ভুলো আর রঙ্গী
কুকুর থাকে ঘরের বাইরে। তাকে কেউ ঘরে ঢুকতে দেয় না। অবশ্য বিলেতী কুকুরদের বেলা অন্য ব্যাপার। তাদের সঙ্গে কথা কি। ভুলো একদম দেশী কুকুর, একেবারেই আসল দেশী, একটু ভেজাল নেই। তার বারো বছরের মনিব নীলু তাকে কোথা থেকে জোগাড় করে নিয়ে এসেছিল, ভুলো এখন আর সে কথা মনে করতে পারে না। সেই থেকে নীলুই তাকে একটু একটু করে বড় করে তুলেছে।
নীলুর মতো এমন মানুষ সারা পৃথিবী খুঁজলে মিলবে না, একথা ভুলোর ভালো করেই জানা আছে। সেই তো রোজ তাকে নিজের হাতে খেতে দেয়। মাঝে মাঝে আবার স্নান করিয়ে দেয়। দেশী কুকুরদের অবশ্য স্নান করতে নেই। কিন্তু নীলুকে সে কথা কিছুতেই বোঝানো যাবে না। নীলুর ওই একটি মাত্র দোষ। তা একটু আধটু দোষ মানুষ মাত্রেরই থাকে। বাইরের ঘরে বারান্দাটার এক কোণে একরাশ শুকনো পাতা বিছিয়ে তার উপর একটা পুরু বস্তা পেতে দিয়েছে নীলু। গদীর মতো নরম। তার উপর শুয়ে ঘুমোতে কি আরাম! ঘরের মধ্যে নাই বা ঢুকতে পারল সে, কি হয়েছে তাতে?
কিন্তু অসহ্য লাগে তখন, যখন ওই রঙ্গী বেড়ালটা ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে। ভাবটা এই, দেখ দেখি, আমি কেমন আছি। দিদিমণিদের কাছে ‘না’ পেয়ে পেয়ে ওর পায়া বেড়ে গেছে। শুধু কি তাই? শুধু যদি হাসতই, ভুলো না হয় চুপ করেই সহ্য করে যেত, দেখি-না দেখি না করেই থাকত। কিন্তু মাঝে মাঝে চটাং চটাং কথা বলে যে, তখন সারা গায়ে আগুন জ্বলতে থাকে।
একদিন কিছুর মধ্যে কিছু না, হঠাৎ বলে বসল, এই ভুলো, তুই আমাদের খাওয়ার সময় চৌকাঠের সামনে নোলাটা বের করে বসে থাকিস কেন রে? খাওয়ার সময় অমন করে দৃষ্টি দিলে পেট ফাঁপবে না? রাগে ভুলোর সারা গা রি রি করে উঠল। হতচ্ছাড়ী বলে কি? সে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, থাম তুই ফেচকিমুখী, তোর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। আর একটা কথা বলবি তো তোর ওই মুখটা দেয়ালের গায়ে ঘষে একদম পালিশ করে দেব। রঙ্গী কথা শুনে পিঠ ফুলিয়ে ওঠে, বলে ওঁ-ও-ও, এই তো বললাম কথা। আয় না দেখি, দেখি কেমন তোর মুরোদ। কিন্তু যত রাগই হোক না কেন, সত্য সত্যই ভুলো তো আর ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে না। তখন মনটা বড়ই খারাপ হয়ে যায়।
কিন্তু যে যাই বলুক না কেন, রান্নাঘরের চৌকাঠটা ঘেঁষে দাঁড়াতেই হবে তাকে। এ না করে পারে না। এ ঘর থেকেই তো নীলু তার জন্য ভাত নিয়ে এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। সে সময় ওখানে না দাঁড়িয়ে থাকলে চলে? তা ছাড়া, নীলু স্কুলে যাওয়ার পর ক্রমে ক্রমে বাড়ির আর সবাই খায়। তখন কেউ কেউ কখনো সখনো তার কথা মনে করে দু-এক মুঠো নিয়ে আসে। তখন ভুলো লেজ নাড়তে নাড়তে তার পেছন পেছন যায়। কে কোনোদিন দেবে না দেবে, তার তো বাধা ধরা নিয়ম নেই, তাই দুপুর বেলায় খাওয়ার সময়টাকে রোজই তাকে ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে হাজিরা দিতে হয়। কপালে থাকলে জোটে, না থাকলে জোটে না।
আর একদিন হয়েছে কি, খাবারের দিকে চেয়ে চেয়ে কেমন মনের ভুলে মাথাটা আর সামনের পা দুটো চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সব সময় কি অত খেয়াল থাকে? কারুর কারুর নজরে পড়ে নি, কিন্তু রঙ্গীটার সব কিছুতেই ফোঁপরদালালি, সে চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, এই ভুলো, একেবারে যে ঘরের মধ্যেই এসে পড়েছিস। বড় বাড় বেড়েছে তো। গেলি?
কাজটা-যে বে-আইনী হয়েছে, এ বোধ ভুলোর ছিল। কিন্তু তাই বলে রঙ্গীর এমন কথার পর কি সঙ্গে সঙ্গেই হটে যাওয়া যায়! মেয়েটা হাসবে না? তাই একটু জেদ করেই দাঁড়িয়ে রইল সে একটুও নড়ল না। কিন্তু কি কপাল, ঠিক এই সময়ই নীলুদের ঝি মাতারীর চোখ পড়ল তার উপরে। সে খ্যান খ্যান করে উঠল, দেখেছ, কুকুরটার কাণ্ড দেখেছ, একেবারে ঘরের মধ্যেই ঢুকে পড়েছে! বলেই সে একটা লাঠি নিয়ে ভুলোর উপর এক ঘা বসিয়ে দিল। ভুলো কেঁউ কেঁউ করে পিছিয়ে এলো। কিন্তু কি লজ্জা, রঙ্গীর চোখের সামনেই ব্যাপারটা ঘটে গেল, রঙ্গী একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ল, আর বলতে লাগল, কেন, আগেই বলেছিলাম না? এখন হলো তো! যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। এমন ভাবে কাটা গায়ে নুনের ছিঁটা পড়লে কেমন লাগে! কিন্তু উপায় কি? মুখ বুঁজে সবই হজম করতে হয়।
এই ভাবেই দিন যাচ্ছিল। মনে মনে যত তর্জন-গর্জনই করুক না কেন, রঙ্গীকে এঁটে ওঠা ভুলোর সাধ্য নয়। সে যেন পরিবারের একজন হয়ে বসেছে। তাই তার সঙ্গে ঠোকাঠুকি করতে গেলে ভুলোকেই পদে পদে নাকাল হতে হয়। অথচ রঙ্গীর চেয়ে তার গায়ে কত বেশী জোর! কিন্তু গায়ের জোর দিয়ে সব কিছু চলে না। কপাল, কপাল, সব কিছ্ইু কপালের খেলা। এই বলে ভুলো নিজের মনকে বুঝ দেয়।
কথাটা বোধ হয় মিথ্যে নয়। সব কিছুই কপালের খেলা। শেষপর্যন্ত তাই দেখা গেল। কপালের জোরেই রঙ্গীর এত বড় বাড়ন্ত আর দবদবানি। সেই কপাল তার ভাঙ্গল। নীলুর বাবা এলেন মাসখানেকের ছুটি নিয়ে। অনেক দূর দেশে কাজ করেন ভদ্রলোক, যখন তখন আসতে পারেন না। এবার কয়েক বছর বাদে এসেছেন। রঙ্গী তাঁকে চেনে না। বাড়িশুদ্ধ তাকে নিয়ে হুলুস্থুল। রঙ্গী আর ভুলোর দিকে দৃষ্টি দেবার মতো সময় কারুর নেই। রঙ্গীর মনটা তাই একটু ভার। কিন্তু পেটে ক্ষিদে চাপলে মন ভার করে বসে থাকলে চলে না। তাই নীলুর বাবা যখন খেতে বসেছেন, রঙ্গী তখন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে তার পাশ ঘেঁষে তার মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে বলল, ম্যাও অর্থাৎ একটু কিছু দাও গো বাপু।
নীলুর বাবা রঙ্গীকে দেখেই আঁতকে উঠলেন। তিনি ডাক্তার মানুষ। কি থেকে কি হয়, সে কথা তিনি ভালো করেই জানেন। সেই জন্যই বেড়ালকে তিনি বাঘের মতো ভয় করেন। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে তিনি চটিটা তুলে ইচ্ছামত দু’ঘা রঙ্গীর পিঠের উপর ঝাড়লেন। রঙ্গী বাড়ির আদুরে বেড়াল। মারপিট জিনিসটা যে কেমন সেই ধারণা তার ছিল না। প্রথমটায় সে একেবারে বুদ্ধি হারিয়ে থ খেয়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয় মারটা পড়তেই তার বুদ্ধি ফিরে এলো। সে এক লাফে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ল। তারপর ছুট ছুট ছুট।
রঙ্গীর উপরে ঝাল ঝেড়েও নীলুর বাবা শান্ত হলেন না। ডাক্তারের বাড়িতে বেড়াল! এ কেমন করে হয়? তিনি বেদম চেঁচামেচি করতে লাগলেন। ছেলেমেয়েরা বাবার পাশে বসেই খাচ্ছিল। বাবার অগ্নিমূর্তি দেখে তারা ভয়ে খাওয়া বন্ধ করে হাঁ করে রইল। নীলুর মা ভাত আনতে গিয়েছিলেন, তিনি চেঁচামেচি শুনে ছুটতে ছুটতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? কি হয়েছে?
বাড়িতে বেড়াল কেন? নীলুর বাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। কথা শুনে নীলুর মা অবাক হয়ে গেলেন, বেড়াল আছে তো কি হয়েছে?
কি হয়েছে! জানো, বেড়াল কি সর্বনেশে জিনিস? বেড়াল ডিপথেরিয়ার জীবাণু বহন করে। এতগুলো ছেলেপিলের মা, তোমার প্রাণে ভয় নেই?
নীলুর মার প্রাণে এতদিন সত্যিই কোনো ভয় ছিল না, এবার ভয় এলো। তিনি বললেন, ডিপথেরিয়া কি গো?
ডিপথেরিয়া জানো না? এ শিশুদের এক মারাত্মক রোগ। প্রথমে গলা ফুলবে, তারপর দম বন্ধ, ছটফটানি, তারপর একদম খতম। আমাদের ওখানে
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments