ছয় বছরের এতিম ছেলে ফকীরচাঁদ
বিচিত্র এক জীবন। আমাদের এই বাংলাদেশে যারা শিল্পপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে এমন একটি জীবন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমি হাজী মহম্মদ ফকীরচাঁদের কথা বলতে যাচ্ছি। নিঃস্ব নিরক্ষর এক এতিম, ভাগ্য যাকে কোনো দিক দিয়েই কোনো ভাবে অনুগ্রহ দেখায়নি। সে ছেলে কেমন করে একান্ত ভাবে নিজের বুদ্ধি ও নিষ্ঠার জোরে ব্যর্থতার বাধা ডিঙ্গিয়ে অবশেষে সাফল্যের মঞ্জিলে এসে পৌঁছাল আমাদের এই ব্যবসা বিমুখ বাঙ্গালি সমাজে তা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে পথ নির্দেশ করতে পারে।
পিতার নাম আলিজান ব্যাপারী। তাঁর আদি নিবাস রহমতগঞ্জে, পরে উর্দু রোডে চলে আসেন। গরীব মেহনতী মানুষ। মৌলভী বাজারে তাঁর পৈত্রিক ফলের ব্যবসা ছিল। ফকীরচাঁদ যখন মাতৃগর্ভে, সেই সময় পিতা আলীজান ব্যাপারী মারা গেলেন। ফকীরচাঁদের জন্ম হয় ১৮৯৭ কি ১৮৯৮ সালে। তাঁর অসহায়া মা বহু দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে তাকে বড় করে তুলছিলেন। কিন্তু ফকীরচাঁদের বয়স যখন ছয় বছরে পড়েছে, সে সময় তাঁর মাও তাঁদের একা ফেলে রেখে চিরতরে সংসার ছেড়ে চলে গেলেন।
শিশু ফকীরচাঁদকে এখানে দেখবার মতো কেউ রইল না। আশক লেনে আবদুল হামিদ নামে তাঁর এক খালাতো ভাই ছিলেন। সেখানে তাঁর একটু আশ্রয় জুটল। এই বাড়িতেই তিনি বড় হয়ে উঠতে লাগলেন। কোন মতে খাওয়া পরা জুটত, কিন্তু লেখাপড়া করার কোনই সুযোগ পান নি। আবদুল হামিদ একটা মনোহারী দোকানের মালিক ছিলেন। তার দোকান ছিল ইসলামপুরে—নবাব বাড়ির গেটের সামনে। ফকীরচাঁদকে এই দোকানের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো। যে বয়সে অন্যান্য ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে বেড়ায়, সেই বয়স থেকেই ভাবি শিল্পপতি ফকীরচাঁদের কর্মজীবন শুরু হলো।
কুড়ি বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি এই দোকানে কাজ করলেন। এই কাজের মধ্যে দিয়ে খাওয়াপরাটা চলে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে উন্নতির কোনো আশা ছিল না। এখানে তাঁর মন বসবে কেনো? ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন রেঙ্গুনে। সে সময় পূর্ববঙ্গের বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের কাছে রেঙ্গুন ছিল সৌভাগ্যের খনি। যেসব ভাগ্য সন্ধানী রেঙ্গুনে যেতো, তাদের মধ্যে অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠত। কিন্তু রেঙ্গুন তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হাসি হাসল না। দিনের পর দিন পথে ঘোরা আর দুয়ারে দুয়ারে মাথা ঠোকাই হলো সার। কোনো কাজকর্ম জুটল না। গত্যন্তর না দেখে তিনি বাধ্য হয়ে একটা হোটেলে কাজ নিলেন। হোটেলের কাজ মানে খান-সামা বা বয়-এর কাজ। এইভাবে হোটেলের অথবা ওই ধরনের ছোটখাটো কাজ করতে করতে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাঁচ-ছয়টি বছর বৃথাই কেটে গেল। ফকীরচাঁদ বহু চেষ্টা করেও কোনোভাবেই কোনো সুবিধা করতে না পেরে অগত্যা হতাশ হয়ে ফিরে এলেন ঢাকায়। এখানে এসে তিনি কলকাতা থেকে মনোহারী জিনিসপত্র এনে শহরের পথে পথে তা ফেরি করে বেড়াতে লাগলেন। এরপর তিনি এ সমস্ত মাল নিয়ে ফেরি করবার জন্য ময়মনসিংহ শহর, জামালপুর শহর এবং আরও নানা জায়গায় যেতেন। পরে এই মনোহারী মালের ব্যবসা নিয়েই তিনি আসামে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই তিনি সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না। সবকিছুই যেন তাঁর প্রতিকূলে।
কিন্তু তাঁর মনোবল এতটুকুও ভাঙ্গেনি। মনোহারী মালের ব্যবসা গুটিয়ে রেখে এবার তিনি নতুন করে বিড়ির ব্যবসা ফেঁদে বসলেন। মাত্র ৪ জন কারিগর নিয়ে তিনি এই ব্যবসায়ে নামলেন। সেই কারিগরদের সঙ্গে বসে তিনিও নিজের হাতে বিড়ি বাঁধতেন। আজকের দিনের অনেক লোক ফকীরচাঁদকে নব রায়ের গলির এক বাড়ির বারান্দায় বসে নিজের হাতে বিড়ি বাঁধতে দেখেছে। এই ফকীরচাঁদ যে অদূরভবিষ্যতে বিশিষ্ট শিল্পপতি হয়ে দাঁড়াতে পারেন, একথা কি তাদের মধ্যে কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল!
এটা এ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের কথা। তখন সারা দেশ জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই চলেছে। এই সংগ্রামের একটি প্রধান হাতিয়ার বিদেশী মাল বর্জন। বিদেশী মালের মধ্যে বিদেশী কাপড়, বিদেশী চিনি আর বিদেশী সিগারেট ইত্যাদি বর্জনের উপর বেশী জোর দেওয়া হয়েছিল। এই সংগ্রামী আহ্বানে মানুষ যে কি ভাবে সাড়া দিয়েছিল, এখনকার দিনের লোকদের সে কথা বিশ্বাস করানো কঠিন। প্রকাশ্যে কেউ সিগারেট খেতে সাহস করত না। ঘরের লোকেরাও তাদের ঘৃণা করত। এ অবস্থায় সিগারেট বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। সিগারেট বর্জনের ফলে কি হিন্দু কি মুসলমান সকলের মধ্যেই দেশী বিড়ির ব্যবহার হু হু করে বেড়ে চলল। সে সময় ঢাকার বাজারে মুলজী সিক্কার ‘মোহিনী’ ও ‘জাহাজ’ মার্কা বিড়ির প্রচলন ছিল সবচেয়ে বেশী। শহরে মুসলমানদের মধ্যে বিড়ির কারিগর যথেষ্ট ছিল, কিন্তু বিড়ির কারবারী একজনও ছিল না। এই সময় ফকীরচাঁদ তাঁর ৪ জন কারিগর নিয়ে ‘জুবেদা’ মার্কা বিড়ি তৈরী করতে লাগলেন। সম্ভবত তখনকার দিনের খ্যাতনামী ফিল্ম অভিনেত্রী ‘জুবেদা’র নামে তাঁর বিড়ির নামকরণ করেন। ফকীরচাঁদ নিজে সাইকেলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের দোকানে দোকানে বিড়ি সরবরাহ করাতেন। তাঁর সেই অতি প্রিয় সাইকেলটি এখনও তাঁর বাড়িতে সুরক্ষিত আছে।
বিড়ির ব্যবসায়ে কিছুটা উন্নতি ‘লাভ’ করার পর তাঁর বিখ্যাত পাঞ্জা মার্কা বিড়ি বাজারে বের হয়। সে সময় বিড়ির কারবারী হিসাবে তিনি ঢাকা শহরে সুপরিচিত হয়ে গেছেন। নবরায়ের গলি থেকে এই ব্যবসায়ের সূত্রপাত। পরে ক্রমোন্নতির ফলে ইসলামপুরের বর্তমান কোহিনূর স্পোর্টস-এর বাড়ির একতলা আর দোতলা বিড়ির কারিগরে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। তাঁহার কারিগরদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের লোকই ছিল। কালীবাবু নামে তাঁর এক বন্ধু এই বিড়ির ব্যবসায়ের সঙ্গে আজীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
ফকীরচাঁদের শেষ পরীক্ষা এল ১৯৪১ সালে। এই বছর ঢাকা শহরে সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়। তার ফলে তাঁর দোকানপত্র লুটপাট হয়ে যায়। এতদিনের চেষ্টার ফলে যে বিড়ির কারবার তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার চিহ্নমাত্র রইল না। তিনি সবকিছু হারিয়ে পূনঃমুষিকে পরিণত হলেন। কিন্তু তাতেই কি দমবার পাত্র? নাছোড়বান্দা ফকীরচাঁদ ইসলামপুর ছেড়ে তাঁর উর্দু রোডের বাসায় নতুন করে বিড়ির কারবার শুরু করে দিলেন।
এবার ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁর প্রতি প্রসন্ন হলেন। এরপর থেকে তাঁকে আর কোনো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়নি। বিড়ির কারবার আবার তার অংকুরাবস্থা থেকে ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে উঠছিল। এমন সময় একটা সুযোগ যেন তাঁর হাতে এসে ধরা দিল। দেশ বিভাগের পর শিবাজী বিড়ি ফ্যাক্টরীর মালিক দেশ ত্যাগ করে চলে গেলেন। ফকীরচাঁদ তাঁর কাছ থেকে এই বিড়ি ফ্যাক্টরী কিনে রাখলেন। এরপর থেকে তাঁর অবস্থা উত্তরোত্তর উন্নতির পথে এগিয়ে চলল।
পূর্ব পাকিস্তানে দুজন বিড়ি ফ্যাক্টরীর মালিক শেষপর্যন্ত শিল্পপতি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একজন ভাণ্ডারী বিড়ির মালিক আর একজন হাজী মহম্মদ ফকীরচাঁদ। সে সময় যাঁরা বিড়ির কারবার করতেন তাঁদের মধ্যে সবাই ভারত থেকে বিড়িপাতা ও সুখা আমদানী করতেন। ফকীরচাঁদই সর্বপ্রথম ভারতের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সুখা আমদানী করবার ব্যবস্থা করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এই যোগাযোগ তাঁর জীবনে এক বিপুল পরিবর্তন নিয়ে এলো। তিনি সেখানে বিভিন্ন কলকারখানায় গিয়ে আগ্রহের সঙ্গে কলকব্জা মেশিনারী দেখে দেখে বেড়াতেন। হাফিজ টেক্সটাইল মিলের মালিক (প্রাক্তন বিড়ি ব্যবসায়ী) তাঁকে কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করে তোলেন।
১৯৫৭ সালে হাজী ফকীরচাঁদ ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জের মধ্যবর্তী কদমতলী নামক স্থানে কাপড়ের কল স্থাপনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি লাভ করেন। তখন তাঁর বড় ছেলে বিড়ির কারবারের দায়িত্বে ছিলেন। ছোটো দুই ভাই পড়াশোনা করছিল। হাজী ফকীরচাঁদকে একাই এই কাপড়ের কলের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। তিনি আধুনিকতম জাপানী মেশিন আমদানী করে উঁচু মানের সুতা উৎপাদন
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments