সোনার পেয়ালা
কিজিল-আয়িয়াক
আকাশের তলে যত পাহাড়ে গাঁ আছে, আমার জন্মের জায়গাটা তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা, সবচেয়ে সুন্দর। আমাদের গাঁ কথা বলে, সবচেয়ে মিষ্টি আমুদরিয়া নদীর গানে। জীবনে শুধু একবার, এক ঢোক তার জল খেলে, সে স্বাদ কখনো ভোলা যাবে না।
আজো পর্যন্ত রোজ সকালে গাঁয়ের চারপাশে দেখা যাবে খরগোশ, সজারু, শেয়াল, হিংস্র শৃগালের নখরের দাগ। সে কী বলব!
ছেলেবেলায় আমার ধারণা ছিল না কিজিল-আয়িয়াক জিনিসটা কী। হয়ত তার জন্যে দায়ী আমার আত্মীয়স্বজনেরা। আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসে তারা সবসময় আমায় খেপাত: ‘কই, দেখা তো তোর পা। তুই যখন কিজিল-আয়িয়াকের ছেলে, তখন তোর পা হওয়ার কথা সোনার।’
তুর্কমেন ভাষায় ‘কিজিল’ মানে লাল, তবে ‘সোনা’ও বোঝানো যায়। আয়িয়াক—পা। তবে প্রতিবেশী জাতিদের ভাষায় ‘আয়িয়াক’ মানে পাত্র, পেয়ালা। রূপকথার শাহ জেমশিদের ছিল আশ্চর্য এক সোনার পেয়ালা—কিজিল-আয়িয়াক। তাতে তাকিয়ে জেমশিদ শাহ দেখতে পেত দুনিয়ায় কী ঘটছে।
খুব সম্ভব আমাদের গাঁয়ের এই নাম হয়েছে তার আগেকার অধিবাসীদের ধনদৌলতের দরুন। লোকে বলে, ভেড়ার পালে এখানকার বালি ছেয়ে যেত যেভাবে বাদলার দিনে মেঘে ঢেকে যায় আকাশ। অবিশ্যি এসব পালেরই মালিক ছিল জন কয়েক ধনী জমিদার বা বাই। জনগণ যখন নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিল, বাইরা তাদের গরু-ভেড়া নিয়ে চলে যায় আফগানিস্তানে।
পাশের গ্রাম থেকে পরিত্যক্ত কিজিল-আয়িয়াকে, তার উর্বর জমিতে উঠে আসে ষাট জন দেকখান-চাষি, আমার বাবা ছিলেন তাদের একজন। গড়া হল যৌথখামার ‘তিয়াজে দুনিয়া’ (নয়া দুনিয়া)।
তারপর অনেক দিন কাটল। সোনার কাপ শুন্যি হয় নি। আমাদের কালে আমাদের গাঁ সত্যি করেই সোনার কাপ—এ মাটির প্রতি যারা অকৃতজ্ঞ, যারা তাকে ফেলে পালিয়েছিল, তারা এখন দারুন হিংসেয় জ্বলে মরছে।
প্রথম ইঞ্জিন গাড়ি
আমাদের বাড়িটা ছিল গাঁ থেকে একটেরে। এদিকে কোনো রাস্তা ছিল না। বাড়ির পরেই সবুজ ঝোপঝাড়ের ঢেউ। আমাদের সবচেয়ে কাছে আন্নালি-আগার বাড়ি। তবে আমার বন্ধু ইয়াজলির সঙ্গে কথা বলতে হলে উঠতে হত বাড়ির চালে কিংবা গাছে।
সেদিন চালে প্রথম উঠেছিল ইয়াজলি।
‘কা-য়-য়ু-য়ুম!’ গলা ফাটিয়ে চেঁচাল সে।
দুধের পেয়ালা রেখে ছুটে গেলাম আঙিনায়।
‘কী-ই-ই-ই!’ প্রাণপণে সাড়া দিলাম।
‘চলে আ-আয় এখানে। বাবার আছে লোহার গাড়ি!’
ছুটলাম আন্নালি-আগার বাড়িতে।
আঙিনায় বড়ো বড়ো লোহার চাকার ওপর বিচিত্র এক লোহার জীব।
‘এটা আগুন খায়।’ ফিসফিসিয়ে বললে ইয়াজলি আর সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসল সীটে, ‘উঠে আয়! আগুন না দিলে এটা নড়বে না।’
তবে ভয় হচ্ছিল আমার।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন আন্নালি-আগা।
‘বস রে উটের বাছুর ইয়াজলির পাশে।’
কী আর করি। উঠে বসলাম শক্ত সীটটায়। আন্নালি-আগা ইঞ্জিন চালালেন। গোঁ গোঁ করে কেঁপে-কেঁপে উঠল ট্র্যাক্টর, ইয়াজলিকে জড়িয়ে ধরে চললাম। খেতে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে লোহার গাড়ির গন্ধ, তার ঘড়ঘড় আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এমনকি নজর করেও দেখলাম যে আমাদের পেছনে টেনে আনা হচ্ছে কী একটা দাঁতালো জিনিস, দাঁতগুলো তার কুড়লের মতো। আন্নালি-আগা টের পেলেন কী আমি দেখছি। জিগ্যেস করলেন: ‘জানিস এটা কী?’
বললাম, ‘জানি, এটা লোহার গাড়ির বাচ্চা।’
আন্নালি-আগা হেসে উঠলেন: ‘এটা হাল রে, হাল। এখন আমি জমিতে হাল দেব, আর তোরা ভাগ, বাড়ি যা।’
লোহার ইঞ্জিন গাড়ির সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়।
***
ইয়াজলি ছিল আমার চেয়ে কিছু বড়ো, আমি তার পেছনে লেগে থাকতাম লেজুড়ের মতো, তার কথা শুনে চলতাম।
‘পেয়েছি!’ যষ্টিমধু ঝোপের তল থেকে একটা কোঁকড়া ব্যাঙের ছাতা তুলে সে বললে, ‘আয় এটা হাঁটুতে মাখা যাক।’
‘কেন?’
“দৌড়ন যাবে তাড়াতাড়ি। তাহলে ‘শয়তানি চাকা’ আমাদের পাল্লা ধরতে পারবে না।”
আমি চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম।
‘কোথায় সেটা?’
‘আমার চাচার কাছে। সে তাতে বসে পা ঘোরায় আর ছোটে ঘোড়ার চেয়ে জোরে। চাচা আসবে, আমি তোকে দেখাব।’
কোঁকড়া ব্যাঙের ছাতা ঘষলাম হাঁটুতে, লম্বা কয়েকটা ডাল ভেঙে ছুটতে লাগলাম প্রাণপণে, ধূলো উড়ালাম।
হঠাৎ—থেমে গেলাম। রাস্তায় বড়ো একটা সাপ চলে যাবার দাগ। চামড়া তার চকরা-বকরা, আমরা তার দাগ ধরে চললাম, শেষ আর নেই। এদিক-ওদিক চেয়ে শেষ পর্যন্ত থামলাম, দাগগুলো ঘুরে গেছে ইয়াজলির চাচা যে বাড়িতে থাকে, সেই দিকে।
দেয়ালের কাছে ‘শয়তানি চাকা’—বাইসাইকেল।
এটা ঘটেছিল আমার বেলায়, তবে আমার বয়সী যারা এখন যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ, গ্যাসে অভ্যস্ত, তাদের প্রায় সবাই একসময় মোটর গাড়ির চাকার দাগকে ভয়ংকর সাপ চলে যাবার দাগ বলে ভেবেছে। অথচ আমরা তো এখনো মোটেই বুড়োই নি। গত পঞ্চাশ বছরে লোকে কত কী না করেছে। ভাবতে গেলে মাথা ঘুরে ওঠে। জীবনে যা ঘটেছে, লোকে যা সব করেছে, তার কাছে কোথায় লাগে রূপকথা।
স্মৃতি
একেবারে ছেলেবেলা থেকে যেসব ছবি আমার মনে আছে, সেগুলো হাতড়ে দেখি সবই—পপলার গাছ, পুরনো কেল্লার ভেঙে পড়া দেয়াল, দাদী তোতীকে। তিনি আসতেন আমাদের, ছোটোদেরকে নিয়ে থাকতে, আমরা যাতে এদিক-ওদিক না পালাই তার জন্যে গল্প বলতেন। আরো মনে আছে, গরিব চাষিদের ভেড়া দেওয়া হয়েছিল। নতুন মালিকেরা সঙ্গে সঙ্গেই ভেড়ার পিঠে নিজেদের এক-একটা চিহ্ন এঁকে দেয়। পড়শিদের দৌলতের সঙ্গে নিজেদের হাঘরে জীবটি যাতে না মিশে যায় তার জন্যে আঁকত পাকা কালিতে। রংকরা ভেড়া—এইটেই আমার একেবারে ছেলেবেলাকার বলতে কি সবচেয়ে জ্বলজ্বলে স্মৃতি।
আরো মনে আছে ইয়াজলি একবার আমায় কেমন ধাপ্পা দিয়েছিল। বললে, গল্প বলব শুনবি? এই বলে শুরু করল: “এক যে ছিল ইয়াশুলি, ইজ্জৎদার বুড়ো, তার ছিল দুই ছেলে। একজনের নাম আইত মানে বলো, অন্যজনের নাম আইতমা—বলো না। বাপের হুকুম আইত সঙ্গে সঙ্গে সব তামিল করত। বাপ বলে, ‘আইত হাতুড়ি নিয়ে আয়।’ আইত নিয়ে আসে। ‘আইত একটা গান ধর!’ আইত গান গায়। আইত ছিল বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু অন্যটা... কী যেন ওর নাম?” মাথায় হাত দিল ইয়াজলি।
‘আইতমা।’ বললাম আমি।
‘আইতমা মানে তো বলো না। বেশ আর বলব না!’ হেসে উঠল ইয়াজলি।
বুঝলাম যে আমায় ঠকাল, গল্পটা আর শোনা হবে না, কেঁদে ফেললাম। আজো পর্যন্ত অভিমান হয় কেমন যেন।
আরো মনে আছে আমার প্রথম আতংক। তখন বসন্ত। আবহাওয়া গরম, গাছে পাতা ফুটছে, ঢিপিতে ফুল, ধোঁয়ার গন্ধ। আজো আমার চোখে জল এসে যায় যখন বসন্তের গন্ধ পাই: কচি পাতা, সোঁদা মাটি, হালকা, নির্মল করে তোলা ধোঁয়ার গন্ধ—শীতে জমে ওঠা আবর্জনা জড়ো করে লোকে তা পোড়ায় তাদের শবজি ভুঁইয়ে।
আমাদের পাঠানো হয়েছিল কাঠ আনতে। শুকনো ডালপালা ভাঙার কাজ। সন্ধে হয়ে এসেছে। গিয়েছিলাম আমরা তিনজন: ইয়াজলি, জুমা আর আমি। যাচ্ছিলাম আরিকের, জল যাবার পুরনো খাদের দিকে। জুমা আমাদের আরো একজন পড়শি, ইয়াজলির চেয়েও সে বয়সে বড়ো। কাঠ আনার জন্যে তাকে মাঝে মাঝে গাধাও দেওয়া হত।
আমরা প্রত্যেকেই তাড়াতাড়ি কাঠ ভেঙে আঁটি বাঁধলাম, এবার বাড়ি ফেরা যায়, কিন্তু জুমা দূরে একটেরে একটা বুড়ো খুবানি গাছের দিকে দেখাল। তার ওপর বড়ো বড়ো কীসব পাখি উড়ছিল।
‘চল যাই পাখির বাসা দেখব,’ বললে জুমা।
কাঠের আঁটি, কুড়ল নিয়ে আমরা ছুটে গেলাম একটেরে সেই গাছটার দিকে।
‘বাসায় কে উঠতে পারবে আগে?’ প্রতিযোগিতার নতুন প্রস্তাব দিল জুমা।
আমি আর ইয়াজলি ডালপালা ভেঙে তড়িঘড়ি উঠতে লাগলাম; খেয়াল করি নি যে জুমা রয়ে গেছে মাটিতেই। ইয়াজলি আমার চেয়ে সম্ভবত এক সেকেন্ড আগে পৌঁছেছিল। পাখির বাসায় উকি দিলাম আমরা, দেখলাম তিনটে ডিম, ছুঁচলো, ফুটি ফুটি দাগ, নীলচে, আকারে মুরগির
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments