টেপীর কাণ্ড
সবাই এক রকম জিনিস ভালোবাসে না। এক একজনের এক এক রকম পছন্দ। কেউ ভালোবাসে মিষ্টি, কেউ টক, কেউ নোনতা, কেউ ঝাল, এমন কি এমন লোকও আছে যারা তেতো খেতে ভালোবাসে।
টেপী ভালোবাসে কাঁচা চাল খেতে। ভাত দাও, ডাল দাও, তরকারী দাও, মাছ-মাংস দাও, পিঠে পায়েস দাও, কোনটাতেই আপত্তি নেই, সবই সে খাবে। কিন্তু কাঁচা চাল খেতে তার যত আনন্দ এমন আনন্দ আর কিছুতে নেই। টেপী কে? মুকুলদের বাড়ির কুকুরটা। মুকুলের কাকা ওকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। তখন ছিল এইটুকুন বাচ্চা। শুধু হাড্ডি আর চামড়া। অমন কুকুর কেউ আদর করে পোষে না। কিন্তু মুকুলের কাকার কেমন যেন মায়া বসে গেল। রাস্তা থেকে ওকে কোলে করে নিয়ে এলো।
মুকুলের মা বলল, ছি-ছি-ছি, এটাকে আবার কোত্থেকে নিয়ে এলে?
মুকুলের কাকা বলল, ওকে পুষব বউদি।
আহা, কিনা কুকুরের ছিরি! পুষবে ওকে। আর রাজ্যে তুমি কুকুর পেলে না! না-না বউদি, তুমি কিছু বলো না। খেতে পায় নি কিনা, তাই এমন হয়েছে। তুমি দেখ খেতে পেলেই তাজা আর সুন্দর হয়ে উঠবে। জানো বৌদি, বাজার থেকে আসবার পথে দীখলি ভিটার ধারে দেখি দু’তিনটা কাক ওকে চিৎ করে ফেলে ঠোকরাচ্ছে। মেরেই ফেলত। তখন কি আর ফেলে আসা যায়।
মুকুলের মা বলল, মেরে ফেলত, আপদ চুকত। তোমার যত কাণ্ড। এক একবার এক একটা জঞ্জাল জুটিয়ে নিয়ে আসো, তাও যদি একটু দেখতে সুন্দর হতো।
যে যাই বলুক টেপী কিন্তু থেকেই গেল। শুধু থাকা নয়, খেয়ে দেয়ে দিব্যি বড়সড় হয়ে উঠল। মুকুলের কাকা বলল, কেমন বৌদি, বলেছিলাম না। একবার তাকিয়ে দেখো দেখি।
মুকুলের মা ঝংকার দিয়ে উঠল, আমার আর তাকিয়ে কাজ নেই। এমন খাওয়া পেলে বড় হয়ে তো উঠবেই। কিন্তু ওটাকে খাইয়ে কোন লাভ? শোনো তবে ওর গুণের কথা। সন্ধ্যার পরে শেয়ালগুলো যখন ডাকে, পাড়ার আর কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে উঠে তাড়া করতে যায়। আর তোমার টেপী কি করে জান? ভয়ে জড়সড় হয়ে লেজ গুটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। এমন কুকুর কেউ দেখেছে।
টেপীর নিন্দা শুনে মুকুলের কাকার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তবু সে বোঝাতে চেষ্টা করল, আর একটু বড় হোক, ভয় কেটে যাবে।
মুকুলের মা উত্তর দিল, বড় হতে কিছু এখনও বাকী আছে। আর বড় হবে কবে?
এইভাবে দিন যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ টেপীটার স্বভাব খারাপ হয়ে গেল। ফলে বাড়ির সবাই তার উপর বিষম চটে গেল। মুকুলের কাকা আর ওকে কোনো মতেই সামলে রাখতে পারে না।
ব্যাপারটা হচ্ছে এই, মুকুলের বাবার চালের দোকান আছে। বাড়িতেই একটা ঘরে বস্তায় বস্তায় চাল মজুত থাকে। পাড়ার লোক, গাঁয়ের লোক এখান থেকে চাল কিনে নিয়ে যায়। টেপী আগে জানত না, হঠাৎ একদিন টের পেয়ে গেল, সংসারে যত ভালো ভালো খাবার জিনিস আছে, কাঁচা চালের মতো কোনটাই নয়। যেই না বোঝা, আর দেরী নেই, চুরি করে চাল খেতে শুরু করল।
অতগুলো বস্তা প্রথমে টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু কদিন আর চাপা থাকে? দু’একদিনের মধ্যে ওর বিদ্যে ধরা পড়ে গেল। শুধু যে চাল খায় তাই তো নয়, তার চেয়ে বেশী ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার করে। শুধু কি তাই? নতুন নতুন বস্তাগুলো কেটে কুটি কুটি করছে।
মুকুলের বাবা রেগেমেগে অস্থির। রাগবারই তো কথা। সে বকাঝকা আর চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করে তুলল। কিন্তু টেপী কোথায়? ওকি যেমন তেমন পাজী! মুকুলের বাবাকে রাগারাগি করতে দেখলেই সে টু করে একদিকে সরে পড়ত।
মুকুলের মা বলল, নেও এবার ঠেলা। আমি কি করব? ও কুকুর কি আমার কথা শোনে? তোমার এত আদরের মেয়ে, দেখ, তুমি কিছু করতে পার কি না।
মুকুলের কাকা অনেক করে বোঝাল যে, কাজটা খুব অন্যায় হচ্ছে। টেপী কান খাড়া করে ওর সব কথা শুনল। কি বুঝল সেই জানে!
মুকুলের কাকা ওকে আদর করে ভালো করে জিনিস খাওয়াল আর তারপর তাকে বার বার করে মানা করে দিল ওসব ছাইমাটি যেন আর না খায়।
টেপী খাবার খেয়ে মনের আনন্দে লেজ নাড়াতে লাগল। মুকুলের কাকার মনে হলো তার কথায় অনেকটা কাজ হয়েছে। মনে হয় যেন খুবই লজ্জা পেয়েছে।
কিন্তু তবুও একটু সাবধান হওয়া ভালো। মুকুলের কাকা বউদির বড় ট্রাঙ্কের তালাটা খুলে নিয়ে দোকান ঘরের দরজায় লটকে দিয়ে বলল, যাক, এবার নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
কিন্তু পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখে আবার সেই হৈ চৈ। টেপী চোরের মতো সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে চাল খেয়ে গিয়েছে। কি সর্বনাশের কথা! এমন চোর নিয়ে বসবাস করা যায়? তবু রক্ষা মুকুলের বাবা বাড়ি ছিল না। থাকলে আজ আর রক্ষা ছিল না। টেপী বুঝতে পেরেছিল, আজ একটা বড় রকমের গোলমাল হবেই। তাই আগে থাকতেই সে সরে পড়েছিল।
মুকুলের কাকা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, এখন কি করা যায়! দাদা ফিরে এলে আর রক্ষে নেই। পাড়ার এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দিল, কুকুরকে দিনরাত পিটাতে হয়। না পিটালে কুকুরকে কখনও মানুষ করা যায় না। তার মনে হলো বন্ধুর কথাই ঠিক।
ঠিক দুপুর বেলায় টেপী ফিরল। ততক্ষণে তার পেটের সেই চাল হজম হয়ে গিয়ে আবার নতুন করে খিদে লেগেছে। মুকুলের কাকা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে ডাক দিতেই টেপী লেজ নাড়তে নাড়তে তার কাছে গেল। পেটের চাল হজম হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চাল খাওয়ার কথাটাও সে ভুলে গেছে। এসব কথা কতক্ষণ আর মনে থাকে?
মুকুলের কাকা প্রথমে তাকে গলায় দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধল। তারপর আর কোনো কথা নয়, হাতের ছড়িটা দিয়ে সাঁই সাঁই করে পিটাতে লাগল। টেপী চড়টা চাপড়টা-যে কোনো দিন না খেয়েছে তা না। কিন্তু তাই বলে এ রকম পিটুনী। টেপী কে’উ কে’উ কে’উ কে’উ করে কেঁদে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু মুকুলের কাকা তবুও থামল না, মেরেই চলল। আজ আর মনে দয়া মায়া ছিল না।
আরও হয়তো মারত। কিন্তু বউদি ওর হাত থেকে ছড়িটা টেনে ফেলে দিল। টেপী তখনও কেঁদে কেঁদে মরছে। এমন কি করে হলো, টেপী কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না।
একটু পরেই বউদি এসে খবর দিল, টেপী দড়ি কেটে পালিয়ে গিয়েছে। মুকুলের কাকা খেতে বসে দুমুঠোর বেশী ভাত খেতে পারল না। একি একি, এখনই উঠছ যে, বউদি একথা বলতে বলতে সে খাওয়া ছেড়ে উঠে চলে গেল। সে কেমন করে খাবে? টেপীর সেই কান্না যেন তখনও তার কানে বাজছে।
দুটো দিন ভালোয় ভালোয় কাটল। কিন্তু তিন দিনের দিন আবার সেই। টেপী আবার চাল চুরি করে খেয়েছে। এরপর থেকে এইটাই নিয়ম মতো চলতে লাগল। টেপী মারও খেতে লাগল, চালও খেতে লাগল। চাল না খেয়ে কেমন করে পারে সে? চালগুলো যেন তাকে টানতে থাকে। চালের মতো মিষ্টি জিনিস কি আর সংসারে আছে? মার খেতে হয় খাবে, চাল না খেয়ে সে পারবে না। টেপী দস্তুর মতো পাকা চোর হয়ে উঠল।
মুকুলের বাবা বলল, ওটাকে দূর করে দিয়ে আয়, নয়তো আমি ওকে খুন করে ফেলব।
মুকুলের কাকা বুঝল, ওকে আর রাখা যাবে না, দূর করেই দিতে হবে। বউদিকে বলল, কুকুরটাকে পার
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments