সন্ত সনাতন দাস

আজ থেকে অন্ততঃপক্ষে দেড় শো বছর আগেকার কথা। সেদিনকার ঢাকা শহর আর আজকার ঢাকা শহরের মধ্যে মিলের চেয়ে অ-মিলই বেশী। বাড়িঘর, পথঘাট, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি-প্রভেদ ছিল সব দিক দিয়েই। বাদশাহী আমলের প্রভাব তখনও সমাজের সর্বদেহে ব্যাপ্ত হয়েছিল। বৃটিশ শাসনের মূল তখন দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে চলেছে বটে, কিন্তু নতুন যুগের নতুন অর্থনীতি তখনও এখানকার প্রচলিত অর্থনীতিকে মরণ আঘাত হেনে ব্যাপক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে তোলে নি, দুটো বিপরীত অর্থনীতি তখন সবেমাত্র পরস্পরের সঙ্গে মোকাবিলা করছে এবং দু-একটা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ছোটোখাটো সংঘাত ও শক্তি পরীক্ষার সূচনা দেখা দিয়েছে।

সেদিন এই নগর তথা সারা প্রদেশের অর্থনৈতিক জীবনে বুড়ীগংগার এক বিরাট ভূমিকা ছিল। আজও সেদিক দিয়ে বুড়ীগঙ্গার গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু তা গৌণ। সেদিন এই নদীই ছিল এখানকার অর্থনৈতিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। বাইরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য একমাত্র নৌকার উপরই নির্ভর করতে হত। কিন্তু সেদিনকার বুড়ীগঙ্গা আজকার বুড়ীগঙ্গার মত এমন শান্ত শীর্ণকায় ছিল না। গঙ্গার মূল ধারা যে একদিন এই পথ দিয়েই প্রবাহিত হত, তার স্মৃতিটুকু তখনও সে বহন করে চলেছিল। এই নদী তখন অনেক বেশী প্রশস্ত খরস্রোতা ও তরঙ্গসঙ্কুল ছিল। নদী পারাপার করার সময় মাঝিদের বেশ হুঁশিয়ার হয়ে নৌকা চালাতে হতো। কেনো না মাঝে মাঝেই নৌকাডুবি ঘটত, লোকও মারা পড়ত। একটা কথা মুখে মুখে চলত: মা গঙ্গা বছরে অন্ততঃপক্ষে একটা করে বলি নেবেনই।

সেদিনকার নদীর পাড়ের ছবিটা কল্পনা করতে হলে প্রথমেই একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, এই বাকল্যন্ড বাঁধ তখনো তৈরী হয় নি। নদী দক্ষিণে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এপারেও নদী ছিল আরও কিছুটা সামনে। শ্যাম বাজার, রূপলাল হাউস এবং এই সারির যাবতীয় ঘরবাড়ি, এ সময় কিছুই তখন ছিল না। সে সময় নদীর এপারের পাড়টা কোথায় ছিল, তারও একটা নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। বাকল্যান্ড বাঁধ যখন প্রথম তৈরী করা হয়, তখন তা প্রাক্তন করোনেশন পার্কের পূর্ব প্রান্তে এসে শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে জানা যায় ৫০/৬০ বছর আগেও করোনেশন পার্কের পূর্ব প্রান্ত থেকে বর্তমান শ্যামবাজারের বাজারটা পর্যন্ত বাঁধ ছিল না। এই জায়গাটা ছিল একটা বাগান। এই বাগানের পূর্ব সীমায় বর্তমানে যেখানে শ্যামবাজারের বাজার বসে সেই জায়গাটায় ৫০/৬০ বছর আগেও একটা বাঁধানো ঘাটের ধ্বংসাবশেষ বর্তমান ছিল। তার পূর্বে ও পশ্চিমে দুটি বাঁধাই করা বসার জায়গা ছিল। দেখে মনে হত সেখানে বসে নদীর দৃশ্য দেখবার জন্যই এই দুটিকে তৈরী করা হয়েছিল। নদীর এপারের সীমা কোথায় ছিল, এই থেকেই তা বোঝা যায়।

নদীর ওপারে শুভড্যা একটি সুপরিচিত গ্রাম। তখন নদীর পার থেকে তার দূরত্ব ছিল আরও কম। শুভড্যা হিন্দু প্রধান গ্রাম। সেখানে অনেকঘর সাহা বাস করত। এখনও তাদের বংশধরদের মধ্যে অল্প কয়েকঘর অবশিষ্ট আছে। এই গ্রামের মথুরানাথ সাহাকে নিয়ে আমাদের এই কাহিনীর অবতারণা। তাঁর ব্যবসা ছিল পোদ্দারী। সেই কারণে তিনি মথুরানাথ পোদ্দার নামে পরিচিত ছিলেন। পোদ্দার শব্দটি আরবী ফোতহদার শব্দ থেকে এসেছে। পোদ্দার কথার মানে, যে লোক নোট, টাকা ইত্যাদি ভাঙ্গিয়ে দেয় বা সোনারূপা যাচাই করে বা জিনিসপত্র বন্ধক রেখে টাকা ধার দেয়। মুসলমান যুগে এই পোদ্দারী ব্যবসায় সর্বত্র প্রচলিত ছিল। পোদ্দারীর প্রথম কাজ, অর্থাৎ মুদ্রা ভাঙ্গিয়ে দেওয়ার ব্যবসা এখন আর প্রচলিত নেই। ঢাকা শহরে যে সমস্ত পোদ্দার আছেন, তাঁরা প্রধানতঃ সোনারূপার গয়না ও অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরী করতেন এবং এখনও করে থাকেন। এ ছাড়া তাঁরা জিনিসত্র বন্ধক রেখে টাকা লগ্নি করেন।

কিন্তু আমাদের মথুরানাথ পোদ্দার মূল অর্থেই পোদ্দার ছিলেন। তাঁর ব্যবসা ছিল বাট্টা নিয়ে টাকা, আধুলি, সিকি ইত্যাদি মুদ্রা ভাঙ্গানো। এছাড়া লগ্নির কারবারেও তিনি টাকা খাটাতেন। তিনি নিজ গ্রাম শুভড্যাতেই থাকতেন। রোজ সকালে নদী পেরিয়ে তিনি ঢাকা শহরে চলে আসতেন, তারপর বর্তমান বাংলা বাজার রাস্তার উপর চট পেতে নিয়ে তাঁর টাকা ভাঙ্গানোর দোকান সাজিয়ে বসতেন। বাংলা বাজার বহু পুরনো এলাকা। তখনও এই এলাকা এই নামে পরিচিত ছিল। কেউ কেউ বলেন, এখানে প্রধানতঃ বাঙালী ব্যবসায়ীদের আস্তানা ছিল। তাই থেকে এই নামের উৎপত্তি। মথুরানাথ দিনভরে পথের উপর বসে এই কাজ করতেন। তারপর সন্ধ্যার সময় দোকানপাট গুটিয়ে নিয়ে নদী পার হয়ে ঘরে ফিরতেন। এই ভাবে দিনের পর দিন তিনি তাঁর এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একটা টাকা ভাঙ্গানোর জন্য এক পয়সা বাট্টা দিতে হতো। টাকার চেয়েও ছোটো মুদ্রা। অর্থাৎ আধুলি ও সিকিগুলি কড়ি দিয়ে ভাঙ্গানো হতো। সে সময় মুদ্রার পাশাপাশি কড়িরও প্রচলন ছিল।

মথুরানাথ সামান্য অবস্থা থেকে তার এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ্ই ব্যবসা ক্রমে দিনে দিনে যেভাবে ফেপে উঠতে লাগল, তাতে রাস্তায় বসে কাজ চালানো আর সম্ভবপর হয় না। ব্যবসার স্বার্থের দিকে চেয়ে তিনি বাংলাবাজারে এক ফালি জমি নিয়ে তার উপর ছোট একখানা কোঠাবাড়ি তুললেন। এইটিই হল তাঁর গদি। মথুরানাথ রাস্তা ছেড়ে দিয়ে এবার সেই গদিতে গদিয়ান হয়ে বসলেন। তাঁর সেই গদি-বাড়িটি এখনও সুস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়িটি অনেকেই দেখে থাকবেন কিন্তু এর ইতিহাস খুব কম লোকই জানেন। বাংলাবাজারে যেই দালানগুলো আছে তার মধ্যে এটি প্রাচীনতম। এর বয়স কমপক্ষে দেড়শো বছর। এই রাস্তার অন্যান্য বাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এর গঠনের স্বাতন্ত্র্য বুঝতে বেগ পেতে হয় না। তখন এদেশে সিমেন্টের আমদানীর কথা দূরে থাক, তারও আবিষ্কার হয়নি। এখানে সিমেন্টের পরিবর্তে কড়ি পোড়ানো চুন ব্যবহার করা হতো। এই চুন ও মসলা দিয়ে তখন যে সমস্ত দালান তৈরী করা হতো, সেগুলি আজকালকার সিমেন্টে তৈরী দালানের চেয়ে অনেক বেশী মজবুত হতো। এই দোতলা দালানটি আজও সুস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেই সত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই বাড়িটি অনেকেরই পরিচিত। বর্তমানে এটি বাংলাবাজারের নওরোজ কিতাবিস্তানের বইর দোকান।

ব্যবসায়ী হিসাবে মথুরানাথের মর্যাদা এবার এক নতুন পর্যায়ে উঠল। মুদ্রা ভাঙ্গানোর ব্যবসাটা ছেড়ে দিয়ে তিনি এবার লগ্নি ও হুণ্ডীর কারবারে নামলেন। তাঁর এই ব্যবসা হু হু করে উন্নতির পথে এগিয়ে চলল। যিনি একদিন হাঁটুর উপর কাপড় তুলে রাস্তার উপর চট পেতে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, এখন তাঁরই গদিতে কর্মচারীরা গায়ে আচকান ও মাথায় পাগড়ী পরে কাজ করে। হুণ্ডীর কারবারের তাঁর একমাত্র প্রতিযোগী ছিল সাহেবদের গড়া ব্যাংক ‘ব্যাংক অব বেঙ্গল’। এইটিই তখনকার সর্বপ্রথম ব্যাংক। এই ব্যাংক হুণ্ডীর কারবারে যে হারে বাট্টা নিত, মথুরানাথের গদি তাঁর অর্ধেক বাট্টা নিয়ে কাজ করত। এই নিয়ে এই ব্যাংকের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা চলছিল।

অতঃপর মথুরানাথ এক নতুন বাসভবন তৈরী করে সেখানে সপরিবারে বাস করতে লাগলেন (বর্তমান ৬নং হেমেন্দ্র দাস রোড)। তাঁর পরিবার এবার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরের স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হয়ে গেল।

মথুরানাথের দুই ছেলে-স্বরূপচন্দ্র দাস আর মধুসূদন দাস। এদের আমলে এই পরিবারের সমৃদ্ধি জোয়ারের জলের মত দুকূল ছাপিয়ে উঠল। তখন একমাত্র ব্যবসা লগ্নির কারবার। এদের গদি তখন বিদেশী ব্যাংকের প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে না পেরে হুণ্ডির কারবার গুটিয়ে নিয়েছে। এই পরিবার তারপর থেকে লগ্নির কারবার ছাড়া আর কোনো ব্যবসায়ে হাত দেয়নি। লগ্নির কারবার সে সময় কি বিরাট মুনাফা টেনে আনত এখনকার দিনের লোকদের সে সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা নয়। মুনাফার অংকটা একবার দেখুন। দিনে টাকা প্রতি ১ পয়সা করে সুদ। ১০০ টাকার লগ্নি

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice