লাল গরুটা

লাল গরুটা বুড়ো হয়ে গেছে। দুধও দেয় না, কোনো কাজেও লাগে না। বাড়ির কর্তা নিধিরাম বলল, এটাকে রেখে আর কি হবে? দুচার টাকা যা পাই, তাতেই বিক্রি করে একটা দুধালো গাই কিনে নিয়ে আনাই ভালো। আমরা গরীব মানুষ, আমরা কি আর বাজার থেকে দুধ কিনে খেতে পারি?

নিধিরামের বউ বলল, এমন কথা বলো না গো, অধর্ম হবে। আমার শাশুড়ীর বড় আদরের ছিল গরুটা। বড় লক্ষ্মী আর শান্তস্বভাব, একটু ঢুঁ ঢাঁও মারে না। এরকম গরু হয় না। এতকাল মায়ের মতো আমাদের দুধ খাইয়ে এসেছে, আর এখন ক’টা টাকার লোভে আমরা ওকে কসাইয়ের কাছে বেঁচে দেব?

না না, কসাইয়ের কাছে বেচব কেন? নিধিরাম বলল, যারা চাষবাস করে খায়, এমন লোকের কাছেই বেচব।

নিধিরামের বউ চাষীর ঘরের মেয়ে, চাষীর ঘরের বউ, সব খবরই রাখে। সে অবিশ্বাসের সুরে বলল, হ্যাঁঃ, ওকে দিয়ে কি আর চাষের কাজ চলবে? বুড়ো হয়ে রোগা আর দুর্বল হয়ে গেছে। দেখছো না হাড় ক’খানা মাত্র বাকী আছে। যেই ওকে কিনুক, দুদিন আগেই হোক আর পরেই হোক, কসাইয়ের কাছে বেচে দেবেই।

তবে করব কি? নিধিরাম একটু গরম হয়েই বলল, এই অকম্মা গরুকে আর কতকাল বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব? যাদের টাকার জোর আছে, তারা তা পারে। আমাদের গরীব মানুষের কি আর সেই সাধ্য আছে?

নিধিরাম মিছে কথা বলে নি। কিন্তু তার বউ কিছুতেই সে কথা শুনতে চায় না। সে বলল, দেখ, আমরাও একদিন বুড়ো হব, আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি তখন বলে, তোমরা বুড়ো হয়ে গেছ, কোনো কাজেই লাগো না। তোমাদের আমরা আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না। তখন আমাদের কেমন লাগবে? আর আমরা যাবই বা কোথায়?

মানুষ আর গরু এক নয়, এ ঠিক কথা। কিন্তু নিধিরামের বউয়ের মন কিছুতেই মানতে চায় না। আহা, এতদিনের গরুটা! সে বার বার কেবল এই কথাই বলে, আর নিধিরামের কাছে বকুনি খায়।

ছেলেমেয়েরা কথাটা জানতে পেরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। লাল গরুটাকে ছেড়ে তারা কিছুতেই থাকতে পারবে না। বাড়িশুদ্ধ সব একদিকে আর নিধিরাম একদিকে। কিন্তু নিধিরামের গোঁ বড় বিষম। বাধা পেলে তার জিদটা আরও বেড়ে ওঠে।

নিধিরাম মুখটা ভারী করে বলল, আমার গরু আমি যা খুশি করব, তোমরা কেউ এর মধ্যে কোনো কথা বলতে এসো না। আমিই ওকে কিনে এনেছিলাম, আমিই ওকে বিক্রি করব।

নিধিরামের পাঁচ বছরের ছেলে বিশু সটান দাঁড়িয়ে গর্জন করে উঠল, আমার গরু। কাউকে বিক্কিরি করতে দেব না।

ওর মুখের ভাব আর কথার ভঙ্গীতে এত দুঃখের মধ্যেও সবাই হাসল। বিশু কাউকে ভয় করে না। এমন-যে বদমেজাজী বাপ, তাকেও না।

সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিশু দ্বিতীয় বার গম্ভীর ভাবে তার ঘোষণা জানাল—আমার গরু।

তোর গরু? তোর গরু আবার কেমন করে হলো? নিধিরাম জিজ্ঞেস করল।

বিশু বলল, আমারই তো, আমি-যে রোজ ওকে ঘাস খাওয়াই।

কিন্তু যে যতই বলুক না কেন, কারুই কোনো কথা খাটল না। নিধিরাম লাল গরুটাকে মাত্র কুড়ি টাকায় বিক্রি করে দিল। দু ক্রোশ দূরে সোনাকান্দা গ্রাম। সেখানকার একজন বুড়ো লোক তাকে কিনে নিয়ে গেল।

লাল গরুটার সাদা সরল মন। সে এত সব কিছু জানে না। ভাবতেও পারেনি। সারা জন্ম তার এই বাড়িতেই কেটে গেল। এ সব বেচাকেনার খবর সে রাখে না। যে-মানুষগুলোকে সে এত ভালোবাসে, তারা-যে তার সঙ্গে এমন করতে পারে, সে তা কেমন করে বুঝবে? ভাবল, একটা বুড়ো লোক তাকে মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে চলেছে। অবশ্য তার সঙ্গে ওর জানাশোনা নেই। নাই বা থাকল। ওর ঘাস খাওয়া নিয়ে কথা। সে কোনো আপত্তি না করে দিব্যি তার পেছন পেছন চলে গেল। আর ঠিক সেই সময়টায় নিধিরামের বউ তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাশের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। এ কি চোখের সামনে দেখা যায়।

তারপর ফিরে এসে যখন শুনল লাল গরুকে নিয়ে গেছে, তখন বিশুর কি কান্না! তাকে সামলানো মুশকিল হয়ে উঠল। ছেলেমেয়েদের সবার মুখই ভার। ছেলেমেয়েদের মায়ের অবস্থাও তাই। সেদিন বাড়ির কারুরই ভালো করে খাওয়া হলো না। কিন্তু নিধিরামকে কেউ কিছু বলল না। কেউ কিছু বললে সে নিশ্চয়ই খুব রেগেমেগে উঠত। রাগবার জন্য মনে মনে তৈরি হয়েও ছিল। কিন্তু কেউ তাকে সেই সুযোগ দিল না। নিধিরাম এমন বিপদে আর কখনও পড়েনি। কি আশ্চর্য, এমন যে তেজস্বী নিধিরাম, সে যেন ঠান্ডা জল হয়ে গেল। বাড়িতে আর আসতে চায় না। চোরের মতো এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়।

এর সাত আট দিন বাদে অবাক কাণ্ড। বিকাল বেলা লাল গরুটা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। নিধিরাম উঠানের ধারে বসে বেড়া বাঁধছিল। আর এদিক ওদিক নয়, লাল গরুটা সোজা তার কাছে গিয়ে লম্বা মুখটা তার কাঁধের উপর তুলে দিল। ঠান্ডা নাকটা গায় লাগতেই নিধিরাম চমকে উঠল, এটা আবার কি? ওমা, এ-যে লাল গরুটা! এ্যাঁ, কেমন করে এসে পড়ল? লাল গরু তার ডাগর ডাগর চোখ দুটি ওর মুখের দিকে তুলে ধরল। ওর চোখ দুটো যেন কথা বলছে। যেন বলছে, তোমার এ কেমন আক্কেল বলো তো? আমাকে একা একা কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছিলে? আমি কি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারি? গরু তো মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না। কিন্তু মনে মনে সে এই কথাই বলছিল।

তারপর তাকে নিয়ে বাড়িশুদ্ধ হৈ হৈ পড়ে গেল। ছেলেমেয়েরা চেঁচামেচি মাতামাতি, নাচানাচি শুরু করে দিল। বিশু লাল গরুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আমার গরু। সেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত লাল গরুর কথাই চলল। নিধিরাম কিন্তু মাথা নীচু করে চুপ করেই রইল। ভালোমন্দ কোনো কথা বলল না।

কিন্তু এ আনন্দ যে বেশীক্ষণের নয়। পরদিন বেলাটা উঠতেই সোনাকান্দা থেকে তিন জন লোক এসে হাজির। বুড়ো লোকটাও তাদের সঙ্গে আছে। ওরা পালিয়ে যাওয়া গরুটার খোঁজে এসেছে। বিশু তার লাল গরুকে তখন ঘাস খাওয়াচ্ছিল। ওদের দেখেই গরুটার চোখে সে কি আতঙ্ক!

নিধিরামের সঙ্গে দু একটা কথা বলে ওরা গরুটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সে কি যেতে চায়। চারটা পা খুটার মতো শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। সে হয়তো মনে মনে আশা করেছিল, নিধিরাম ওকে এসে সাহায্য করবে। সেই আশায় সে হা করে ডেকে উঠল। কিন্তু কেউ ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। ওরা তিন জন আর সে একা। কতক্ষণ আর ওদের রুখবে। ওরা তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলল। লাল গরু ফিরে ফিরে পেছন দিকে তাকাচ্ছিল। সবাই পরিষ্কার দেখতে পেল, ওর বড় বড় চোখ দুটি থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরছে। ছেলেমেয়েরা কেঁদে উঠল। ওদের মা মুখ ফিরিয়ে মুখে কাপড় গুঁজল। আর নিধিরাম? নিধিরাম কি করল? সে হন হন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

সেই যে গেল গেলই, সারাদিন আর ফিরল না। নিধিরামের বউ গরুর চিন্তা ভুলে গিয়ে স্বামীর চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। বলা নেই, কওয়া নেই, গেল কোথায়? এমন তো কোনো দিন করে না!

সন্ধ্যা লাগে লাগে ঠিক এমন সময় নিধিরামের বাড়িতে গত দিনের মতোই আবার হৈ চৈ পড়ে গেল। নিধিরাম ফিরে এসেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের এত আনন্দ সেজন্যই কি? না, তা নয়। নিধিরাম লাল গরুটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

নিধিরামের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice