এতো সবে আরম্ভ

বুড়ো ভাসিল য়াৎসিনা ছ মাস হাসপাতালে ছিল। প্রতিদিনই তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। ডাক্তাররা আর কিছুই করতে পারছিল না। য়াৎসিনা তখন তার গাঁয়ে ফিরে যাবার অনুমতি চাইল, ভেরখভিনাতেই সে মরতে চায়।

মরতে সে ভয় পায় না, স্বর্গরাজ্যের উপর আস্থা রেখেই সে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।

ভাসিল ভাবতে লাগল, ‘সারা জীবন এত দুঃখকষ্ট ভোগ করেছি—না আছে ঘরবাড়ি, না আছে নিজের জমিজমা, গোরুঘোড়া,—এর ক্ষতিপুরণ নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও ঘটবে... সারা জীবন তো কেবল অজানা অচেনাদের দ্বারে দ্বারে কাজ মেগে বেড়িয়েছি…’

‘কিন্তু তবু সে ওস্তাদ কাঠুরে। অমন ওস্তাদ বড় একটা দেখা যায় না। ভাসিল য়াৎসিনার সঙ্গে গাছ কাটায় পাল্লা দিতে পারে সাব্‌-কার্পেথিয়ান পাহাড়ে এমন আর কে আছে?!

‘মেরী মা’র কোন দেবদূত নিশ্চয়ই এসব টুকে নিয়ে হিসেব করে রেখেছে। হঠাৎ একদিন সে বলে উঠবে: “দেবমাতা, পাসেকি গ্রামের এই ভাসিল য়াৎসিনা লোকটি জীবনে কী দুঃখকষ্টই না পেয়েছে!” তারপর দেবদূত আরো বলবে, “দেশে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবার পর য়াৎসিনাকে বাঁধা কাজ দেওয়া হয়, আর দেওয়া হয় দেড় হেক্টার জমি, এমন কি একটা বাড়িও। তাই জীবনের শেষ দিকে বেচারী একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার সুযোগ পায়…”

‘য়াৎসিনা তখন নিজেই অনুমতি নিয়ে উঠবে।

‘সে বলবে, “ভগবানের নাম করে বলছি, জীবন সত্যিই এখন অনেক সহজ হয়ে এসেছে। কিন্তু য়াৎসিনার একটি মেয়ে আছে, তার নাম আন্না। সবাই জানে সৌন্দর্যের অভাবে মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে না। সে অভাব অবশ্য য়াৎসিনার চোখে ধরা পড়ে না, তবে অন্যেরা বলে। হতে পারে হয়ত সত্যিই ওর কোন সৌন্দর্য নেই—সুঁটকো মুখ, চোখদুটো দেখে মনে হয় এইমাত্র বুঝি কেঁদে উঠল, এমনি লাল। অন্যেরা এজাতীয় দুর্ভাগ্যকে চাপা দেওয়ার জন্য যৌতুক দেয়। য়াৎসিনাও তার সারা জীবন এই যৌতুকের কথাই ভেবেছে…”

‘শেষ পর্যন্ত একটি যোগ্য পাত্র পাওয়া গেছে মনে হল। ইভান শেকেতা। বাড়ি তার চোর্নয়ে গাঁয়ে। বাবা তার য়াৎসিনারই বন্ধু আন্দ্রেই, মারা গেছে। ইভান বেশ লম্বা চওড়া শক্তসমর্থ সুদর্শন ছেলে, কিন্তু তারও কোন বাড়ি ঘরদোর নেই। ভগবান যখন কাঠের কলে কিছু অর্ডার পাইয়ে দেন, ইভান শেকেতা তখন কাঠ কাটতে যায়। তা নাহলে পাহাড়ের গায়ে ভেড়া চরায় নয়ত ধনী কর্তা মিকলা ভার্গার বাড়িতে ছুটকো ছাটকা কাজ করে। তবে সব কাজই অন্যের জন্য।

‘বুড়ো শেকেতা বেঁচে থাকতে দুই বন্ধুতে একটি বোঝাপড়া হয়েছিল। ঠিক ছিল য়াৎসিনার মেয়ে যদি যৌতুক হিসেবে ছোট্ট একটুকরো জমি, একটা বাড়ি আর একটা গরু দিতে পারে, তবে ইভান তাকে বিয়ে করবে। ইভান নিজেও তখন তার স্বীকৃতি জানিয়েছিল। হয়ত বাবার মতে অমত করবে না, এই ভেবেই রাজী হয়েছিল, কিম্বা হয়ত অন্যের বাড়িতে থেকে থেকে সে তখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এমনকি পাখিরাও নিজের বাসায় থাকে।

‘যা হোক, য়াৎসিনা তখন যৌতুকের জন্য আবেদন নিবেদন সুরু করল। কী চেষ্টাই না করল, কত সব অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়াল! কিন্তু কিছুই ফল হল না হাজার চেঁচামেচি কর, মাটির গায়ে আঁচড় কাট কিছুতেই লাভ হবে না! সোভিয়েত সরকার না এলে ভাসিল য়াৎসিনার হয়েছিল আর কি! আন্নাকে তবে সে কী দিয়ে যেত? কিন্তু এখন সে তার যৌতুকের জন্য দেড় হেক্টার জমি আর একখানা বাড়ি পেয়েছে—সোভিয়েত সরকার দিয়েছে। এসবই তো আন্নারই। পাছে মেয়ের যৌতুক ভেস্তে যায়, সেই ভয়েই তো য়াৎসিনা যৌথখামারে যোগ দেয়নি। দেবদূত হয়ত একথাটা জানে না যে, যৌথখামারে যোগ দিতে হলে নিজের জমি দিতে হয়। জমিই যদি রইল না তবে আর মেয়ের বিয়ের যৌতুক দেবে কী করে?...’

এইসব ভাবতে ভাবতেই য়াৎসিনা চলেছে আন্নার ভাড়া করা ঘোড়ার স্লেজে চড়ে স্নেগোভেৎস ছেড়ে তার নিজের গাঁয়ে।

পরিষ্কার হিমেল সকাল। রাস্তাটা ছোট্ট উপত্যকায় পাক খেয়ে ক্রমশ উপরে গেছে। সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা খাড়া পাহাড়গুলো চারদিকে ভীড় করে দাঁড়িয়ে। বনগুলো—গ্রীষ্মকালে তারা দুর্ভেদ্য—এখন বেশ পাৎলা হয়ে গেছে। বনের উপরে, ঠিক আকাশের তলেই পাহাড়ের মাঠগুলোয় বরফের এমন দ্যুতি যে তাকান যায় না, চোখে রীতিমত লাগে।

স্লেজের পাশে চলেছে আন্না। তার চওড়া স্বল্প কুঁজো-কাঁধ পিঠটা য়াৎসিনার চোখে পড়ছে। রানারগুলো ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলেছে, ঘোড়াগুলো ঢিমে তালে পা ফেলে চলেছে। মেয়েটি লম্বা ডাল নিয়ে তাদের ছোটাবার চেষ্টা করছে।

‘আন্না,’ বুড়ো বলে উঠল, ‘এ ঘোড়াদুটো কার?’

‘মিকলা ভার্গার,’ ফিরে না তাকিয়েই উত্তর দিল আন্না।

‘কত টাকা দিলি?’

‘আশি, আসা যাওয়া নিয়ে।’

‘আশি রুবল,’ বুড়ো প্রায় নিঃশব্দেই প্রতিধ্বনি করে উঠল।

এত বেশি খরচ করার জন্য তার ক্ষোভ হল...

খোলা হাওয়ার জন্য নাকি মেয়ে তাকে তার গাঁয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আবার সে তার নতুন বাড়িটি দেখতে পাবে—এখনো তাতে ভালরকম অভ্যস্ত হয়নি,—একথা মনে হওয়ায় ভাসিলের ব্যথাটা যেন মরে এল। ‘ইহজগৎ’ আবার বুড়ো য়াৎসিনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল।

‘আন্না!’

‘কী, বাবা?’ আন্না এবার ঘুরে তাকাল।

মেয়ের মায়া ভরা মুখটা ভাসিলের চোখে পড়ল। মনের মধ্যে ফুটে উঠল মেয়ের প্রতি একটা অপরাধের ভাব। কখনো তাকে একটা মিষ্টি কথা ভাসিল বলেনি, সেই একেবারে বাচ্চা বয়সের পর থেকে; কখনো জিজ্ঞেস করেনি আন্না কী চায়, কী তার ভাবনা। সারা জীবন দুজনের মধ্যে শুধু কাজ প্রতিদিনের রুটি আর শীতকালের গরম জামা নিয়েই কথা হয়েছে। একথা ভেবেই বুড়োর গা শিউরে উঠল, গায়ের ফার কোট সত্ত্বেও সে কেঁপে উঠল। অথচ এই বিরাট পৃথিবীতে এই মেয়েটিই তার একমাত্র আপনার জন।

‘আন্না, চারদিকের সব খবরাখবর আমায় বল। গ্রামে নতুন কী কী ঘটল?’ মেয়েকে জিজ্ঞেস করে ভাসিল দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

‘বলার আর কীই বা আছে?’ আন্না অনিচ্ছার সঙ্গে উত্তর দিল। ‘ওরা সব পরিকল্পনা করছে।

‘সে জানি ওরা বনের মধ্যে পরিকল্পনা গড়ছে,’ মেয়ের উত্তরে অসন্তুষ্ট হয়ে বুড়ো বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘কিন্তু গ্রামের কী খবর?’

‘সবখানেই ওরা আজকাল পরিকল্পনা করছে—বনে যৌথখামারে, সবখানে।’

‘যৌথখামারে নতুন কী হয়েছে শুনি?’ য়াৎসিনার কানদুটো শোনার আগ্রহে খাড়া হয়ে উঠল।

‘ওরা বলছে জমি কম, কিন্তু আয় নিচু-জমির খামারের চেয়ে কম হওয়া উচিত নয়।’

হাঁ, ওরা তবে ঐ চেষ্টা করছে!’

কিন্তু আন্না যেন কথাটা শুনতেই পেল না।

সে বলে চলল, ‘ওরা মৌমাছি পালনও সুরু করতে চায়। এর মধ্যেই মৌচাক বানান সুরু করে দিয়েছে।’

‘হতেই পারে না, সত্যি নাকি?’ বিস্ময়ে বুড়োর বিষম লেগে গেল।

‘লাভ আরো বাড়াবার জন্য বসন্ত এলে ওরা গোরুর কাজও সুরু করবে…’

‘তার মানে? গোরুর কাজ মানে?’ য়াৎসিনা জিজ্ঞেস করল। ‘গোরু ভগবানের সৃষ্টি। কী তুই বাজে বকছিস?’

‘বাজে বকছি না বাবা, মিথ্যে কথা কেন বলব বল,’ আন্না একটু আহতস্বরেই বলল, ‘স্নেগোভেৎস না কিয়েভ থেকে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতরা এসে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন ...কামারের মেয়ে কালিনা সিজাক্ সেদিন আমার কাছে এসেছিল। ওই এখন ডেয়ারীর তত্ত্বাবধানে আছে। সিজাক, এসে বলল, “আন্না একটা দরখাস্ত পাঠিয়ে দাও আমাদের ডেয়ারী ফার্মে যোগ দেবার জন্য। তোমায় পড়াশুনোর জন্য পাঠিয়ে দেব। সবকিছু শিখে এসে আমাদের ফার্মেই তুমি কাজ করবে।” পরশুদিন কয়েকজন কমসমল সদস্যও এসেছিল…’

‘ওসব শুনিস না!’ আতঙ্কে য়াৎসিনা বালিশে দুহাতের ভর দিয়ে কিছুটা উঠে বসল। ‘খবরদার ওসব শুনিস না, বুঝলি? নিজের জমি না থাকলে তোর অবস্থা হবে কাটা ডালের মতো। জমি ছাড়া কে তোকে বিয়ে করবে বল?’ বুড়োর তো দমবন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। ‘তোর বয়সী অন্য মেয়েরা এতদিনে ছেলের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice