শক্তের ভক্ত
রাত্রি বাজে নটা। ডাক্তারবাবু তাঁর ডাক্তারখানায় বসে আছেন। মেজাজটা বিশেষ ভালো নয়। সেই কখন থেকে বসে আছেন, একটা রোগীও আসে না। আজ হলো কি? দেশে রোগ-শোক সব দূর হয়ে গেল নাকি?
অবশেষে একজন দেখা দিল। ডাক্তারবাবু একটু তাজা হয়ে উঠে বসলেন। কিন্তু সে লোক যখন ঘরে এসে ঢুকল, তাকে দেখেই ডাক্তারবাবু মনটা বিগড়ে গেল। লোক নয়, মেয়েলোক—ও পাড়ার কেলোর মা। গরীবের বেহন্দ। একটা পয়সা দেবার ক্ষমতা নেই।
কেলোর মা ঘরে ঢুকেই একেবারে কেঁদে পড়ল, ডাক্তারবাবু গো, আমার কেলোর জ্বর যে কেরমেই বেড়ে চলেছে। কেমন-যে করছে, ডাকলে সাড়া দেয় না। আপনি একবার চলো।
ডাক্তারবাবু মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন। এঃ একটা পয়সা দেবার নাম নেই, উনি এসেছেন ডাক্তার ডাকতে। যা যা, আমি যেতে পারব না।
কেলোর মা এবার তার আঁচলের তলা থেকে একটা শিশি বের করে বলল, তবে আপনি একটু ওষুধই দিয়ে দাও।
পাঁচ আনা পয়সা লাগবে। দিতে পারবি?
পাঁচ আনা কি গো! আমার-যে পাঁচটা পয়সা ঘরে নেই। আপনি এখন এমনিতেই দিয়ে দাও। আমার কেলো সেরে উঠুক, ও আপনার পয়সা শোধ করে দেবে।
ভাগ, আমি বিনি পয়সায় ঔষধ দিতে পারব না।
কেলোর মা ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলে, সুবিধা হবে না। সে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকেছিল, কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল।
ডাক্তারবাবু বসেই রইলেন, কিন্তু আর কেউ আসে না। দেয়াল ঘড়িতে টং করে সাড়ে নটা বাজল। এমন সময় কেমন বিচ্ছিরি একটা জংলা আর বোঁটকা গন্ধ পেয়ে ডাক্তারবাবু নাক সিঁটকে বললেন: রামোঃ, কি যেন পচেছে। আর তখুনি কে যেন হেঁড়ে গলায় ডেকে উঠল, ডাক্তারবাবু!
ডাক্তারবাবু ডাক শুনে চমকে উঠে চেয়ে দেখেন, টেবিলের সামনে একটা কি যেন বসে আছে। ও কি রে বাবা! তার বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। বাতিটা উসকে দিতেই একেবারে চোখে চোখ মিলে গেল! এ্যাঁ, এ যে মস্ত বড় একটা বাঘ। একেবারে আসল বাঘ। এই এত্ত বড় একটা মাথা। ভাটার মতো চোখ দুটো। আর ইয়া লম্বা গোঁফ। ডাক্তারবাবু আঁতকে উঠে আঁউ আঁউ করতে লাগলেন।
বাঘ বলল, ডাক্তারবাবু ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে কিছু বলব না। আমি যে তোমার রোগী।
বাঘের মুখে দিব্যি মানুষের মতো কথা শুনে ডাক্তারবাবুর সাহস একটু ফিরে এলো। বুকের ধড়ফড়ানিটা একটু সামলে নিয়ে তিনি বললেন, রুগী! বাঘ আবার কখনো রুগী হয় নাকি? রোগ তো হয় মানুষের।
বাঘ বলল, তুমি সত্যি কথাই বলেছ। আগে নিয়ম তাই ছিল বটে। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। বুড়োদের মুখে শুনেছি, তাদের সময় মানুষগুলো সুস্থ সবল ছিল। তাদের খেলে পরে কিছু হতো না। কিন্তু এখনকার মানুষ একেবারে রোগের বাসা। এখন যে সব বাঘ মানুষ খায় তাদের কারু স্বাস্থ্যই ভালো নয়। একটা না একটা গোলমাল আছেই। আমার অবস্থাটাই দেখ না।
কি হয়েছে তোমার?
কি হয়েছে? কি হয়েছে কেমন করে বলব, সে তোমরা ডাক্তাররাই জানো। পেটে বিষম কামড়ানি। একটু খেয়েছি কি অমনি ওরে বাবা, সে কি যন্ত্রণা! তখন আর চুপ করে থাকতে পারি না। কেঁদে-কেটে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে সবাইকে পাগল করে তুলি। বাঘিনী রোজই বলে, তুমি একবার ডাক্তারের কাছে যাও। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে তোমার কাছেই এলাম। ডাক্তারবাবু, আমাকে একটু ভালো দেখে ওষুধ দিয়ে দাও।
কথা বলতে বলতে ডাক্তারবাবুর ডর-ভয় তখন একদম চলে গেল। তিনি বললেন, ওষুধ আমি দিতে পারি, কিন্তু আমরা তো টাকা-পয়সা ছাড়া চিকিৎসা করতে পারি না। এই তো আমাদের ব্যবসা।
বাঘ বলল, সে তো ঠিকই। তুমি আমার বেদনাটা সারিয়ে দাও, আমি তোমাকে খুশি করে দেব। কত পয়সা তুমি চাও?
ডাক্তার হেসে বলল, হ্যাঁ, কাজের নামে কাজি, কাজ ফুরোলে পাজি। অমন কথা অনেকেই বলে। শেষে কারু টিকিটাও দেখা যায় না। বিশেষ করে বাঘদের কথা।
কেন, বাঘেরা আবার কি দোষ করল? বাঘ গম্ভীর সুরে বলল—বেশ, শোন নি, সেই বাঘ আর বকের কথা?
কই, না তো।
তবে শোন। এক বাঘের গলায় একটা হাড় ফুটেছিল। সে বাঘ তোমারই মতো যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে চেঁচাতে লাগল, যে আমার এই গলার হাড় খুলে দিতে পারবে, তাকে অনেক পুরস্কার দেব। কিন্তু কেউ ভয়ে এগোয় না। শেষ কালে এক লোভী বক পুরষ্কারের লোভ সামলাতে পা পেরে পা টিপে টিপে সামনে এসে বলল, হুজুর, একটু হাঁ করুন তো, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি। বাঘ চোখ বুঁজে বিরাট এক হাঁ করল।
বক তার লম্বা ঠোঁটটা তার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খুট করে হাড়টা বের করে নিয়ে এলো। বাঘ আরামের নিঃশ্বাস ফেলে বলল—আঃ!
তখন বক বলল, হুজুর, কাজ তো করলাম, এবার আমার পুরস্কার?
বকের এই কথা শুনে বাঘ কিন্তু চোখ লাল করে উঠল, বটে, বাঘের গলায় মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে সেই মাথা বের করে নিয়ে আসতে পেরেছিস, এই তো তোর চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য। এর পরেও আবার পুরস্কার চাইছিস! পালা ব্যাটা।
বেচারা বক কি আর করবে, প্রাণ নিয়ে পালাল।
কিন্তু বাঘ, তোমার এত বয়স হয়েছে, এই ঘটনাটা শোননি?
বাঘ বলল, না, আমি এমন কথা কখনই শুনিনি।
আশ্চর্য! অথচ একথা তো সবাই জানে। আমাদের ঘরের এই টুকুন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও তো এ কথা জানে।
বাঘ বলল, এসব মানুষের বানানো কথা। বাঘদের নিন্দা করবার জন্যই তারা এ সমস্ত মিথ্যা কথা তৈরী করেছে।
আরে না না, মিথ্যে গল্প নয়। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘কথামালা’ বইতে এই কাহিনী লিখে গেছেন। তিনি তো মহাপুরুষ, তিনি কি আর মিথ্যে কথা বলতে পারেন? শোন নি তার নাম?
উহুঃ, কে সেই লোকটা?
তাও জানো না! তিনি মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামের ঠাকুর দাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের পুত্র।
বাঘ বলল, তা হোক, তবু সে সেরেফ মিথ্যে কথাই বলেছে। তুমি চল আমার সঙ্গে, আমি সমস্ত বাঘদের এক জায়গায় জমায়েত করে তোমার সামনে তাদের কাছেই কথাটা জিগ্যেস করব। সত্যি হয়ে থাকলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বলতে পারবে।
ওরে বাবা, ওখানে যাবে কে মরতে!
বাঘ উকিলদের মতো ভালো জেরা করতে পারে। সে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, তোমরা কোনো বকের কাছে জিগ্যেস করে দেখেছ?
হ্যাঁঃ, বকেরা কি কোনো খবর রাখে নাকি? ওদের কাছে জিগ্যেস করাও যা, না করাও তা।
বেশ কথা। ঘটনাটা বাঘ আর বকের মধ্যে। তাদের তোমরা কেউ কিছু জিগ্যেস করলে না। তবে তোমরা কেমন করে জানলে? সেই ঘটনা ঘটবার সময় কোনো মানুষ উপস্থিত ছিল সেখানে? এমন কথা তোমাদের সেই বইতে লেখা আছে?
ডাক্তারবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, না, তা অবশ্যই নেই।
তা হলে?
ডাক্তারবাবু এবার বেশ বিপদেই পড়ে গেলেন। কি বলবেন এখন? একটু আমতা আমতা করে বললেন, হয়তো গাছের উপর কেউ বসে ছিল, হয়তো—
বাঘ এবার বদমেজাজী হাকিমের মতো ধমক দিয়ে উঠল, ধেত্তেরি, কেবল হয়তো আর হয়তো আর হয়তো। যত সব বাজে কথা। এখন শোন ডাক্তারবাবু, ওসব বাজে কথা রাখো। যদি ঐ রোগ সারাতে পারো, তোমাকে অনেক টাকা দেবো।
ডাক্তারবাবুর মেজাজটাও খুব ভালো নয় তো, ধমক খেয়ে তিনিও চটে উঠলেন। তিনিও তার গো ছাড়তে চাইলেন না। বললেন, হ্যাঁ, সেরে গেলে টাকা দেবো—এ তো অনেক ব্যাটাই বলে। কিন্তু সারাবার পর আর পাত্তা
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments