আহাম্মকের দেশে
ধোপা আর নাপিত। দুই বন্ধু চলল বাণিজ্য করতে। বাণিজ্য করে সওদাগরেরা, ধোপা-নাপিত বাণিজ্যের কি জানে? এমন কথা কেউ জন্মেও শোনেনি। যে শোনে হাসে। কিন্তু যেই যত হাসুক, কেউ ওদের ঠেকাতে পারল না। ওরা বাণিজ্য করবেই।
আর বাণিজ্য না করে কি করবেই বা বলো। ধোপার হাতে জোর বেশী, সে যে কাপড় ধরে আছাড় মারে, সেই কাপড় ছিঁড়ে যায়। নাপিতের ক্ষুরে তেজ বেশী, যে গালে টান মারে সেই গালেই রক্তারক্তি কাণ্ড। এইভাবে দিন যায়। কিন্তু কদিন এইভাবে চলে? গ্রামের লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত কাপড় খোয়ানো যায়, আর কত রক্ত ঝরানো যায়! একদিন গ্রামের লোক সবাই একত্র হয়ে তাদের জানিয়ে দিল, যা হয়েছে ঢের হয়েছে, এবার তোমরা ক্ষ্যামা দাও। এই বলে তারা অন্য ধোপা আর অন্য নাপিতের সঙ্গে বন্দোবস্ত করল।
তা যেন করল, কিন্তু বেচারারা খায় কি? এদের বাপ দাদার চোদ্দপুরুষ যে এই পেশা নিয়েই কামাই করে এসেছে। ফলে জমি নেই, চাষবাসের কাজও তারা জানে না। এখন কি দিয়ে কি করে? তারা আর কোনো উপায় না দেখে গ্রামের লোকদের ধরে পড়ল, তোমরা তো আমাদের কাজ বন্ধ করে দিলে। এখন অন্য কোনো কাজ দাও, নইলে আমাদের চলবে কি করে?
গ্রামের লোক বলল, যারা বাপ দাদার আমলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারে না, তারা আবার করবে কি? তোমরা কোনো কাজের লায়েক নও। তোমাদের যে-কাজ দেব, তোমরা সেই কাজই ভণ্ডুল করবে।
ওরা বলল, এ তোমাদের কোন বিচার? বউ আর কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে তবে কি আমরা না খেয়ে মরব নাকি? গ্রামের লোকের মেজাজ তিরিক্ষি হয়েছিল। তারা সোজা জবাব দিল, আমরা তার কি জানি? তোমরা যা খুশি করো গে।
অবস্থা বেগতিক দেখে দুই বন্ধু পরামর্শ করতে বসল। তারা কিন্তু যাই করুক, এক সঙ্গেই করবে। কথা হচ্ছে, কি করা যায়?
নাপিত বলল, বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। চল যাই, বাণিজ্যই করি।
কিন্তু ধোপা ভরসা পায় না, সে তো ঠিক কথা। কিন্তু বাণিজ্যের আমরা কি জানি?
আরে ভাই, আমরা কোন কাজই বা জানি? যে কাজই করি না কেনো, নতুন করেই শুরু করতে হবে। তাহলে বাণিজ্য দিয়ে শুরু করতেই বা আপত্তিটা কি?
না, আপত্তি আর কি? তবে দশপুরুষের কাজই যারা করতে পারল না, তারা বাণিজ্য কেমন করে করবে?
বাঃ, এও কি একটা কথা হলো নাকি? আচ্ছা, যারা বাণিজ্য করে তারা ধোপা নাপিতের কাজ জানে?
না, তা অবশ্য জানে না।
তবে ধোপা নাপিতের কাজে খাটো আছি বলে আমরাই বা বাণিজ্য করতে পারব না কেন? বাণিজ্য হচ্ছে বুদ্ধির খেলা।
ধোপার মনে হলো যুক্তিটা বোধ হয় ঠিকই। নাপিত বন্ধুর উপরে তার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে।
তাই সে বলল, আমি তো চিরদিনই তোমার সঙ্গে একমত। তুমি যা করো, আমি তাতেই রাজী।
তাই ঠিক হয়ে গেল। বাণিজ্যই করতে হবে। কত লোক হাসল, কত লোক টিটকারী দিল। কিন্তু তারা ওসব গায়ে মাখল না। একটু সাহায্য করবার বেলায় কেউ নেই, কিন্তু হাসতে সবাই পারে। ওরা ওদের সামান্য বিষয়-আশয় যেটুকু ছিল, তা বিক্রি করে বউদের হাতে কিছু দিল, আর বাকী সামান্য কিছু পুঁজি হিসেবে নিজেদের হাতে রাখল। অবশেষে একদিন শুভদিন দেখে তারা যাত্রা করল।
ওরা দেশ ছেড়ে আর কখনও প্রবাসে যায়নি। যেতে যেতে কত রকম দেশ আর কত রকম মানুষই-যে তারা দেখল। যতই দেখে ততই অবাক হয়ে যায়। এ সমস্ত দেশের কথা তারা কোনো দিন কানেও শোনেনি। এইভাবে চলতে চলতে সাত মাস সাত দিন বাদে তারা ‘আহাম্মকের দেশে’ এসে পৌঁছলো। আহাম্মকের দেশ অবশ্য সে দেশের নাম নয়। সে দেশের নাম সত্যনগর। সেখানকার লোক কেউ মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তাই সবাই সবার কথা বিশ্বাস করে। এ দেশের খবর খুব কম লোকেই রাখে। বাইরে থেকে যে-সামান্য কটি লোক এখানে এসেছে, সেই বিদেশী লোকগুলো কিন্তু মহা আনন্দে আছে। তারা সত্যের ধারও ধারে না। কিন্তু এখানকার লোকেরা সকলেই এমন সাদাসিধে আর সরল যে তাদের মিথ্যা কথা আর ফাঁকিবাজি একেবারেই ধরতে পারে না। আর সেই সুযোগ নিয়ে ওরা এদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছে। আর এই জন্যই ওই সমস্ত বিদেশী লোকেরা এই দেশের নাম দিয়েছে, ‘আহাম্মকের দেশ’।
এ দেশের হালচাল দেখে নাপিত বলল, আর নয়, এইখানেই আমাদের থামতে হবে। বাণিজ্য করবার মতো এমন ভালো জায়গা আর মিলবে না। কথাটা সত্যিই এ দেশের লোকগুলো যেন ঠকবার জন্যই তৈরী হয়ে বসে আছে। একবার ছুঁচ হয়ে ঢুকতে পারলে, ফাল হয়ে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে না। ধোপা আর নাপিত চুটিয়ে ব্যবসা করতে লাগল। ধোপা প্রথম প্রথম একটু খুঁত খুঁত করত, ধর্মে কি এতটা সইবে? কিন্তু নাপিত তাকে বোঝাল, ব্যবসা হচ্ছে ব্যবসা। যে কাজের যেই ধারা। ব্যবসা করতে গেলে এ সমস্ত করতেই হয়। আর ব্যবসা বাণিজ্য না থাকলে পৃথিবী অচল। কাজেই ভগবান এতে নারাজ হন না।
কিছু দিন যেতে না যেতেই ব্যবসাটা বেশ ফেঁপে উঠল। ধোপাও খুব তাড়াতাড়িই নাপিত বন্ধুর কথার মর্মটা বুঝতে পারল। তার মনেও আর কোনো খুঁতখুঁতি নেই। লোভের ঠ্যালা এমন ঠ্যালা, এ ঠ্যালা লাগলে আর সব কথাই ভুলিয়ে দেয়।
মাত্র পাঁচ বছরেই তারা একেবারে ফুলে ঢোল হয়ে উঠল। এদিকে এই পাঁচ বছরে দেশের অবস্থাটাও বদলে আসছে। লোকগুলোর চোখ যেন একটু একটু করে ফুটে উঠল। তারা কথায় কথায় গোলমাল বাধাতে চায়। নাপিত সত্য সত্যই চালাক। সে লক্ষণ দেখেই বুঝতে পারল, অবস্থাটা যেন একটু ঘোরালো হয়ে আসছে। নাপিত খুব চটপটে, সঙ্গে সঙ্গে স্থির করে ফেলল, আর এখানে এক মুহূর্ত থাকা নয়। ধোপা একটু আপত্তি তুলছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে নাপিতের কথাই মেনে নিল।
পাঁচ বছর পর ওরা ওদের গ্রামে ফিরল। গ্রামের লোক দেখে শুনে থ’ খেয়ে গেল। এ-যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ! এমন কথা কেই বা ভাবতে পেরেছিল? ওরা জায়গা জমি কিনল, আর জমকালো বাড়ি সাজিয়ে বসল। এ যেন যাদুর খেলা। শুধু গ্রাম নয়, সমস্ত অঞ্চল জুড়ে তাদের নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
গ্রামের সবাই এখন বিপদে আপদে তাদের কাছে ধর্ণা দিয়ে পড়ে। গ্রামের পাঁচ জন এসে অনুনয় বিনয় করে। বলে পুরনো দিনের কথা ভুলে যান। যা অন্যায় করেছি আমরা, সে আর বলবার নয়।
নাপিত বলে, না না, কিছুই অন্যায় করেননি। সেদিন আমাদের এমন করে গাঁ-ছাড়া করে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন বলেই তো আমরা এত বড় হয়ে উঠতে পেরেছি। তা না হলে আজও তো সেই দশ জনের শাপশাপান্তের মধ্যে থাকতাম।
পাঁচ জন কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তারা মনে মনে ভাবে এ সব কথা রাগ করে বলছে না তো? কথার মানে বুঝে ওঠা ভার।
ওদের টাকার অভাব ছিল না। তা ছাড়া এখানে সেখানেও তারা জোরে সোরে ব্যবসা চালিয়ে দিয়েছিল। কাজেই টাকা দিনের পর দিন বেড়েই চলছিল। এত টাকা দিয়ে কি করবে? শেষে ওরা নানা ভালো কাজে টাকা পয়সা দান করতে লাগল। ফলে শুধু তাদের গ্রামের নয়, সমস্ত অঞ্চল জুড়ে তাদের নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
টাকার গন্ধ পেয়ে দলে দলে লোক তাদের কাছে চাঁদার জন্য আসতে লাগল। তারাও মোটামুটি সবাইকে সন্তুষ্ট রাখত। ফলে তাদের নাম ক্রমশই চারদিকে
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments