ভূমিকা হিসেবে
পথ চলার সময় মানুষকে যেমন মন খুলে কথা বলায় পেয়ে বসে, এমন আর কখনও হয় না। যে কথা আমরা ঘনিষ্ঠতম বন্ধুকেও কখনো বলব না, সে কথা একেক সময় দেখেছি সহযাত্রীকে সহজেই বলে ফেলেছি। তার সঙ্গে এই প্রথম দেখা, জীবনে আর হয়ত কোনদিন দেখা হবে না, তাই যে কথা বার কয়েক বলেও মনের ভার লাঘব করা যায়নি সে কথা বলার পক্ষে এই লোকটিই কি সবচেয়ে ভাল নয়? এই লোকটি ছাড়া আর কার কাছে প্রকাশ করব বহুদিনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, অন্যের মুখে শোনা কাহিনী আর তেমন হলে কিছু অহঙ্কারও?
ভ্রমণ মানে শুধু চলাই নয়। হয়ত বদলীর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি কিম্বা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি যদি কেউ গাড়িতে উঠিয়ে নেয়, নয়ত রাত কাটাচ্ছি রাস্তার ধারের কোন হোটেল বা সরাইখানায় এ সবই পড়ে ‘ভ্রমণের’ মধ্যে।
আমাদের কার্পেথিয়ান পাহাড়ে দেশে স্নেগোভেৎস নামে একটা জায়গা আছে। জেলা সদর, গিরিদ্বার থেকে বেশি দূরে নয়। স্নেগোভেৎসকে এখন আর গ্রাম বলা যায় না, আবার পুরোদস্তুর সহরও হয়ে ওঠেনি। একটা ছোট্ট খেয়ালী নদী ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণ জুড়ে রয়েছে সে। জলের যখন প্রয়োজন নেই, তখন নদীর বদান্যতা দেখে কে, কিন্তু স্থানীয় বিদ্যুতাগার যখন জল জল করে মাথা খুঁড়ে মরে, নদী তখন অত্যন্ত কৃপণ। চারিদিকে অপূর্ব সুন্দর সব বড় বড় পাহাড়। পাহাড়গুলো প্রায় ঘরের দোরগোড়া থেকেই একেবারে সোজা খাড়া আকাশে উঠে গেছে, গায়ে তাদের কালো পাইন আর ফার বনের জোব্বা। মাঝে মাঝে বন কেটে তৈরী করা উজ্জল চৌকোণ শস্যের ক্ষেত আর উপরে লোভনীয় পাহাড়ে মাঠ।
চারদিকের রাস্তা এসে স্নেগোভেৎসে মিশেছে। ব্রিজের ধারে রাস্তার মোড়ে পনের মিনিট দাঁড়ালেই একটা না একটা গাড়ি জুটে যাবে। হয় মোটা চেনের ঝন ঝন শব্দ মুখরিত কাঠবওয়া লরী কিম্বা যৌথখামারের ঘোড়ার গাড়ি, নয়ত সমবায় দোকানের লরী, তাতে আবার গ্রামের দোকানের মালপত্রের নিজস্ব সেই গন্ধ—কেরসিন, কফি, জামাকাপড় আর মান্ধাতার আমলের মিষ্টি বিস্কুটের।
রাত্তিরের দিকে গাড়ি চলাচল কমে আসে—অন্ধকারে পাহাড়ের খাড়া পথগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক। স্নেগোভেৎসে পৌঁছতে যে মোটরগাড়ি আর লরীগুলোর রাত হয়ে যায় তাদের পথের ধারেই দাঁড় করান হয়। ছোট্ট হোটেলের সব খাট তখন ভরে যায়।
সব ছোট সহরের মতো স্নেগোভেৎসের অধিবাসীরাও নিজেদের সহর নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত, অতিরঞ্জনের দুর্বলতা তাদেরও আছে: ওরা বলবে, ‘আমাদের এই পার্কটা’, অথচ চোখের সামনে দেখতে পাবেন ছোট ছোট গাছ লাগান একটা চৌকো জমি মাত্র; ‘এই আমাদের স্টেডিয়াম’, তার মানে পায়ে মাড়ান গরু-চরা মাঠ; ‘আমাদের সংস্কৃতি ভবন’, সেটা একটা সাধারণ ক্লাব ছাড়া আর কিছুই নয়—পুরোনো একটা গুদাম ঘরকে বদলে, অনাবশ্যক খরচপত্র না করে করা হয়েছে।
কিন্তু স্নেগোভেৎস-এর সবচেয়ে বড় ভক্তও তাদের হোটেলটিকে হোটেল বলতে সাহস পায় না। রিসেপসন ক্লার্ক-এর জানলা, দুপাশে ঘরওয়ালা লম্বা করিডর, হলঘর, তার দেওয়ালে শিল্পী শিশ্কিনের সুবিখ্যাত ‘পাইন বনে সকাল-এর একটি কপি থাকাই চাই—এ সব হতে আর বেশি দেরী নেই: সহরের মাঝখানে রাজমিস্ত্রীরা এর মধ্যেই নতুন হোটেলবাড়ির ছাদ বানাতে সুরু করে দিয়েছে।
কিন্তু আপাতত...একটা নড়বড়ে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে আপনাকে উঠে যেতে হবে দোতলার একটা লম্বা ঘরে। সেখানে পাশাপাশি ঠাসাঠাসি সার করে ফেলা রয়েছে সরু সরু লোহার খাট। ঘরের কোণায় এক বালতি ঠান্ডা জল আর একটা টুলের উপর মুখ ধোবার গামলা আর মগ। ঘরে প্লাস্টার আর সদ্য ধোয়ামোছা মেঝের গন্ধ।
এই হোটেলেই আমি বছরের নানা সময় বহুদিন কাটিয়ে গেছি।
স্নেগোভেৎসের চেনা লোকদের কাছে আমি একটা অদ্ভুত কিছু।
‘এত অসুবিধে করে আপনার এখানে থাকার দরকার কী?’ তারা আমায় বলেছে। ‘কারো বাড়িতে একটা আলাদা ঘর ভাড়া নিলেই তো পারেন। এখানে এমন হৈহল্লা যেন চত্বরে রয়েছেন।’
আমি কিন্তু সেই হোটেলের মাটি কামড়েই পড়ে থেকেছি। তার জন্য আমার কোন অনুশোচনাও নেই। হোটেলের শত অসুবিধের কথা কবে ভুলে গিয়েছি, কিন্তু ভুলতে পারিনি সেখানকার লোকদের কথা আর তাদের কাছে শোনা বহু গল্প। দীর্ঘ দুর্গম পথের সঙ্গীর মতো এরা আমার প্রিয়, আমার নিত্য সহচর।
স্নেগোভেৎসের হোটেলে, মাৎভেই তেভেলেভ, অনুবাদ: শুভময় ঘোষ ও সুপ্রিয়া ঘোষ, আঁকিয়ে: আ তারান, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments