রাত্রের ট্রেনে যে সব যাত্রীরা রোম ছাড়তো, ফাব্রিয়ানা স্টেশনে তাদের ভোর পর্যন্ত থাকতে হতো তারপর সালমোনার মেল লাইন ধরবার জন্য হেরকালের ছোট্ট একটা লোকাল ট্রেনে করে তাদের যেতে হতো। দমবন্ধ করা, ধোঁযা ভবা একটা সেকেন্ড ক্লাস গাড়ি, ইতিমধ্যেই পাঁচজন লোক যার মধ্যে রাত কাটিযেছে, ভোরবেলায সেটাতে গভীর শোকের পোশাকপরা প্রায বেঢপ একটা বস্তার মতো এক মহিলাকে টেনে তোলা হলো। তার পিছনে হাঁফাতে হাঁফাতে, কাতরাতে কাতরাতে উঠে এসেছিল তার স্বামী ছোট্ট এতটুকু এক লোক। রোগাটে আর নিস্তেজ, মুখ তার মড়ার মতো ফ্যাকাশে, চোখগুলো ছোট ছোট আর চকচকে, তাঁকে কেমন যেন সলজ্জ আর অস্থির দেখাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত একটা সীটে বসে পড়ে সে, যে সব যাত্রীরা তার স্ত্রীকে টেনে তুলতে সাহায্য করেছিল আর তার স্ত্রীর জন্য জায়গা করে দিযেছিল তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছিল। তারপর মহিলাটির দিকে ফিরে তার স্ত্রীর কোটের কলারটা নামাবার চেষ্টা করেছিল, আর সৌজন্য দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, "হ্যাঁগো তুমি ঠিক আছো তো?"

স্ত্রী উত্তর দেবার পরিবর্তে নিজের মুখ লুকোবার জন্য কলাবটা আবার চোখ পর্যন্ত টেনে তুলেছিল।

"জগতটা হলো খুবই খারাপ জায়গা", করুণ হাসি হেসে স্বামীটি বিড়বিড় করে বলেছিল।

তার মনে হয়েছিল তার সহযাত্রীদের কাছে ব্যাপারটা খুলে বলা তার কর্তব্য। বেচারা মহিলাটিকে করুণা করা উচিত কেন না, যুদ্ধ তার কাছ থেকে তার একমাত্র ছেলেকে কেড়ে নিচ্ছে, বিশ বছরের এক ছেলে যার জন্য তারা দু'জনে তাদের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছে। এমনকি রোমে যেখানে তাকে ছাত্র হিসাবে যেতে হয়েছিল সেখানে তার কাছে যাবার জন্য তারা সালমোনাতে তাদের নিজেদের সংসার ভেঙে দিয়েছে, তারপর তাকে যুদ্ধে স্বেচ্ছা সৈনিক হিসাবে যোগ দিতে দিযেছিল এই কড়ারে যে অন্তত ছ'মাস তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হবে না কিন্তু এখন হঠাৎ একটা তার পেয়েছে যাতে বলা হয়েছে তিনদিনের মধ্যে ছেলেকে যেতে হবে আর তাদের বলা হয়েছে তারা যেন তাকে বিদায় জানায়।

মহিলাটি তার বিরাট কোটটার নিচে মোচড় খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে বন্য একটা জন্তুর মতো গজরাচ্ছিল, বেশ নিশ্চিতভাবেই মহিলাটির মনে হচ্ছিল এইসব ব্যাখ্যায় ঐ সব লোকেদের মনে সহানুভূতির লেশমাত্র জাগবে না তারাও খুব সম্ভব -তারই মতো অবস্থায় রয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন যে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, বলে উঠেছিল, "তোমার ছেলে যে মাত্র এখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছে এর জন্য ভগবানকে তোমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। আমারটাকে তো যুদ্ধের প্রথম দিনই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে দুবার সে জখম হয়ে ফিরে এসেছে আর আবারও তাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফেরত পাঠানো হয়েছে।"

"আর আমার? আমার দুই ছেলে আর তিন ভাইপো যুদ্ধ ক্ষেত্রে আছে", অন্য একজন যাত্রী বলেছিল।

"তা হতে পারে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ও হলো আমাদের একমাত্র ছেলে," স্বামীটি অযাচিতভাবে বলেছিল। "তাতে আর তফাৎ কি হতে পারে? তুমি তোমার একমাত্র ছেলেকে অত্যধিক আদর দিয়ে নষ্ট করতে পারো, কিন্তু তোমার অন্য আরও সন্তান থাকলে তাদের সকলের থেকে তুমি তো আর তাকে আরও বেশি ভালোবাসতে পারো না। বাপের ভালোবাসা তো আর একটি রুটির মতো নয় যে সেটা টুকরো টুকরো করে সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে পারা যায়। একজন বাপ তার ভালোবাসা কোন তারতম্য না করেই তার প্রত্যেকটি সন্তানকে দেয়, সে একজনই হোক আর দশজনই হোক, আর আমি এখন দুই ছেলের জন্য যে কষ্ট পাচ্ছি, সেটা তো আর তাদের প্রত্যেকের জন্য অর্ধেক করে পাচ্ছি না, বরং দ্বিগুণ কষ্ট পাচ্ছি...।"

"ঠিক...ঠিক..." অপ্রতিভ স্বামীটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, "কিন্তু ধরো (আমরা সকলেই অবশ্য আশা করছি তোমার ক্ষেত্রে তা হবে না) এক বাপ যার দুই ছেলে আছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের একজনকে যদি সে হারায়, তাহলেও তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য একজন থাকবে সেখানে..."

"হ্যাঁ", অন্যজন উত্তর দিয়েছিল, রেগে গিয়ে, "সান্ত্বনা দেবার জন্য একছেলে অবশিষ্ট রইলো বটে, কিন্তু অবশিষ্ট সেই ছেলের জন্য তাকে বাঁচতেই হবে, সেখানে একটি মাত্র ছেলের বাপ হওয়ার ক্ষেত্রে ছেলে মারা গেলেও বাপও মরতে পারে আর তার দুঃখের অবসান ঘটাতে পারে। এই অবস্থায় কোনটা বেশি খারাপ? তুমি বুঝতে পারছো না আমার অবস্থা তোমার অবস্থার থেকে আরও খারাপ কেন?"

"বাজে কথা", বাধা দিয়ে আর একজন যাত্রী বলে উঠেছিল, মোটাসোটা, লালমুখ একটি লোক, হালকা ধূসর রঙের চোখ দুটো তার রক্তবর্ণ।

সে হাঁফাচ্ছিল। তার ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো থেকে মনে হচ্ছিল অদম্য জীবনীশক্তির অন্তর্নিহিত প্রচণ্ডতা যেন ফুটে বেরুচ্ছে, তার অশক্ত শরীর যেটা প্রায় ধরে রাখতে পারছিল না।

"বাজে কথা", সে আবার বলেছিল তার সামনের ভাঙা দাঁত দুটো লুকোবার চেষ্টায় মুখে হাত চাপা দিয়ে। "বাজে কথা। আমাদের উপকারে আসবে বলে কি আমরা আমাদের সন্তানদের জন্ম দিই?"

অন্য যাত্রীরা বেদনার্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই যার ছেলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে গিযেছিল সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। "তুমি ঠিকই বলেছো। আমাদের সন্তানরা তো আমাদের নয়। তাবা দেশের" ও সব হলো ফাঁকা কথা", মোটাসোটা লোকটি পালটা উত্তর দিযেছিল "আমরা যখন আমাদের সন্তানদের জীবন দিই তখন কি আমরা দেশের কথা ভাবি? আমাদের সন্তানরা জন্মায় কেননা তাদের জন্মাতে হবে বলে আর তাবা যখন জন্মায় তখন আমাদের জীবনগুলোও নিয়ে নেয়। এটাই হলো সত্য। আমরা তাদের, কিন্তু তারা কখনোই আমাদেব নয়। আর তারা যখন বিশ বছর বয়সে পৌঁছায় তখন হয়ে যায় আমরা ঐ বয়সে যেমনটি ছিলাম ঠিক সেই রকম। আমাদেবও বাপ ছিল, মা ছিল কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক কিছুও ছিল মেয়েরা, সিগারেট, মোহ, নতুন নতুন বন্ধন আর অবশ। দেশ, আমাদের যখন বিশ বছর বয়স তখন আমরা তার ডাকে সাড়া দিতাম এমন কি আমাদের বাপ মার নিষেধও সত্ত্বেও। এখন আমাদের এই বয়সেও দেশেব প্রতি আমাদের ভালোবাসা খুবই প্রবল কিন্তু তার থেকেও জোবালো হলো আমাদের সন্তানদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা। আমাদের মধ্যে এমন কি কেউ আছে যে পারলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার ছেলের জাযগা নিতো না?"

চারদিকে নীরবতা বিরাজ করছিল, সকলেই যেন সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ছিল।

"তাহলে কেন—"মোটা লোকটি বলে চলেছিল, "আমাদের সন্তানদের যখন বিশ বছর বয়স হবে তখন তাদের অনুভূতির কথা আমরা বিবেচনা করবো না? এটা কি স্বাভাবিক নয় যে তাদেব ঐ বয়সে তারা আমাদের প্রতি ভালোবাসার থেকে দেশের প্রতি ভালোবাসাকে আরও অনেক বেশি বড় বলে মনে করবে (আমি অবশ্য ভালো ছেলেদের কথা বলছি)? তেমনটি যে হবে এটাই তো স্বাভাবিক, কেননা, তারা তো আমাদের দেখবে বুডো মতো করে যারা আর নড়তে চড়তে পারে না তাই ঘরেই থাকে, তাই নয় কি? দেশ যদি রুটির মতো প্রকৃতিদত্ত প্রয়োজনীয় একটা জিনিস হয় আমরা যাতে উপোষ করে না মরি তার জন্য যেটা থেকে আমাদের প্রত্যেককে খেতে হবে, তাহলে তাকে রক্ষা করার জন্য কাউকে যেতে হবে। আর আমাদের ছেলেদের যখন বিশ বছর বয়স হয় তখন তারা যায়, আর তারা চোখের জল চায় না, কেননা তারা যদি মারাও যায়, মারা যায় উদ্দীপিত হযে, পরমসুখে (আমি 'অবশ্য ভালো ছেলেদেব কথা বলছি)। এখন যদি কেউ অল্প বয়সে সন্তুষ্ট মনে মারাও যায, জীবনের কুৎসিত দিকগুলোর মধ্যে দিয়ে না গিয়ে, তাব এক ঘেয়েমি, নীচতা, মোহ ভঙ্গের তিক্ততা ভোগ না করে তাহলে এর থেকে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

03 Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).

Get Newsletter

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion