চালতা গাছের মাচা
মানুষ থাকে মাটির উপর—ঘরে কি দালানে। আর পাখিরা থাকে গাছের উপর। এইটাই নিয়ম। শুধু এখন বলে নয়, চিরকালই এই নিয়ম চলে আসছে। তবু মানুষের বাচ্চা হয়েও ওরা দুই ভাই গাছের আগায় বাসা বাঁধল। যে দেখে সে-ই হাসে। এমন কাণ্ড কেউ কোনোদিন দেখেছে?
দুটি ভাই—বলটু আর পলটু। ওদের নিত্যি নতুন খেলা। এ সব খেলার নামও কোনো দিন কেউ শোনে নি। কে-যে ওদের মাথায় এ সব বুদ্ধি যোগায় কে জানে! খুঁজে খুঁজে শেষে দক্ষিণ দিকের চালতে গাছটাকে ওরা বাছাই করল। এই গাছের মাথায় মাচা বাঁধতে হবে। যেমন কথা তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু হলে গেল। গাছের একেবারে মাথার দিকে তিনটে ডাল পাশাপাশি চলে গেছে। তার উপর বাঁশ বেঁধে ওরা দেখতে দেখতে এক দিব্যি মজবুত মাচা বানিয়ে ফেলল।
সেই থেকে কী-যে হয়েছে, দিনের অনেকটা সময় ওরা মাচাতেই কাটায়। লেখাপড়া চুলোয় গেছে, সারা দিন গাছের উপর কাঠ-ঠোকরার মতো খালি খুটুর-খাটুর চলছেই। কত-যে কাজ! কাজ আর শেষ হয় না। এখানে কমায়, ওখানে বাড়ায়, এখানে কাটে, ওখানে জোড়া দেয়, কাজ লেগেই আছে। বাঁশের মাচার উপর পুরু করে খড়ের গদি বানাল। একেবারে রাজশয্যা। দুজনে আরাম করে বসা যায়, আবার গুটিশুটি হয়ে শোয়াও যায়।
ওদের খেলার সাথীরা খবর পেয়ে দেখতে এলো। মাচা দেখে তারা তারিফ করে বলল, বাঃ, বেশ একখানা বাড়ি হয়েছে তো। বলটু আর পলটু আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল। হবে না? এ-যে তাদের নিজেদের হাতে তৈরী বাসা।
ছেলেরা বলল, কিন্তু তোরা খেলতে আসিস না কেন?
বলটু উত্তর দিল, খেলব কি করে, আমাদের এখন কত কাজ! পলটু বলল, তোরা নিজেরাই খেল গে যা, আমাদের কত কাজ, না রে দাদা?
কিন্তু শুধু খেলাধুলোই নয়, পড়াশুনোও তাকে উঠল। মা কেবল রাগারাগি করে, লেখা নেই, পড়া নেই, সারা দিন শুধু গাছের উপরে—এ সব কি? মায়ের ঘ্যানঘ্যানানিতে উত্যক্ত হয়ে ওরা ওদের বইপত্র বগলদাবা করে নিয়ে মাচার উপর উঠে বসত, আর বলত, নীচে বড় গোলমাল, ওখানে নিরিবিলিতে পড়া নাকি খুব ভালো হয়। মা নিচের থেকে ডাকাডাকি করলে ওরা জবাব দিত, আঃ, গোলমাল করছ কেন? আমরা পড়ছি যে।
মা ভালোমানুষ, নিচ থেকে খুব পড়ার শব্দ শুনে ভাবত, থাক পড়ছে পড়ুক। ঘরে থাকলে তো একটুও পড়তে চায় না। কিন্তু পড়াশোনা যে কেমন এগোচ্ছে একমাত্র চালতে গাছটাই তা বলতে পারত।
বড় বোন হাসি, তার ইচ্ছা সেও একবার উপরে উঠে দেখে আসে ওদের বাসাটা। এখন তো অনেকেই দেখতে যায়। কিন্তু মেয়েমানুষ কেমন করে গাছ বেয়ে উঠবে। হাসি ডেকে বলল, কি রে, তোরা সারাদিন উপরে এত কি করিস? তোরা কি পাখি হয়ে গেলি?
ওরা বলল, হ্যাঁ, আমরা পাখিই তো।
তবে ওই উপরেই থাক। আর বাড়ি-ঘরে ঢুকতে পারবি না। ওই খানেই খাবি দাবি, ওই খানেই ঘুমোবি।
ওরা বলল, দাঁড়াও না, মাচাটাকে আরও বড় করে নিই। ক্রমে ক্রমে সবই হবে। তোমরা তোমাদের ওই মাটিতেই পড়ে থাকবে। আর আমরা থাকব তোমাদের সবার মাথার উপরে।
সত্যি ক্রমে ক্রমে অনেক কিছুই হতে লাগল। জোড়া-তালি দেওয়ার ফলে মাচাটারও আকার অনেকটা বেড়ে গেল। ওদের মাথায় নতুন নতুন ফন্দি খেলতে লাগল।
একদিন দেখা গেল ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি গাছের উপর উঠছে। এত বড় গাছ বেয়ে মাটি তোলা বড় সহজ কথা নয়। খাটতে খাটতে ওরা দুভাই একেবারে গলদঘর্ম হয়ে উঠল।
নিচে হাসি অবাক হয়ে হা করে ওদের কাজ দেখছিল। সে জিজ্ঞেস করল, মাটি তুলে কি করবি তোরা? ওরা বলল, ঘর-বাড়ি তুলব।
ঘর-বাড়ি তুলবি কি করে? গাছের উপর কেউ ঘর-বাড়ি তোলে নাকি? বলটু পলটুর তখন বাড়তি কথার সময় নেই। তারা ভীষণ ব্যস্ত।
হাসি ঘরে ফিরে ফলাও করে এই গল্প করল, পাড়াশুদ্ধ এই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, লখার বাড়ির বলটু আর পলটু গাছের উপর ঘরবাড়ি তুলছে। ওরা দু’ভাই নাকি সেখানেই বসবাস করবে।
শুনে সবাই হাসল। কিন্তু বলটু পলটুর মা হাসতে পারল না। ওরা যেন দিন দিন বাড়ি-ঘরের সম্পর্ক ছেড়েই দিচ্ছে। নেহাৎ যেটুকু সময় না থাকলে নয়, সেইটুকু সময় ঘরে থাকে। একটু ফুরসত পেলে আর কথা নেই, অমনি গাছের মাথায়। তা ছাড়া অত উঁচু গাছ! পড়ে গেলে আর কি উপায় আছে! মা অনেক চেষ্টা করল কিন্তু এই পাগলদের ঠেকানো তার অসাধ্য। কথা বললে কি কথা শোনে?
হাসি বলল, ওদের ভয় না দেখালে চলবে না। রাত্রিবেলা খাওয়ার সময় খেতে খেতে সে ওদের বলল, তোরা-যে সব সময় চালতে গাছের উপর বসে থাকিস ভয় হয় না তোদের?
ভয়? কেন ভয় কিসের?
ভয়? কিসের? তাও জানিস না? চালতে গাছের কাছেই তো গাব গাছটা।
হ্যাঁ, আছেই তো গাবগাছটা, তাতে কি হয়েছে?
কি হয়েছে! ওই গাছে-যে একটা ভূত থাকে—এ কথা তো সবাই জানে। জানিস না, রাতের বেলা গাব গাছের উপর একটা পা আর তোদের চালতে গাছটার উপর একটা পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
পলটু গল্প শুনে ঝুঁকে পড়ল, কেন রে দিদি? অমন করে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? ওর কষ্ট হয় না? আমি বাড়ি থেকে অঙ্ক করে নিয়ে যাই নি বলে এক দিন অঙ্কের স্যার আমাকে অমন করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। বাপরে বাপ সে কি টনটনানি! পা দুটো যেন ছিঁড়ে যেতে চায়।
হাসি বলল, হ্যাঁ, ভূতের আবার কষ্ট! ওরা তো অমনি করে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালোবাসে।
বলটু পলটুর চেয়ে দু বছরের বড়। ভূতের গল্পকে আমল না দিয়ে বলল, আমাদের হেডমাস্টার বলেছেন, ভূত বলে কিছু নেই। ও সবই ফাঁকি।
হ্যাঁ, তোমাদের হেডমাস্টার তো সব কথাই জানে! পড়ত এক দিন আসল ভূতের পাল্লায়, তবে বেরিয়ে যেত মজাটা। ও বাড়ির ছিদাম কাকা নিজের চোখে দেখেছে, ঘুমঘুট্টি অন্ধকার, একটা ঠ্যাং গাব গাছে, আর একটা ঠ্যাং চালতে গাছের উপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট একটা—
বলটু কালে ভালো উকিল হতে পারবে। সে ফস করে জেরা করে বসল, অমন ঘুমঘুট্টি অন্ধকারে দেখতে পেল কি করে?
হাসি একটু থেমে গিয়ে ঢোক গিলল, পরক্ষণেই বলে উঠল, বাঃ দেখতে পাবে না! হাতে টর্চ ছিল যে। টর্চ জ্বালাতেই দেখে—ওরে বাবা, সে কি মূর্তি!
পলটু বলল, কিন্তু ও আমাদের কি করবে, আমি যে মানীদির কাছ থেকে মন্তরটা শিখে ফেলেছি। যেই না দেখব, অমনি মন্তরটা ছাড়ব—
ভূত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি
রাম-লক্ষ্মণ বুকে আমার করবি তোরা কী?
এই মন্তর পড়লে কি আর ভূত থাকতে পারে? মানীদিকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
হাসি বলল, ও সব আগেকার দিনে চলত। আজকালকার দিনের ভূতেরা ও সব মন্তর টন্তর মানে না। আর তোরা ওর পা রাখার জায়গাটায় ঘর বানাবি, ও চটবে না?
বলটু তার কথা উড়িয়ে দিল, হুঃ, তোমার যত বাজে কথা। ও সব ভূত-টুত আগেকার দিনে মানত। আজকালকার লোকে মানে না। হেডমাস্টার বলেন—
ধেত্তেরি তোর হেডমাস্টার! অমাবস্যা রাত্রিতে নিয়ে আসিস ধরে তাকে ওই গাব গাছের তলায়। বেরিয়ে যাবে হেডমাস্টারী।
বলটু-পলটুর কিন্তু ভূতের ভয় দেখিয়ে থামিয়ে রাখা গেল না। দিদির কথাটা মনে করে প্রথম প্রথম দু-একদিন গা একটু ছম ছম করেছিল। কিন্তু পরে তা কেটে গেল। তারা আবার নিশ্চিন্ত মনে তাদের নতুন ঘর-সংসার করে চলল।
ঘর-সংসার চলল বটে,
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments