ভালুকের মা
এক বন। সেই বনের ধারে ঘর বেঁধে কাঠুরে আর তার বউ বাস করে। ওদের ছেলেপুলে নেই। দুই জনকে নিয়েই সংসার।
কাঠুরে রোজ সকালে বনে গিয়ে কাঠ কাটে। তারপর কাঠের আঁটি বেঁধে নিয়ে বাজারে যায় বিক্রি করতে। বিক্রি করে যা পায়, তাই দিয়ে চাল-ডাল-তেল-নুন আর যা যা লাগবে সব কিনে নিয়ে আসে। এইভাবে সুখে-দুঃখে দিন যায়।
অগ্রহায়ণ মাসের শেষভাগে বেশ শীত পড়ে গেছে। কাঠুরের পিঠে খাবার কথা মনে পড়ে গেল। বউকে ডেকে বলল, বউ, বউ অনেকদিন পিঠে খাই না। আজ পিঠে বানাও। বউ বলল, ভালো কথাই বলেছ। পিঠে খাবার এই তো সময়। কিন্তু পিঠে যে বানাব, ঘরে-যে কিছুই নেই। পিঠে বানাবার সাজ-সরঞ্জাম চাই তো!
ও এই কথা। তার জন্য কি? আমি সব যোগাড়যন্তর করে আনছি। তুমি সন্ধ্যাবেলায় পিঠে বানাবে। রাত্রি বেলা খাব, আবার কাল সকালেও বাসি পিঠে খাব।
কাঠুরের বউ হেসে বলল, বেশ তো। দেখব, তুমি কত খেতে পার।
কাঠুরে বাজার থেকে সব কিছুই কিনে নিয়ে এসে বলল, নাও, এই ধরো। আমি একটু বাইরে বেরোচ্ছি। সন্ধ্যার একটু বাদেই ফিরে আসব। কাঠুরে বউ ডেকে বলল, ফিরতে দেরী করো না কিন্তু।
কাঠুরে উত্তর দিল, ওরে বাপরে বাপ, আজ কি আর দেরী করতে পারি?
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে। কাঠুরে বউ ভেজে ভেজে পিঠে নামাচ্ছে। এমন সময় পায়ের শব্দ শুনে কাঠুরে বউ বুঝল, কাঠুরে এসেছে।
—কাঠুরে বউ, কি করছো?
কাঠুরে বউ মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দিল, আহা, কি করছি জানো না তুমি? আমার পিঠে ভাজা প্রায় শেষ হয়ে গেল। এসেছো ভালোই হয়েছে। তুমি একটা পিড়ি পেতে বসে পড়। গরম গরম ভালো লাগবে।
যে এসেছিল, সে পিঁড়ি পেতে বসে পড়ল। এমন সময় কাঠুরে বউ মুখ ফেরালো। মুখ ফিরিয়ে যা দেখল তাতে সে ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে কথা ফুটল না। ওরে বাবা, এক বিরাট ভালুক পিঁড়ি পেতে বসে পিঠে নেবার জন্য ধ্যাবড়া হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভালুক তার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে দাঁত বের করে হেসে বলল, তুমি আমায় দেখে অত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তোমায় কিছু বলব না। কিন্তু তুমি আমায় পিঠে খেতে বসতে বলেছ। এখন দাও।
কাঠুরে বউ কি আর করবে, কাঁপতে কাঁপতে এক গোছা পিঠে ওর হাতের ওপর ছেড়ে দিল। না দিয়ে উপায় আছে? তা হলে সব কিছুই কেড়ে খাবে। আর তাকেই কি জ্যান্ত রাখবে? যে একখানা হাত, একটা চড় মারলে কাঠুরে বউকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ভালুক পিঠে খেয়ে ভারী খুশী। এমন জিনিস তার জন্মে খায়নি। খালি হাতটা চেটে চুষে নিয়ে সে আবারও হাত বাড়াল। কাঠুরে বউ আবারও তার হাত ভরতি করে দিল। এই রকম কয়েকবার চলল। খেয়ে খেয়ে ওর লোভ আর মিটতে চায় না। সে খাচ্ছিল আর মনে মনে নানা রকম মতলব আঁটছিল। সে ভাবছিল, এমন অপূর্ব জিনিস একবার খেলে কি সাধ মেটে? যখন পিঠে খায় নি, সে ছিল এককথা। কিন্তু এখন তো সারা জীবন মনটা এই নিয়ে খাই খাই করবে। তার চেয়ে কাঠুরে বউ যদি সব সময় তার সঙ্গে থাকে, তা হলে যখন খুশী সাধ মিটিয়ে পিঠে খেতে পারবে। কিন্তু কাঠুরে বউকে ওর সঙ্গে যেতে বললে সে কি রাজী হবে? বোধ হয় না।
আর কাঠুরে বউ মনে মনে তখন ভাবছে, খেয়ে দেয়ে এ আপদ কখন বিদায় নেবে। কাঠুরেও ফিরছে না, কি বিপদেই না সে পড়ল! কিন্তু ভালুক ইতিমধ্যেই তার মন স্থির করে ফেলেছে, সে আর দেরী করল না, টুপ করে কাঠুরে বউকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে আর এক হাতে পিঠের ধামাটা নিয়ে সোজা তার বাড়ির দিকে ছুট দিল।
কাঠুরে বউ ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। ভালুক তাকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এলো। বাড়িতে আর কেউ নেই। ভালুক একাই থাকে। মাটিতে নামিয়ে রেখে দেখল, কাঠুরে বউ চোখ বুঁজে শক্ত হয়ে পড়ে আছে। ডাকাডাকি করল, কিন্তু একটুও সাড়া পেল না। একটু নড়াচড়া পর্যন্ত করছে না। কি-যে হলো কিছুই বুঝতে না পেরে ভালুক মহা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। সে চিন্তিত হয়ে তার মুখে আর গায়ে হাত বুলোতে লাগল।
একটু বাদেই শীতের খেলায় কাঠুরে বউয়ের জ্ঞান ফিরে এলো। চোখ মেলে চেয়ে দেখে, সর্বনাশ, সেই ভালুকটা তার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়েছে। তার গায়ের বুনো গন্ধে সে অস্থির হয়ে উঠল। এ কোথায় এসেছে সে। চারদিকে গাছপালা, মাঝখানে একটু ফাঁক। মাথার উপর কতগুলো তারা দেখা যাচ্ছে। কাঠুরে বউ ভয়ে আবার চিৎকার দিয়ে উঠল।
ভালুক বলল, তুমি এমন ভয় পাচ্ছ কেন? দেখ, আমার আর কেউ নেই। ছোটবেলা একটা মা ছিল, সেও মরে গেল। তুমি আমার মা হয়ে আমার সঙ্গে থাক। তুমি যখন যা বল আমি সব জিনিস যোগাড় করে নিয়ে আসব। আর তুমি আমাকে রান্না করে খাওয়াবে। এমন খাওয়া তো আমি কোনো দিন খাইনি। আমাকে একটু আদর করবার কেউ নেই। দেখ, আমি দেখতেই এত বড় হয়ে গেছি, কিন্তু আসলে ছোটই আছি। আমার একটা মা দরকার।
ভালুক কত করে তাকে বোঝাতে লাগল, কিন্তু কাঠুরে বউ তার কোনো কথা শুনতে চাইল না। সে কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ভালুক যত মিষ্টি করেই বলুক না কেন, কোনো মানুষ কি তার সঙ্গে থাকতে চায়?
বহু কষ্টে রাতটা কেটে গেল। পরদিন সকাল হতেই ভালুক অনেক খেটে খুঁটে তার জন্য ডালপালা জড় করে একটা চালার মতো তুলে দিল। সে জানে, মানুষেরা খোলা আকাশের নীচে থাকতে পারে না। তারপর কাঠুরে বউয়ের খাবার জন্য নানারকম ফলফলারি যোগাড় করে নিয়ে এলো। কাঠুরে বউ কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে, সে আর কাঁদতে পারে না। আর সে এখন এটুকু বুঝতে পারল যে, ভালুক তার কোনো ক্ষতি করবে না। তখন সে অনেক মিনতি করে বলল, তুমি আমাকে আমার বাড়িতে রেখে এসো। আমি এখানে থাকতে পারব না। কিছুতেই না।
ভালুক এমনিতে খুব ভালো। কি মিষ্টি তার কথা! কিন্তু ও কথায় সে কিছুতেই কান পাততে চায় না। বলে, না, তা হয় না। আমি তোমাকে কিছুতেই ছাড়তে পারব না। তুমি দেখছ না, আমার কেউ নেই। তোমার কি আমার জন্য একটুও মায়া হয় না? তুমি আমাকে পিঠে বানিয়ে খাওয়াবে, আর আমাকে ভালোবাসবে।
ভালুক রাত্রিবেলা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলা দেয়। লোকেরা তাকে দেখেই দৌড় মারে, বাবারে বলে দৌড় মারে। আর সেও সেই সুযোগে ঘর সংসারী করবার আর খাবার দাবার জিনিস যা পায়, সবকিছু লুটেপুটে এনে কাঠুরে বউয়ের ঘরে তোলে। তার সংসারে আর কোনো কিছুরই অভাব রইল না। কিন্তু কাঠুরে বউয়ের কোনো কিছুতেই মন মানে না, সে খালি বলে বাড়ি যাব। বাড়ি যাব।
দিনের পর দিন যায়। আস্তে আস্তে দেখতে দেখতে কাঠুরে বউয়ের ভয়ের ভাবটা কমে আসতে লাগল। আর কি আশ্চর্য, কেমন করে ভালুকের উপর একটু মায়াও যেন পড়ে গেল। কেমন করে যেন কথা বলে, কথাটা মনের মধ্যে গিয়ে বসে। রাগ করতে গিয়েও রাগ করতে পারে না। সে ভালুককে নানারকম ভালো ভালো জিনিস রান্না করে
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments