টিয়া পাখির বাচ্চা
টিয়া পাখির বাচ্চা মার কাছে সারাদিন গল্প শোনে। ওর মা কত-যে গল্প জানে! পুরনো একটা ভাঙ্গা বাড়ির ছোট্ট খুপড়িতে ওদের বাসা। সেই বাড়িতে মানুষজন কেউ নেই, ছাড়াবাড়িটা জংলা গাছে ছেয়ে গেছে। গোটা দুই শেয়াল নীচের ঘরে বাসা বেঁধেছে। এ ছাড়া এ বাড়িতে একদল চামচিকে আছে, সাপ-খোপ আছে, পোকামাকড় আছে, অনেক কিছ্ইু আছে। কিন্তু ওদের সঙ্গে টিয়া পাখির কোনোই সম্পর্ক নেই। টিয়া তার বাচ্চাটাকে নিয়ে দোতলায় ঘুলঘুলিটায় বাসা বেঁধে আছে।
মা মাঝে মাঝে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে ওই ছোট্ট বাসাটুকুর মধ্যে বাচ্চা কিন্তু বেশ মনের আনন্দেই আছে। মাঝে মাঝে মা যখন ওকে ফেলে বাইরে চলে যায়, তখন বড়ই একা একা লাগে। কিন্তু সে কতক্ষণের জন্যই বা। মা ফিরে এলেই সে আবার আনন্দে কলকলিয়ে ওঠে।
এতদিন ছিল বেশ ভালোই। কিন্তু কিছুদিন যাবত মা’র মুখে নানারকম গল্প শুনে শুনে সে বিষম উসখুস করছে। মা’র মুখের গল্প শুনে এইটুকু সে বুঝতে পেরেছে যে, তাদের এই খুপড়ির বাসাটা থেকে আসল পৃথিবীটা অনেক বড়, দেখতেও খুব সুন্দর। কিন্তু সেই পৃথিবী কোথায়, কত দূরে? মা’র কাছে যে-সব গল্প সে শুনেছে, তা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, কিন্তু বিশ্বাস না করেই বা করে কি? মা কি আর মিথ্যা কথা বলছে!
মা বলে, তাদের এই বাসাটা থেকে বাইরে বেরোলেই নাকি পৃথিবীর সঙ্গে দেখা হয়। সে কি একখানা পৃথিবী, তার আদিও নেই অন্তও নেই। আর কত রকমের চেহারা তার। এক এক জায়গায় এক রকম। পাহাড় আছে। বন আছে, শহর আছে, গ্রাম আছে, নদী আছে, সমুদ্দুর আছে, আরও কত কি-যে আছে, সে কথা কি কেউ বলতে পারে! আর সবার মাথার উপর নীল আকাশের একটা মস্ত বড় ঢাকনি। ও সব কথা শুনে বাচ্চার মন ছটফট করতে থাকে। কবে সে বড় হবে, কবে সে শিখবে, আর কবেই বা সে নিজের চোখে এসব দেখবে! মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে, সে কি সত্য সত্যই কোনো দিন মায়ের মতো এতো বড় হয়ে উঠতে পারবে? মায়ের মতো বড় হয়ে ওঠা, সে তো আর সহজ কথা নয়।
কিন্তু সত্য সত্যই সে এক সময় বড় হয়ে উঠল। মায়ের মতো অত বড় না হোক, যতই দিন যাচ্ছে, ততই সে বড় হয়ে উঠছে। এইভাবে যদি সে ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলতে থাকে, তবে মাকে ছাড়িয়ে উঠতেই বা কতদিন? মা তখন তার কাছে বাচ্চার মতোই হয়ে যাবে।
কিন্তু এখনও তার অনেক দেরী আছে। আপাতত সে তার মার কাছে ওড়া শিখতে লাগল। প্রথম প্রথম ক’দিন কি যে নাকাল হতে হয়েছে! মা ধাক্কা মেরে ঠেলে দিয়েছে, যা যা, ঝাঁপিয়ে পড়। ওরে মারে মা, কেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়বে? কত নীচে মাটি, পড়লো একদম হাড় ভেঙ্গে যাবে। ভয়ে ওর বুক দুুপ দুুপ করতে থাকে। ও নড়তে চায় না। কিন্তু নড়তে না চাইলে কি হবে, মা ওকে ঠেলে ফেলে দেয়। বলে, যা, ভীতু কোথাকার।
বাচ্চা পড়তে পড়তে আপনাকে বাঁচাবার জন্য পাখা মেলে দিল। একটু সময় সে বাতাসের উপর ভর করতে পারল, কিন্তু সে একটুর জন্যই। তার পরেই কি যে হয়ে গেল, সে আর কিছুতেই সামলাতে পারল না, ঝটপট করতে করতে মাটির উপর আছড়ে পড়ল। আর এমনি কপাল, ঠিক সেই জায়গাটাতেই একদল চড়ুই পাখি কি নিয়ে খুব কথা কাটাকাটি করছিল।
বাচ্চা আছাড় খেয়ে পড়তেই ওদের ঝগড়াঝাটি থেমে গেল। ওরা টিটকারী দিয়ে হেসে উঠল, ছ্যাঃ ছ্যাঃ টিয়া পাখির ছানাগুলো একদম বাঙ্গাল, কোনো কম্মের না। দেখ না, লম্বায় চওড়ায় আমাদের ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু উড়তে গিয়ে কেমন করে পাক খেয়ে ঘুরে পড়ল।
ওদের এই হাসাহাসি আর খোঁচামারা কথা শুনে বাচ্চা টিয়া বড় লজ্জায় পড়ে গেল। কিন্তু এক দিন দুদিন, তিন দিন, টিয়ার ছানা দিব্যি উড়তে শিখে গেল। আর তাকে পায় কে, বাসায় মোটে ফিরতেই চায় না। মা ডেকে ডেকে হয়রান। কিসের খাওয়া, কিসের দাওয়া, সব ভুলে গিয়ে সময় নেই, অসময় নেই, কেবল ওড়ে কেবল ওড়ে। উড়তে উড়তে কত দূরে যে চলে যায়, কত উপরে-যে উঠে যায়! কি মজা লাগে তখন। মা ভেবে ভেবে অস্থির। ডেকে বলে ওরে, আর যাস নে, ফিরে আয়। বাজ পাখিতে দেখলে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
শেষে উড়তে উড়তে ওর ডানা দুটো যখন ভারী হয়ে যায়, তখন সে ফিরে আসে বাসায়। আর ফিরে এসে মার কাছে বকুনি খায়। এমনি ভাবে দিন যায়।
মা ওকে নিয়ে বড় বিপদেই পড়ে গেল। নতুন ওড়া শেখা অবধি, একটু সময় বাসায় বসে থাকতে চায় না। পথে ঘাটে কত-যে বিপদ আছে সে খবর তো আর ওরা জানা নেই। মা ওকে কত করে বোঝায়, কত করে ভয় দেখায়, ও চুপ করে বসে থাকে, কথাটি বলে না। আর যখন ফাঁক পায়, দেখ্ না-দেখ্ টুক করে বেরিয়ে পড়ে।
টিয়া পাখি তো আর জানতো না যে, ওকে আর ধরে রাখা যাবে না। ও দিন দিনই তার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মায়ের কাছে তার বাচ্চা যত ছোটই থাক না কেন, আসলে সে যে বড় হয়েছে। একদিন সে এসে ওকে চমকে দিল। বলল, মা, আমি এবার পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে চললাম।
মা বলল, সে কিরে, তুই এই টুকুন মেয়ে, তুই কোথায় যাবি? আগে বড় হয়ে নে, তারপর যেখানে খুশি যাস।
ও বলল, আমি কি এখনও ছোটই আছি নাকি? দেখছ না, কত বড় হয়ে উঠেছি। তুমি কিছু ভেবো না মা, আমি পৃথিবীর এদিক ওদিক পর্যন্ত সব কিছু দেখে শুনে তারপর আবার তোমার কাছে ফিরে আসব।
পাগলের কথা শোন। কত বড় এই পৃথিবী! তার কি কোনো শেষ আছে! পৃথিবীর এদিক ওদিক, সে কি কেউ যেতে পারে?
কেউ না পারে, না পারুক, আমি পারব। বলেই বাচ্চা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল, মায়ের কোনো কথা শুনল না।
পাখি উড়ে চলল। কত দেশ দেশান্তর পেরিয়ে পেরিয়ে চলল, কিন্তু কই পৃথিবীর তো শেষ হয় না। গ্রামের পর গ্রাম, তারপর নগর, পাহাড়, নদী, সমুদ্দুর, আবার গ্রাম, আবার বন, এমনি করে চলছেই, পৃথিবীর শেষ আর খুঁজে পাওয়া গেল না। মা তার সত্যি কথাই বলেছিল। এইভাবে দিনের পর দিন চলতে চলতে এক বনের কাছে এসে সে একদিন বলল, না, আমি আর যাব না! পৃথিবী আর শেষ হবে না। অনেকদিন উড়ে উড়ে আমি বড় ক্লান্ত হয়েছি। ঘন পাতায় ছাওয়া এই সবুজ গাছটার উপর বসে আমি বিশ্রাম করব।
গাছটা তার কথা শুনে ডেকে বলল, এসো এসো, আমি কত পাকা পাকা ফল সাজিয়ে নিয়ে বসে আছি, তুমি যত ইচ্ছা খাও। সত্যিই তো পাতার ফাঁকে ফাঁকে গোছায় গোছায় ফল পেকে আছে। ওর তখন মনে হলো ওর সত্যিই তো বড় খিদে পেয়েছে। ফল খেতে খেতে হঠাৎ সে চমকে উঠে দেখল, তারই মতো আর একটা টিয়া পাখি আরেকটা ডালে বসে ফল খাচ্ছে।
সে এক সুন্দর পাখি। এমন সুন্দর পাখি সে আর কোনো দিন দেখে নি। সেই পাখিটা তাকে দেখে বলে উঠল, বেশ হয়েছে তুমি এসেছো। আমি
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments