অনেক দূরের দেশে

বাতাস ছুটে যাচ্ছিল বোঁ বোঁ বোঁ শন্ শন্ শন্—

খুকু বলল, বাতাস ও বাতাস, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি তোমার সঙ্গে যাব।

বাতাস বলল, উহু, আমার একটুও দাঁড়াবার সময় নেই, আমার কত কাজ।

কি তোমার এত কাজ, বল না।

কি কাজ? কাজের কি আর অন্ত আছে? ঐ-যে মেঘগুলো দেখছ না—সাদা সাদা মেঘগুলো? আমি ওদের বয়ে নিয়ে যাব, অনেক অনেক দূরের দেশে।

কেন, ওদের নিয়ে যাবে কেন? ওরা কি করবে? কোন দূরের দেশে গো?

অনেক দূরের দেশে যেখানে বিষ্টি হয় না, ঘাস গজায় না, ফসল ফলে না, ফুল ফোটে না, আয় বিষ্টি আয় বিষ্টি বলে সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে—ওরা যাবে সেই দেশে। তারপর সেখানে গিয়ে আগে ফোঁটায় ফোঁটায় বিষ্টি নামবে। শেষে ঝুপ ঝুপিয়ে নামবে। সে দেশের ছেলে-মেয়েরা হাতে তালি দিয়ে নাচবে আর গাইবে—

আয় বিষ্টি ঝেঁপে

ধান দেব মেপে!

হে বিষ্টি ঝরে যা

নেবুর পাতা করমচা।

খুকু হাত-তালি দিয়ে উঠল, বাঃ বাঃ, ভারি মজা তো! ও বাতাস, আমায় তোমার সঙ্গে করে নিয়ে যাও। আমি তাদের দেখব। এই বলে খুকু দু’হাতে দিয়ে বাতাসের আঁচল চেপে ধরল।

বাতাস বলল, ও খুকু, আমায় ছাড়ো, ছাড়ো। আমি তোমায় কেমন করে নিয়ে যাব? আর তুমি চলে গেলে তোমার মা কাঁদবে যে।

খুকু বলল, না, মা কাঁদবে না। আমি তো আবার ফিরে আসব। ও বাতাস, আমায় নিয়ে যাও, আমি সারা পথ তোমার সঙ্গে খেলতে খেলতে যাব।

বাতাস এবার আর ‘না’ বলতে পারল না। এমন একটি সুন্দর খুকু আর কেউ তো দেখে নি। সবাই-যে তার সঙ্গে খেলতে চায়।

বাতাস বলল, সত্যি, তুমি যাবে?

হুম, যাবই তো, খুকু নেচে উঠল।

তবে চোখ বোজো।

খুকু চোখ বুজল। বাতাস সুর করে মন্তর পড়তে লাগল—

আল ঘুরানি তাল ঘুরানি

আয়রে পাখা ফুর ফুরানি,

খুকুর গায়ে লাগ্ লাগ্

গায়ের বোঝা খসে যাক।

ও খুকু, চোখ মেলো, চোখ মেলে একবার চেয়েই দেখো না।

খুকু চোখ মেলে দেখে কি, ও মা, সত্যিই তো, এ খুকু তো আর সে খুকু নেই। পাখিদের মতো তার দুদিকে দুটো ডানা গজিয়ে গেছে। আর কি হালকা হয়ে গেছে সে! সে ভাবল, একটু নেড়ে দেখি তো পাখাটা, দেখি কি হয়। ও মা, যেই না নাড়া, সঙ্গে সঙ্গেই সে মাটি ছেড়ে উপরে উঠতে লাগল। উঠতে উঠতে তাদের সব চেয়ে উঁচু যে-ঘরটা, সেই ঘরটাও তার পায়ের অনেক তলায় পড়ে রইল।

নিচের থেকে খুকুর মা দেখতে পেয়েছে। দেখেই ডাকাডাকি করতে লেগেছে, ও খুকু, যাস নে, ফিরে আয়, ফিরে আয়। খুকুর বাবা ডাকতে লাগল, ও খুকু, ফিরে আয়। তোকে ছেড়ে আমরা কেমন করে থাকব? খুুকু বলল—

ও মা গো, ও বাবা গো,

কাঁদছো কেন, ছিঃ?

আজকে যাব, কাল আসব

কান্নাকাটির কি?

যে-ঝোপড়া আম গাছটার তলায় বসে খুকু পুতুল খেলত, সে খুকুকে ডেকে বলল, খুকু, যেও না, তুমি চলে গেলে আমার তলায় বসে খেলবে কে? খুকুর পুতুলগুলো কেঁদে কেঁদে ডাকতে লাগল, যেও না, যেও না, তুমি না থাকলে কে আমাদের নিয়ে খেলবে? খুকুর বড় আদরের বেড়াল ছানাটা আকাশের দিকে চেয়ে ডাকতে লাগল, যেও না, যেও না।

কিন্তু তখন বাতাস বয়ে চলেছে, শন্ শন্ শন্ শোঁ শোঁ শোঁ। তার উপর গা ছেড়ে দিয়ে খুকু পাখা মেলে দিয়ে উড়ে চলেছে। কোনো কথা তার কানে গেল না।

খুকু যে-পথ দিয়ে চলেছে, তার এদিকে-ওদিকে কত ছোট ছোট পাখি আকাশের বুকে খেলা করছে। তারা ডেকে বলল, ও খুকু, এসো, এসো, আমরা তোমার সঙ্গে খেলা করব। খুকু বলল, না ভাই, অন্য সময় আসব। আমার যে এখন সময় নেই, আমাকে অনেক দূরের দেশে যেতে হবে।

ওরা জিজ্ঞেস করল, সে দেশ কোন্ দেশ ভাই?

খুুকু বলল, সে অনেক দূরের দেশ। সে দেশে বিষ্টি হয় না, ঘাস গজায় না, ফসল ফলে না, ফুল ফোটে না। আমরা সেই দেশে গিয়ে ঝুপ্ ঝুপানি বিষ্টি নামাব। সে বড় মজার খেলা। পাখি, ও পাখি, তোমরা আমার সঙ্গে যাবে?

ওরা বলল, না ভাই, আমাদের ছোট্ট পাখা। আমরা কি অত দূরে যেতে পারি?

পাখিরা পেছনে পড়ে রইল। বাতাস ছুটে চলেছে, শন শন শন শো শো শো। সেই সঙ্গে খুকু উড়ে চলেছে। এ-পাশে ও-পাশে সাদা সাদা মেঘগুলো দল বেঁধে আসছে। আর নীচে, অনেক নীচে মাটি-জল-গাছপালা কেবলই সরে সরে যাচ্ছে। খুকু দেখল, মাঠে গরু চরছে, পুকুরের মধ্যে হাঁসগুলো ডুবছে আর উঠছে, ঘাটে বসে মেয়েরা বাসন মাজছে, বাড়ির উঠোনে ছেলেমেয়েরা খেলছে, আরও কত কি সব! শেষে চলতে চলতে চলতে কত দিন আর কত রাত্রি পার হয়ে খুকু এসে পৌঁছল সেই অনেক দূরের দেশে।

খুকু জিজ্ঞেস করল, বাতাস ভাই, বাতাস ভাই, এ দেশের নাম কি? এ দেশের নাম নেই?

আছে বই কি, এ দেশের নাম রাজশাহী।

এ্যাঁ, রাজশাহী! খুকু চমকে উঠে বলল, বা রে, এখানেই তো আমার ছোট কাকু থাকে। বাতাস বলল, ছোটকাকু? কোথায় থাকে তোমার ছোটকাকু?

খুকু বলল, ছোটকাকু? ছোটকাকু জেলখানায় থাকে।

ও বাবা, জেলখানায়! সেখানে তো সব দুষ্টু লোকেরা থাকে।

খুকু মাথা নেড়ে বলল, না না, আমার ছোটকাকু দুুষ্টু নয়, আমার ছোটকাকু খুব ভালো। সে রোজ রোজ আমার কাছে চিঠি লেখে। আর কত গল্প লেখে। বাতাস ভাই, আমি আমার ছোটকাকুর কাছে যাবো।

বাতাস বলল, সে কি হয়! বাইরের মানুষ তো জেলখানায় যেতে পারে না।

খুকুর মনটা খুব ভার হয়ে গেল।

বাতাস বলল, খুকু, দেখো দেখো, মেঘ দেখে ছেলেমেয়েরা কি নাচানাচি করছে।

সত্যিই তো! খুকু স্পষ্ট শুনতে পেলো ওরা হাতে তালি দিয়ে নাচছে আর গাইছে—

ঝুপঝুপানি ঝুপঝুপানি আয় আয় আয়

তোর হাতে দেব সোনার কাঁকন, নূপুর দেব পায়।

উড়কি ধানের মুড়কি দেবো

বাটি ভরে পায়েস দেবো

ঝুপঝুপানি ঝমঝমানি আয় আয় আয়!

এরপর আর কি বিষ্টি না এসে থাকতে পারে! প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা তারপর ঝুপ ঝুপিয়ে, তারপর ঝমঝমিয়ে নামল। উঃ, সে কি বিষ্টি, আর কি সে মেঘের গরগরানি!

খুকু বিছানায় চোখ মেলে চাইল। বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বিষ্টি পড়ছে। মা বলল, কি রে খুুকু ঘুম ভেঙ্গে গেল?

খুকু অবাক হয়ে ভাবল, তাই তো, সে কেমন করে চলে এলো? শেষে বুঝল, বাতাস তাকে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আহ্ হা, তার এমন সুন্দর পাখা দুটি তাও নিয়ে চলে গেছে!

খুকু বলল, মা, আমি এই মাত্তর অনেক দূরের দেশে গিয়েছিলাম। সেখানে ছোটকাকু থাকে।

মা বলল, দূর বোকা, তুই তো এতক্ষণ আমার পাশেই ঘুমোচ্ছিলি।

খুকু বুঝল, মা কিচ্ছু টের পায় নি। থাক, এখন আর কোনো কথা বলার দরকার নেই।

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice