল সঙ্কীর্ণ ভিয়াকা শহরের মধ্যে, নোংরা কারিগরি বিদ্যালয়, রাত্রিনিবাস, সাধ্যাতীত শ্রম, কারাগার আর নিত্য ক্ষুধার মধ্যে। কিন্তু ধূসর দিগন্তরেখার ওপারে কোথায় যেন ঝলমল করছে আলো, সমুদ্রের বায়ু প্রবাহ আর প্রস্ফুটিত ঘাস ও লতাপাতায় তৈরি দেশ। সেখানে যারা বাস করে, তাদের গায়ের রঙ রোদের তাপে বাদামী—তারা সোনাখোঁচা, শিকারী, শিল্পী, অদম্য ভবঘুরে, নিঃস্বার্থ নারী, শিশুদের মতো আমুদে আর কোমল স্বভাবের, কিন্তু সর্বোপরি নাবিক।

গ্রিন আমাদের কাছে মীমাংসার জন্য এই প্রশ্ন রেখে ইহজগৎ থেকে বিদায় নিয়েছেন যে তাঁর মতো প্রমত্ত স্বপ্নদ্রষ্টা হওয়া আমাদের কালে দরকার আছে কি না।

হ্যাঁ, স্বপ্নদ্রষ্টার দরকার আমাদের আছে। এই শব্দটা সম্পর্কে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের মনোভাব পরিহারের সময় এসেছে। অনেকেই এখনও স্বপ্ন দেখতে শেখে নি, আর হয়ত সেই কারণেই কালের সমপর্যায়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না।

মানুষের কাছ থেকে যদি স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া হয় তাহলে যে-সমস্ত প্রবল প্রেরণার বশে সংস্কৃতি, শিল্প ও বিজ্ঞানের জন্ম, সেগুলির একটি, আর সুন্দর ভবিষ্যতের নামে সংগ্রামের বাসনা তিরোহিত হবে। তবে স্বপ্নকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না। তার কাজ হবে পূর্বাহ্ণে ভবিষ্যৎকে অনুমান করা এবং আমাদের মনে এমন একটা উপলব্ধি সৃষ্টি করা, যেন আমরা এখনই আছি সেই ভবিষ্যতের মধ্যে, আর নিজেরাও হতে চলেছি অন্য মানুষ।

সাধারণ ধারণা এই যে গ্রিনের স্বপ্ন ছিল জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। খেয়ালি কল্পনা-বিজড়িত এবং বুদ্ধির খেলা ছাড়া আর কোন অর্থই তা বহন করে না। সাধারণ ধারণা এই যে গ্রিন ছিলেন অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনীর লেখক—বিষয়ের ওপর তাঁর দখল ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি এমনই এক মানুষ, যাঁর বইগুলি সামাজিক তাৎপর্যবিহীন।

কোন লেখক আমাদের উপর কী রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, কী ধরনের অনুভূতি, চিন্তা ও আচরণের উদ্রেক করে তাঁর রচনা, সে রচনা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে কি না কিংবা কৌতুকপ্রদ শব্দসমাহার রূপেই তা পঠিত হয় এর দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাঁর তাৎপর্য।

গ্রিন তাঁর রচনায় যে-জাতের মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তারা সাহসী, শিশুর মতো সরল, আত্মসচেতন, নিঃস্বার্থ ও উদার।

এই অখণ্ড, চিত্তাকর্ষক মানুষগুলির পরিমণ্ডল রূপে আছে গ্রিনের প্রকৃতিসুলভ স্নিগ্ধ, সুরভিত বায়ু,—সম্পূর্ণ বাস্তব, আর তা এমনই মনোমুগ্ধকর যে হৃদয়কে স্পর্শ করে। গ্রিনের নায়ক-নায়িকারা যে জগতে বাস করে তা অবাস্তব মনে হতে পারে একমাত্র মনের দিক থেকে নিঃস্ব মানুষের কাছে। সমুদ্র উপকূলের লবণাক্ত ও ঈষদুষ্ণ বায়ুর প্রথম ঢোকে মৃদু মাথা ঘোরার অভিজ্ঞতা যার হয়েছে সে-ই সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করতে পারবে গ্রিনের প্রাকৃতিক চিত্রের মৌলিকতা, গ্রিনের বর্ণিত দেশগুলির বিস্তীর্ণ শ্বাসপ্রশ্বাস।

গ্রিনের লেখা কাহিনীগুলি লোকের মনে জাগ্রত করে গবেষক, নাবিক ও ভ্রমণকারীর স্বভাবসুলভ ‘সমন্নত বোধ’ এবং ঝুঁকি ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ বৈচিত্র্যময় জীবনের বাসনা। গ্রিনের রচনা পাঠ করার পর ইচ্ছে হয় গোটা জগৎটাকে দেখি—আর সে জগৎ গ্রিনের মনগড়া দেশ নয়, আলো, বনজঙ্গল, বন্দরের নানা ভাষা মুখরিত কোলাহল, মানবিক আবেগ-অনুভূতি ও প্রেম-প্রীতিতে পরিপূর্ণ সত্যিকারের, খাঁটি দেশ।

মহাসাগরের দ্বীপগুলিতে কোথাও এ ধরনের কোন দেশে যে প্রাণচাঞ্চল্য ও কলকোলাহল চলছে এই বিশ্বাস ছাড়া জীবন যাপন করা গ্রিনের পক্ষে ছিল দারুণ কঠিন, কখনও কখনও অসহনীয়।

বিপ্লব এলো। মানুষে মানুষে সম্পর্কের পুরনো নিষ্ঠুর ব্যবস্থা, শোষণ, সমাজ-বিচ্ছিন্নতা যা যা গ্রিনকে পীড়া দিত তার অনেক কিছুই, যা যা তাঁকে জীবন থেকে স্বপ্ন ও গ্রন্থের জগতে পলায়নে বাধ্য করে, সে সবই বিপ্লবের ফলে নাড়া খেল।

বিপ্লবের আগমনে গ্রিন আন্তরিক আনন্দ বোধ করেন, কিন্তু বিপ্লবের ফলে যে নতুন ভবিষ্যতের জীবনায়ন হওয়ার কথা, তার অপরূপ দূরপ্রান্ত তখনও স্পষ্ট চোখে পড়ছে না, অথচ গ্রিন ছিলেন সেই শ্রেণীর মানুষ যাঁরা চিরকাল অধীরতায় ভোগেন ৷

বিপ্লব যখন এলো তখন তার মধ্যে আনুষ্ঠানিক পারিপাট্য ছিল না, বিপ্লব এলো ধূলিধূসরিত নগ্নপদে, এলো শল্যচিকিৎসক হয়ে। বিপ্লব হাজার বছরের পুরনো, ছাতা-ধরা জীবনযাত্রার জমিতে লাঙ্গল চালিয়ে দিল।

গ্রিনের মনে হল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বড় বেশি দূরে, অথচ তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই, অবিলম্বে তাকে স্পর্শ করেন। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল বৃক্ষপত্রের মর্মর আর শিশুদের কলহাস্যে মুখরিত ভাবী শহরের নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নেন, ভবিষ্যতের লোকজনের গৃহে প্রবেশ করেন, তাদের সঙ্গে প্রলোভনজনক অভিযানে যোগ দেন, তাদের পাশে পাশে আনন্দে মুখরিত, অর্থবহ জীবন যাপন করেন।

বাস্তবে তখন-তখন এটা পাওয়া গ্রিনের পক্ষে সম্ভব হল না। কেবল কল্পনাই তাঁকে বয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হল বাঞ্ছিত স্থানে, অসাধারণ ঘটনা ও লোকজনের পরিমণ্ডলীতে।

অল্প বয়স থেকেই সঠিক কল্পনার উপর গ্রিনের অধিকার ছিল। তিনি যখন লেখক হলেন তখন মনে মনে কল্পনা করতেন অবাস্তব সেই সমস্ত দেশের, যেখানে তাঁর কাহিনীর ঘটনা সংঘটিত হত, কিন্তু সেগুলি কুহেলিকাচ্ছন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য না হয়ে হত উৎকৃষ্ট অনুসন্ধানলব্ধ, শত শত বার পদদলিত স্থান।

তিনি এই সমস্ত স্থানের বিশদ মানচিত্র আঁকতে পারতেন, পথের প্রতিটি বাঁক ও উদ্ভিদকুলের চরিত্র, নদীর প্রতিটি বাঁক আর বাড়িঘরের সঠিক অবস্থান উল্লেখ করতে পারতেন; সর্বশেষে, উল্লেখ করতে পারতেন কল্পজগতের পোতাশ্রয়ে অবস্থিত প্রতিটি জাহাজের, তাদের যাবতীয় সামুদ্রিক বৈশিষ্ট্যের এবং জাহাজের নাবিকদলের নিশ্চিন্ত ও আনন্দোচ্ছল প্রকৃতির।

গ্রিন লিখেছেন: ‘আমাকে উত্যক্ত করে ধরণী, তার বিশাল বিশাল সাগর-মহাসাগর, অসংখ্য দ্বীপ, আর গোপন রহস্যময়, নিদারুণ আগ্রহোদ্দীপক অঞ্চল।’

রূপকথা কেবল শিশুদেরই প্রয়োজন নয়, বয়স্কদেরও প্রয়োজন। রূপকথায় উদ্রিক্ত হয় উদ্দীপনা—মানবিক ও উন্নত আবেগ-অনুভূতির উৎস। রূপকথা আমাদের প্রশমিত হতে দেয় না, সর্বদাই দেখায় নতুন নতুন, ঝলমলে দূরপ্রান্ত, অন্য এক জীবন; রূপকথা উৎকণ্ঠিত করে তোলে এবং এই জীবনের প্রতি উদগ্র বাসনা জাগায়। এখানেই তার মূল্য এবং এখানেই মূল্য গ্রিনের রচনার সস্পষ্ট ও প্রবল আকর্ষণের,

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion